আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ ও তার ‘রেনেসাঁ প্রকল্প’

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : জুলাই ২৫, ২০২০

প্রতিটি বাক্যে আলাদা আলাদা মনোযোগ দিয়ে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো এমন সযত্ন গদ্য আর কে লিখেছে! তার অনেক বাক্য প্রবাদের উচ্চতা অর্জন করেছে। `দুর্দিনে টিকে থাকা সুদিনে বিপ্লবের সমান`, `মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়` ইত্যাদি বাক্যনিচয় শ্রেণিকক্ষ ও অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতায় নিত্য ব্যবহার করে লোকে। এ মানুষটির তীক্ষ্ণ রসবোধ আর সূক্ষ সাহিত্যিক সংবেদনশীলতা চমৎকৃত করবে যে কাউকে ।

সাহিত্য সমালোচনামূলক যতগুলো গদ্য তিনি লিখেছেন, মানে ও উচ্চতায় সেগুলোর সমতুল্য লেখা এ দেশে কমই চোখে পড়েছে। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত আব্দুল মান্নান সৈয়দের জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ ও জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা, ১৯৭৫ এ রফিক আজাদের `অসম্ভবের পায়ে` কাব্যগ্রন্থের অসাধারণ পর্যালোচনা তিনি করেছিলেন। সমসাময়িক কালের সাহিত্য নিয়ে এমন নিবিড়, অন্তর্ভেদী ও বস্তুনিষ্ঠ সাহিত্য সমালোচনা এখন দুর্লক্ষ্য। ফেসবুকীয় বাকবিস্তারে নিজের ঢোল নিজেই বাজিয়ে যাওয়ার সাহিত্যিকতাকে বাদ দিলে সমসাময়িক সাহিত্য এ দেশে বহুদিন থেকেই কোনও পর্যালোচনারই অধীন নয়। সাহিত্যর মান ও উচ্চতা উপলব্ধি করার, ও তা প্রকাশ করার উপযুক্ত মনীষার অভাব প্রকট হয়ে উঠছে দিন দিন। বন্ধুদের ও সমকালের রচনা নিয়েও যে বস্তুনিষ্ঠ, সুলুকসন্ধানী আলোচনা সম্ভব, ও সাহিত্যপ্রতিভার চারিত্র্যলক্ষণ নিপুণ ও আন্তরিক পর্যবেক্ষণে যে উন্মোচন করা যায়, এই শিক্ষা নিতে পারি আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছ থেকে।

বাংলা গদ্যের শক্তি ও সুরটুকু বুঝে নিতে ও সাহিত্যের সৌন্দর্য উপলব্ধি ও সংবেদনশীলতা অর্জনে তার লেখা ও কথার কাছে তারুণ্যকে মাঝে মাঝে ফিরে তাকাতে হয়! তার গদ্য নির্মেদ নয়, বিশেষণ ব্যবহারে তিনি প্রায় অক্লান্ত। পাঠককেও তিনি ক্লান্ত করেন না। জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য কি করে শৈল্পিক হয়ে ওঠে, অনবরত অনুভববেদ্য কথকতা কি করে প্রজ্ঞাসিক্ত বলে মনে হতে পারে, তার কিছু আলোকোচ্ছটা দেখিয়েছেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। অনেকের কাছে তো তার কথা ও উপস্থিতিও শিল্পের অনুভব দেয়।

আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য ছিলাম না কোনোদিন। স্যারের সহবতও পাইনি। তাকে জানি তার কিছুটা পাঠের মধ্য দিয়ে। কলকাতাবাহিত সাহিত্যরুচির সমঝদার তিনি। সায়ীদ স্যার সাহিত্যকে প্রায় ধর্মের বিকল্প ভাবা মানুষ। সাহিত্যপাঠ প্রার্থনার সমতুল্য তার কাছে। এইদিক দিয়ে ম্যাথু আর্নোল্ডীয় ভিকটোরিয়ান সাহিত্য চৈতন্যের বাহক তিনি। পাঞ্জাবি আর পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুলের মধ্য দিয়ে এক সুমিষ্ট-স্নিগ্ধ সাহিত্যিক আবহ তিনি ধারণ করে থাকেন নিজ অবয়বে। প্রধানত সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়েই আলোকিত মানুষ তৈরি হয়, এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে তার নিঃসংকোচ আস্থা। তিনি তার বই পড়া কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যে প্রজন্ম গড়ে তুলবার কোশেশ করেছেন, তাদের মুক্তি প্রধানত তার ও তাঁর প্রতিষ্ঠানের সম্মোহন থেকে মুক্তি লাভের মধ্য দিয়েই সম্ভব!

কোনও মহৎ চিন্তার দিশারি ও ধারক না হয়ে ভাষা যদি শুধু ধ্বনিময়তায় আর সুখদ কোমল অনুভুতিতেই ফুরিয়ে যায়, তবে তা কি করে আলোকপ্রদায়ী হয়? কোনও আলো এই আলোকিত মানুষের প্রকল্প ছড়াতে না পারলেও বহু তরুণ প্রাণকে হয়তো ফিরিয়ে রেখেছে কিছু নীল ছোবলের হাত থেকে। বই পড়া নিজেই একটা কাজ, গ্রন্থপাঠ নিজেই এক আলোকক ও আলোকিত তৎপরতা— এই সত্য-মিথ্যা বোধ তিনি ছড়াতে পেরেছেন। তিনি ও তার প্রতিষ্ঠান কোনও উন্নততর ও মহাজীবনের ইশারা দিতে ও তৈরি করতে না পারলেও `বাঙালিত্ব` ও আন্তর্জাতিকতার মৃদু মিশেলে তিনি তৈরি করেছেন তার অ/রাজনৈতিক ‘রেনেসাঁস প্রকল্প’।

মানুষ সত্যিকারে কী করে আলোকিত হয়, কোন প্রদীপের আলোতে দীপ্যমান হয়ে সে নিজেই হয়ে ওঠে প্রদীপসম, ইতিহাসের বৃহৎ পরিমণ্ডল থেকে সেই অনুসন্ধানের তাড়না তৈরি হয় কিনা তার উদ্যম ও আয়োজন থেকে, সেই প্রশ্নটুকু থেকেই যাবে। তবে বঙ্গবাসী যখন প্রায় সব প্রতিষ্ঠান খুইয়ে চাপা গোঙানিতে মৃতবৎ পড়ে থাকে, তখনও তার স্বহস্তে নির্মিত প্রতিষ্ঠান দণ্ডায়মান থাকে স্বমহিমায়। কী করে প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যায়, টিকিয়ে রাখা যায় তার অন্যতম উদাহরণ হিসেবে সায়ীদ স্যারকে কেউ কেউ দিশারি ভাববেন, নিঃসন্দেহে। টিভি উপস্থাপক হিসেবে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকেও মনে পড়বে অনেকের।

ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর পর তিনি শেষ জাতীয় স্যার হিসেবে টিকে থাকুন আরো বহুদিন, উপভোগ করুন বেঁচে থাকাকে, আর জীবনের এই প্রায় শেষলগ্নে যদি মহাজীবনের কোনও ইশারা বুকে বেজে ওঠে, তবে তা নিঃসংকোচে বলে যাবেন আপনি, এই প্রত্যাশা করি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক