আমাদের ধ্বজভঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা ও একটি ভিডিওকথন
জগলুল আসাদপ্রকাশিত : জুন ০৫, ২০২০
দু’চারটা তথ্য জানাকেই আমরা মেধার পরিমাপক বানিয়ে ফেলেছি। টিভি সাক্ষাৎকারে জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীরা যে প্রশ্নের উত্তরগুলো পারেনি, সেগুলো যদি ওরা সত্যিই পারতো তাতে কী কোনও গুণগত তফাৎ হতো বলে আমরা ভাবি? তাদের জীবনে, আচরণে এবং চিন্তা প্রক্রিয়া শিখতে ওই প্রশ্নগুলোর কোনও ভূমিকা আছে? যে সাংবাদিক সদ্য পাশ-করা ছোট ছেলেমেয়েদের প্রশ্ন করে তাদের ‘মেধা’ যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়ে হেনস্তা করলো, এই অধিকার তাকে কে দিয়েছে? মেধা যাচাইয়ের জন্যে রয়ে গেছে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাজীবন। রয়েছে শিক্ষক, পরীক্ষা ও প্রশ্নপত্র। ওই সাংবাদিকের কাছে এই বাচ্চাগুলোকে পরীক্ষা দিতে হবে কেন?
খেয়াল রাখতে হবে, প্রশ্নকর্তা সবসময় সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। ওই বাচ্চাদের পক্ষেও সম্ভব ছিল, এই সাংবাদিককে প্রশ্ন করে ঘাবড়ে দেয়া। অপদস্ত করা। ক্যামেরার সামনে নিজের সাংবাদিক পরিচয়ে উপস্থিত হয়ে হুটহাট দুই-একটা তথ্যমূলক প্রশ্ন করে ঘাবড়ে দেয়া কঠিন কাজ নয়। যে কাউকেই প্রশ্ন করে ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব। এই সাংবাদিকও এই শিক্ষা ও রাষ্ট্রব্যবস্থারই প্রোডাক্ট। এই সাংবাদিকের কোনও ক্রিয়েটিভিটি আছে? ওই টিভি চ্যানেলও কি সৃজনশীলতাকে মেনে নেয়ার অবস্থায় আছে? সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ তো হতো, ওই ছাত্রদেরকে প্রশ্ন না করে তাদের পছন্দের বিষয়ে কথা বলতে দেয়া, বা পড়তে গিয়ে কী সমস্যা তাদের হয় তা জানতে চাইলে।
অথবা, ওই শিক্ষার্থীদেরকেই প্রশ্ন করতে বলা যেতে পারতো। কথায় আছে, একটা ভালো প্রশ্ন জ্ঞানের অর্ধেক। শিক্ষার্থীদেরকে প্রশ্ন করে এই যে ভুল উত্তরগুলো বের করে আনা, এইটার উদ্দেশ্য কি? শিক্ষার্থীদেরকেই দোষী বানানো? এই ভুল উত্তরের পেছনে দায় কার? (যদিও এই ভুল উত্তরগুলোকে বিরাট ক্ষতি বলে আমি কিছুতেই মনে করি না) দেখে মনে হলো. সাক্ষাৎকারগুলো গ্রামের স্কুলগুলো থেকে নেয়া। তো, সেখানে ক্লাস হয়েছে? গাইডনির্ভর প্রশ্নপত্র প্রণয়নে দায় কার? শুধু পাঠ্যবই পড়েই বচ্চারা ইক্সাম দিতে পারে না কেন, কেন গাইড বই লাগে? ক্লাসেই পড়া শেষ হয়? হন্যে হয়ে চার-পাঁচটা সাবজেক্ট প্রাইভেট কেন পড়তে হয়, বা সবার কি সেই সামর্থ্যও আছে?
পাঠ্যবইগুলো ইচ্ছাকৃতভাবেই এমন করে তৈরি যাতে শুধু সেগুলো পাঠই যথেষ্ট না হয়, বাড়তি গাইডবইও যেন লাগে। পিএসসি, জেএসসির পর আবার এসএসসি পরীক্ষা কেন? আমরা তো ওদের পরীক্ষার্থীই বানাতে চেয়েছি, মার্কস বেশি পাওয়াই লক্ষ্য বলে শিখিয়েছি, এখন অন্য কিছু চাইলে হবে? এত এত বই আর এত এত আইটেম পাঠ্য রেখে আমরা কোন লক্ষ্য অর্জন করতে চাই? পাঠ্য বিষয় হিসেবে কী পড়ছে ওরা? সিলেবাস কী লক্ষ্য নিয়ে তৈরি? এসব পড়ে চিন্তাশীলতার বিকাশের সম্ভাবনা আছে? মানুষ হিশেবে ‘উত্তম’ হয়ে ওঠার বিন্দুমাত্র প্রণোদনা আছে? মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্নহীন কেন? পরীক্ষার প্রশ্নগুলোর বন্ধ্যাত্ব কে ঘুচাবে?
যারা শিক্ষা দেন তাদের নিয়ে ভাবনা কই? মাঠ পর্যায়ের শিক্ষকদের অভিজ্ঞতার মূল্য দেয়া হয় নীতি প্রণয়নে? প্রশ্নবাণিজ্যের কুপ্রভাব কি চলে গেছে? শুনি, এখনো অনেকেই লৌকিক বা অলৌকিকভাবে কিছু পেয়ে যাবার প্রত্যাশায় আগরাতে অপেক্ষা করে! বিশাল শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরাই প্রধান লক্ষ্য হলেও সামান্যই তাদের ভূমিকা। স্বাভাবিকভাবেই। কোনও কিছুকে প্রভাবিত করার সুযোগ তাদের নেই, একটি ব্যবস্থার ভেতরে প্রভাব গ্রহণ করাই তাদের কাজ। তাই তাদেরকে দোষারোপ করার খুব বেশি সুযোগ নাই। আমাদের তৈরি এই নিবীর্য ও ধ্বজভঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতর থেকে কি বিশাল আর মহান কিছু আমরা আশা করতে পারি?
এই সাক্ষাৎকার প্রচার চরম রকমের ফাইজলামি মনে হয়েছে আমার কাছে। বাচ্চারা এবং তার অভিভাবক, বন্ধুবান্ধব এবং পাড়া-প্রতিবেশীরা এই ভিডিওটা দেখবে। বারবার দেখার সুযোগ আছে, ইউটিউবে যেহেতু এসে গেছে। সাংবাদিক একবার সম্মানহানি করেছে, এখন প্রতিটি দর্শকের কাছে তারা লাঞ্ছিত হবে। আত্মগ্লানিতে ভুগে আবেগপ্রবণ কোনও বাচ্চা যদি আত্মহত্যা করে বসে, এর দায় কেউ নেবার আছে? এভাবে আমাদের নজরগুলো কিছু অপদার্থ মিডিয়া মূল জায়গা থেকে সরিয়ে দেয় ও সরিয়ে রাখে। এই বাচ্চাগুলোর কথা প্রচার করে টেলিভিশনঅলারা তাদের ভিউয়ার বাড়াচ্ছে। এই বাচ্চাদেরকে অপমান করে ‘শিক্ষাব্যবস্থা রসাতলে গেল’ বলে হাহাকার— বাণিজ্য করে এই মিডিয়া, সাথে আঁটে ফায়দার নানা ফন্দি।
শিক্ষার এ হাল হলো ক্যামনে, সেই অতীব জরুরি প্রশ্নকে সফলভাবেই লুকিয়ে রাখতে পারে এই নতজানু প্রচারমাধ্যম। এই বাচ্চারা ধন্যবাদার্হ। এরা ভুল করে আবারো আমাদের ভুলগুলো দেখিয়ে দিয়েছে। অনেক আলোচনা ও টকশো করেও আমাদের পুরো শিক্ষাপরিস্থিতি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হতো না, যা অল্প সময়েই এই বাচ্চারা উদোম করে দেখিয়ে দিয়েছে। যদিও আমাদের দূরবস্থা কোনও হঠাৎ আবিস্কৃত বাস্তবতা নয়। যা হোক, মিডিয়ার সামনে ওরা যে স্বতঃস্ফূর্ততায় কথা বলেছে, এতে আমি আশাবাদী। ইতিহাস বদলের দিন এলে ওরা ঠিকই ওদের যোগ্যতার প্রমাণ দেবে।
























