আবুল মনসুর আহমদ: প্রিয় পূর্বসুরী

পর্ব ১

মারুফ ইসলাম

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৯

নিদানের কালে পূর্বসুরীদের পদাঙ্ক তালাশ করতে হয়, তাতে কখনো কখনো সঠিক পথের দিশা পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা এমনই এক নিদানের কালের নাদান বাচ্চা যে, কত অনায়াসে প্রিয় পূর্বসুরীদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছি! একজন আবুল মনসুর আহমদ, আমাদের সেরকমই এক প্রিয় পূর্বসুরী— যাঁকে আমরা স্রেফ বিসিএস পরীক্ষার্থীদের ঠোঁটের আগায় বন্দি করে ফেলেছি। আমাদের প্রজন্মের প্রায় প্রতিটি ‘বিসিএস-তরুণ’ তাঁর নাম ও ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ের নাম মুখস্ত করে ফেলেছে শুধু বিসিএস পরীক্ষায় একটি নম্বর পাবার আশায়। এর বাইরে আবুল মনসুর আহমদ সম্পর্কে তারা আর কিছুই জানে না! কী দুর্দৈব্য! কত হতভাগ্য এ প্রজন্ম!

আবুল মনসুর আহমদের নানা পরিচয়। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, বুদ্বিজীবী এবং সমাজ সংস্কারক। কোনো পরিচয়ের চেয়ে কোনো পরিচয়ই ছোট নয়। প্রতিটি পরিচয় স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি জ্বলজ্বলে তারকা। তবু কবুল করতেই হয়, এসকল পরিচয়ের মধ্যে তাঁর সাহিত্যিক পরিচয়ই সব থেকে উজ্বল। এবং অতি অবশ্যই আরো একবার স্বীকার করে নিতে হবে যে, সাহিত্যিক পরিচয়ের মধ্যে তিনি আবার ‘ব্যঙ্গ সাহিত্যিক’ হিসেবে বিরল, ব্যতিক্রম।

বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম ব্যঙ্গ সাহিত্যের সূত্রপাত বোধকরি বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে। তিনি তাঁর কালোতীর্ণ চরিত্র কমলাকান্তকে তৈরি করেছিলেন বিদেশি স্যাটায়ার সাহিত্যের আদলে। কমলাকান্ত প্রভূত রস বিলিয়েছে বাঙালি পাঠক মনে, সন্দেহ নেই। এরপর যদ্দূর জানা যায়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য মহোদয় ও বীরবল নামে খ্যাত সুসাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যভুবনে রম্য লেখক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনিও সাহিত্যের এ ধারায় বেশ মেধার স্বাক্ষর রাখেন। প্রমথ চৌধুরীর পর বাংলা রম্যসাহিত্যে আলোচিত হয়ে ওঠেন রাজশেখর বসু, যিনি পরশুরাম নামেই সমধিক পরিচিত। এরপর অবধারিতভাবে নাম চলে আসে ‘প্রণাবি’র অর্থাৎ প্রমথনাথ বিশীর নাম। ধারণা করা হয়, ইংরেজি সাহিত্যের স্যাটায়ার গুরু জর্জ বার্নার্ড শ যেহেতু সংক্ষেপে নিজের নাম ‘জিবিএস’ লিখতেন, সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রমথনাথ বিশীও লিখতে শুরু করেন প্রণাবি।

সে যাই হোক, রম্যসাহিত্যে এরপর যিনি চিরস্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি আবুল মনসুর আহমদ। তাঁর রচিত ব্যঙ্গ বিদ্রুপাত্মক রচনা ‘আয়না ও ফুড করফারেন্স’ তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের এক অসামান্য দলিল হয়ে রয়েছে। সন্দেহ নেই, একটি সোনার দোয়াত-কলম ছিল আবুল মনসুর আহমদের হাতে।

আবুল মনসুর আহমদের সেই সোনার দোয়াত কলম থেকে যেসব অনবদ্য রচনার জন্ম হতো, সেসব রচনার শৈলী সম্পর্কে বন্ধুবর কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বাংলা ভাষার ব্যঙ্গ সাহিত্য খুব উন্নত হয়নি। তার কারণ, ব্যঙ্গ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অসাধারণ মেধার প্রয়োজন। এ যেন সেতারের কান মলে সুর বের করা। সুরও বেরুবে, তারও ছিঁড়বে না। আমি একবার এক ওস্তাদকে লাঠি দিয়ে স্বরোদ বাজাতে দেখেছিলুম। সেবার সেই ওস্তাদের হাত সাফাই দেখে আশ্চর্য হয়েছিলুম। আর আজ বন্ধু মনসুরের হাত সাফাই দেখে বিস্মিত হলুম। ভাষার কান মলে রস সৃষ্টির ক্ষমতা মনসুরের অসাধারণ। এ যেন পাকা ওস্তাদি হাত। আবুল মনসুরের ব্যঙ্গের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, সে ব্যঙ্গ যখন হাসায় তখন সে হয় ব্যঙ্গ কিন্তু কামড়ায় যখন তখন সে হয় সাপ। আর সে কামড় গিয়ে যার গায়ে বাজে তার ভাব হয় সাপের মুখের ব্যাঙের মতোই করুণ।` চলবে