আবুল মনসুর আহমদ: প্রিয় পূর্বসুরী

শেষ পর্ব

মারুফ ইসলাম

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯

এই সন্দেহ থেকেই কী বাংলার বর্তমান লেখককুল কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অসঙ্গতি নিয়ে কোনো ব্যঙ্গ করেন না? প্রশ্ন সহজ, উত্তর কঠিন। তারচেয়ে আবার আবুল মনসুর আহমদের গল্পের দিকে নজর ফেরানো যাক। হুজুর কেবলা যেমন ইসলাম ধর্মের অপব্যবহারকেন্দ্রিক অন্ধকার নিয়ে লেখা গল্প, তেমনি ‘গো দেওতা কা দেশ’ গল্পটি হিন্দু ধর্মের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে লেখা। হিন্দু সমাজে গো হত্য নিয়ে যে প্রথা প্রচলিত রয়েছে তার গোড়া ধরে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ। এছাড়া হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াতে ইংরেজরা যে কৌশল অবলম্বন করেছিল তারও যৎসামান্য নমুনা পাওয়া যায় এ গল্পে। বলার অপেক্ষা রাখে না, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাই এ গল্পের প্রধান উপজীব্য।

শুধু ধর্মের এসব অসঙ্গতিই নয়, সমাজপতি, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী যেখানেই তিনি কোনো অন্যায় অসঙ্গতির দেখা পেয়েছেন সেখানেই তাঁর কলমকে চাবুক বানিয়ে শপাৎ শপাৎ আওয়াজ তুলেছেন। তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের রসাঘাত ও কশাঘাত মূলত ছাকনি হয়ে সমাজকে পরিশোধিত করত। আবুল মনসুর আহমদের লেখনির আঘাত শুধু ক্ষয়প্রবণ সমাজের মুমূর্ষু মূল্যবোধ ও লৌকিক আচারকেই আক্রমণ করেনি, অধিকন্তু যারা এসব অনুসঙ্গ নিয়ে মিথ্যার ফুলঝুড়ি সাজাতেন, তাদেরকে তিনি নাকানি চুবানি খাইয়েছেন।

তো, অস্বীকার করার আর উপায় কী যে তিনি সমকাল, সমাজ, মানুষ ও রাজনীতি সচেতন সাহিত্যিক ছিলেন? তাঁর আরেক অমরকীর্তি ‘ফুড কনফারেন্স’এ কী অসম্ভব দ্যুতি নিয়ে জ্বলজ্বল করছে বাংলার সমাজ-সংসার। এ বই যখন আবুল মনসুর আহমদ লেখেন, তখন বইটি পড়ে কালজয়ী লেখক অন্নদাশংকর রায় বলেছেন, ‘আয়না লিখিয়া আবুল মনসুর আহমদ প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছিলেন। ফুড কনফারেন্স লিখিয়া তিনি অমর হইলেন।’

সত্যিই আবুল মনসুর আহমদ অমর হয়েছেন। বাংলা রম্য সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গেলে তাঁর নাম এবং ফুড কনফারেন্সের নাম বাদ দেয়া সত্যিই অসম্ভব। বাংলা ভাষার সাহিত্য যারা এখনো টুকটাক পড়ে তাদের বইয়ের শেলফে অবধারিতভাবে নাক উঁচু করে রয়েছে ফুড কনফারেন্স। ফুড কনফারেন্সের এক একটি গল্প যেন এক একটি সময়ের খতিয়ান। এই গল্পগন্থের রিলিফ ওয়ার্ক গল্পের শেষাংশে একটু চোখ বুলানো যাক:

‘সূর্যদোয়ের পূর্বেই মধুপুর গ্রামের শতাধিক ছেলেবুড়োকে হাতকড়া পরা অবস্থায় রিলিফ কমিটির তাম্বুর সম্মুখে জড়ো করা হইল। দারোগা সাহেব সাড়ম্বরে হামিদদের সকলের জবানবন্দি গ্রহণ করিলেন। জবানবন্দি শেষ করিয়া একপাল অভুক্ত অর্ধনগ্ন নরকঙ্কালকে ভেড়ার পালের মতো খেদাইয়া থানায় লইয়া গেলেন।’

কী নির্মম দৃশ্যকল্প! অথচ কী বাস্তব। আবুল মনসুর আহমদের আরেকটি জনপ্রিয় রম্যগল্পের নাম গালিভারের সফরনামা। এই গল্পে তিনি নীতিকথার দিকগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন অম্ল-মধুর ব্যঙ্গের মাধ্যমে। এই গল্পের একটি অংশ এরকম:

‘আলিম: শরিয়ত-বিরোধী বিজ্ঞান-দর্শন ও ভূগোল পড়ান হৈব না।
ডি.পি.আই: আচ্ছা, তারপর?
আলিম: মেয়েদের স্কুল কলেজে পড়ান হৈব না।
সেক্রেটারি: কিন্তু ডাক্তারি ও নার্সিং না শিখালে হাসপাতাল চলবে কেমনে? আওরতদের চিকিৎসা করবে কে?
আলিম: আওরতদের আবরু-ইজ্জত নষ্ট কৈরা ডাক্তারি ও নার্সিং শিক্ষা দিতে হৈব? চিকিৎসার জন্য। শুইনা হাসি পায়। হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত এই চারটি চিজ আল্লা নিজের হাতে রাখছেন। চিকিৎসকেরা কেউ কারো হায়াত দিছেন, একথা আপনারা কোনো দিন শুনছেন?’

বিষয়বস্তু তো বটেই ভাষাতেই তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। তাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট হচ্ছে, তিনি ময়মনসিংহের কথ্য ভাষাকে সাহিত্যে স্থান দিতে চেয়েছেন। এটা তাঁর জাতীয়তাবাদেরই বহিঃপ্রকাশ তাতে সন্দেহ নেই এ প্রসঙ্গে ড. রফিকুল ইসলাম বলেছেন, `একুশে ফেব্রুয়ারিকে আবুল মনসুর আহমদ একুশ দফাতে পরিণত করেছিলেন। আমরা জাতিয়তাবোধের একটা মহান চেতনা তাঁর মধ্যে পেয়েছি।’

আজ, এই নিদানের কালে আবুল মনসুর আহমদের মতো জাতীয়তাবোধে জাগ্রত হয়ে কলম ধরার মতো কেউ নেই। তাঁর মতো ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে সমাজের নিদ্রাভঙ্গ করার মতোও কেউ নেই। তাই এই দুর্দিনে আপনাকে বড্ড বেশি দরকার, প্রিয় পূর্বসূরী আবুল মনসুর আহমদ।