আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং ‘জিপিএ পাইপ’ সার্টিফিকেট প্রসঙ্গ
তৌফিকুল ইসলাম পিয়াসপ্রকাশিত : জুন ০৬, ২০২০
লন্ডনভিত্তিক শিক্ষা বিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন প্রতি বছর বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং প্রকাশ করে। এ তালিকায় প্রথম সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। পরিষ্কার অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে, বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার অবস্থা বর্তমানে খুবই শোচনীয়। যদিও সেই তালিকায় রয়েছে ভারতের ৩৬টি, পাকিস্তানের সাতটি ও শ্রীলঙ্কার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।
১৯৭০ সালের আগপর্যন্ত পাকিস্তান নাকি বাংলাদেশ থেকে সবকিছু চুরি করে নিয়ে গেছে। তারা মনে হয় শিক্ষাটুকু বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গিয়েছিল; ফেলে গেছে শুধুই মাকালফলগুলি। কিন্তু তাই বলে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সব মাকালফলই থেকে যাবে? দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ চেতনা নির্ভর। সেখানে শুধুই চেতনার জয়জয়কার। কারণ চেতনা বিলি করতে কোনও মেধার দরকার হয় না, গবেষনাও লাগে না; নেই প্রয়োজন যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে কোনও কাজ করারও। শুধুমাত্র হাতে বন্দুক থাকলেই চেতনার নেতৃত্ব দেয়া যায়। দিচ্ছেও তাই। তাদের একমাত্র কাজের নাম `লুটপাট` এবং `গুলি` বা `গুম`।
এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশটিকে কোনোকালেও `চেতনা` প্রদর্শন করতে দেখিনি। আমেরিকায় বেসিকেলি `অন্যতম জাতির পিতা` (এদেশে জাতির পিতা সাতজন) জর্জ ওয়াশিংটন এবং প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে স্মরণ করে বছরে একটি দিন `প্রেসিডেন্ট`স ডে` নামে পালন করা হয়। ব্যস এতটুকুই। এর বাইরে ফেডারেল ক্যাপিটল সিটির নামকরণ করা হয়েছে জর্জ ওয়াশিংটনের নামের সঙ্গে মিলিয়ে; আর সেই সঙ্গে রাজধানীতে একটি `মুনুমেন্ট` করা হয়েছে যার নাম `ওয়াশিংটন মনুমেন্ট`। ওয়াশিংটন ডিসির একটি শর্ত রয়েছে, ওই শহরে ওয়াশিংটন মুনমেন্টের চেয়ে উঁচু কোনো ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া হবে না। এ পর্যন্তই। এদেশে কেউ দিবারাত্র জাতির পিতা জাতির পিতা বলে মুখে লালা ফেলে না।
আসলে একজন ব্যক্তির পূজা করে কখনো একটা দেশ দাঁড়াতে পারে না। তাকে দুনিয়ার সবকিছুই জানতে হয়, শিখতে হয়, বুঝতে হয়, চলতে হয়। যোগ্যতা অর্জন করে অপরকে যোগ্যতা দিয়েই টপকাতে হয়। অথচ ১৭ কোটি মানুষের একটি দেশকে আজ একমুখী পূজায় বাধ্য করে রাখা হয়েছে। যার পরিণামে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এই বাজে অবস্থা। `জিপিএ পাইপ` প্রজন্ম তৈরি করা হচ্ছে! যাই হোক, মাথায় বাংলাদেশের পতাকার পট্টি লাগিয়ে, শরীরে লাল-সবুজের টি-শার্ট জড়িয়ে আর শতকোটি টাকা খরচ করে জাতীয় সঙ্গীত গাইলে যে দেশপ্রেম হয় না, সেসব সবাই জানে। এখন আর ওসব ভণ্ডামি নিয়ে না লিখলাম।
এই পৃথিবীর দ্বিতীয় একটি দেশও আমি দেখিনি, যারা খালি পায়ে মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে কথিত দেশপ্রেম উদযাপন করে। ফুল হিন্দু-ধর্মাবলম্বীরাও তাদের দেবদেবিকে দেয় কিন্তু সেজন্য তারা জুতা পরেই বেদীতে দাঁড়ায়। পায়ে মাটি লাগায় না। আমি ঠিক জানি না, কোন গোবরভর্তি মাথাঅলার মাথা থেকে ওসব মিনার-পূজা বের হয়েছিল `তথাকথিত` দেশপ্রেমের নামে!
কোনও সভ্য জাতি শরীরে, টি-শার্টে পতাকা টাঙিয়ে দেশপ্রেম দেখায় না। ওটা দিয়ে বরং নিজেকে সজ্জিত করা চলে। সভ্যরা কাজ করে, এবং সেই কাজের সাফল্য দিয়েই বিশ্বের দরবারে নিজেদের মাথা উচুঁ করে তুলে ধরে। কাজ দিয়ে সাফল্য তুলে ধরতে গায়ে লাল-সবুজ মাখাতে হয় না। ওসব ছোটলোকি, ওসব নষ্টামি। দেশপ্রেম আর নষ্টামি একসঙ্গে যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যখন ঘোষণা করেন, দশ টাকায় তারা চা, সিঙ্গারা ও সমুচা বিক্রি করে, তখনই বোঝা যায় ওদের শিক্ষার মানের কী অবস্থা। এরা প্রতিবছর কাদের হাতে তুলে দিচ্ছে শিক্ষার নামে কথিত সার্টিফিকেটগুলি। এসব সার্টিফিকেটঅলারাই কোটা ও ঘুষের জোরে আজ বাংলাদেশ পুলিশ আর ডিটেকটিভ, র্যাব ও সিআইডিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে; সঙ্গে আগে থেকেই যুক্ত রয়েছে সেনাবাহিনীর ডিজিএফআই।
এরা কি করছে? এদের কাজ হচ্ছে, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে তার পেছনে লাগা। এটাই হলো এসব `জিপিএ-পাইপ` সার্টিফিকেটঅলা অফিসারদের একমাত্র কাজ। এদের কারণেই শুধুমাত্র জীবন বাঁচাতে নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশে পালাতে বাধ্য হয়েছেন পিনাকী ভট্টাচার্য, মুহাম্মদ ওয়াহিদ উন নবী স্বপনের মতো শত শত মেধাবী। এসব `জিপিএ-পাইপ`অলারা পুলিশ, র্যাব, ডিবি, আর ডিজিএফআই সদস্যরা সরকারের পাহারাদার। এদের একমাত্র কাজ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললে তাকে যত উপায়ে সম্ভব `হ্যারাজ` করা। জোরপূর্বক, অন্যায়ভাবে, আইনবর্হিভূতভাবে, গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই তুলে নিয়ে গিয়ে দেশের সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আদালতে হাজির না করে আটক রেখে চূড়ান্ত রকমের শারীরিক নির্যাতন করে পঙ্গু করে দেয়া। যেন বাদবাকি জীবনে আর ভয়ে কথা বলতে না পারে।
আর যাদের কিছুই করতে পারছে না, তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে। আরও একটি কাজ করছে, মূলত যা নিয়ে আজ লিখতে বসেছি। সেই কাজটি হলো, পাগলা কুকুর লেলিয়ে দেয়া। কারা এসব `পাগলা কুকুর`? ওই যে বললাম, জিপিএ-পাইপ সার্টিফিকেটঅলাদের মাথা থেকে আর কতটুকু বুদ্ধি বের হবে? যারা ম্যাক্সিমাম ছা, ছিংগারা, ছমচা বানাতে শিখে গ্রাজুয়েট হয়েছে তারা আর কি করবে? বড়জোর একটা কামড় দিবে? হ্যাঁ দিচ্ছেও তাই।
জানতে পারলাম, এসব `পাগলা কুকুর`দের নাকি অনলাইন বাজারে ছেড়েছে ডিজিআইএফ এর নেতৃত্বে, এরা নাকি আবার ট্রেনিং এবং কারাগরি সহায়তা নিচ্ছে ভারতের মুম্বাই ভিত্তিক ফেসবুক ফেরিফাইড বুম নামের কোনও অখ্যাত টাউট দলের। এরা ফেসবুকে ভুয়া নাম ও ছবি ব্যবহার করে আইডি খোলে। তারপর যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লিখে মানুষকে সচেতন করতে চায়, তাদের ফলোয়ার হয়। এরপর তাদের পোস্টকৃত লেখাগুলোতে এসে সরকারের পক্ষে কমেন্ট করে, অশ্লীল গালিগালাজ করে।
এইসব জিপিএ-পাইপওয়ালা পাগলা-কুকুরগুলির বিশ্বাস, এইসব সভ্য ও ভদ্রলোকদের যদি অশ্লীল গালি দেয়া যায় তাহলে তারা লজ্জায় আর ফ্যাসিবাদ বিরোধী কিছু লিখবে না। থেমে যাবে। আসলে কুকুর তো কামড় ছাড়া কিছুই জানে না, কী আর করবে! অথচ এই পাগলা-কুকুরগুলি জানেই না যে, ওসব ফেইক-আইডিগুলো যাস্ট একটি ক্লিকের রিপোর্ট করে বন্ধ করে দেয়া যায় (আমি এরই মধ্যে এক মাসে এরকম প্রায় দুশো ফেইক আইডি রিপোর্ট করে বন্ধ করিয়ে দিয়েছি)।
এরা যে কমেন্টগুলি করে, সেগুলি আপনি যদি একটু মনোযোগ দিয়ে পড়েন তাহলে নিজেই লজ্জা পাবেন যে, বাংলাদেশের এসব `সরকারি অনলাইন কুকুর বাহিনীর` যোগ্যতা নিয়ে। যারা না দিতে পারে কোনও যুক্তি, না পারে যুক্তি খণ্ডাতে, আর না জানে দু`লাইন ক্রিয়েটিভ কিছু লিখতে। আসলে কোটায় বা ঘুষ দিয়ে নিয়োগপত্র পেয়েছে তো জিপিএ-পাইপ সার্টিফিকেটের কল্যাণে। কিন্তু ওসব দিয়ে যে দু-লাইন লেখার যোগ্যতা অর্জিত হয় না, সেটা ওদের কে বুঝাবে!
যাই হোক, আরও মজার বিষয় আছে। এরা আবার ফেইক আইডিও তৈরি করে। আমার নামেও তৈরি করেছিল যা আমি তৈরির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রিমোভ করিয়ে দিতে পেরেছি। আমার বেশ কয়েকজন শুভাকাঙ্খীকে ওই ফেইক আইডি দিয়ে তারা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। তারা আমাকে ইনফর্ম করে। আর আমিও ফেবু কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করে দিলে সেটা রিমোভ হয়ে যায়।
সরকারি ওসব ছিচকে জিপিএ-পাইপ গোয়েন্দাদের বলছি, আপনাদের যোগ্যতায় কুলাবে না যে আমাদের সঙ্গে পেরে উঠবেন। আমাদের সঙ্গে টেক্কা দেবার মতো মেধা, বুদ্ধি, যোগ্যতা, দক্ষতা আর ক্রিয়েটিভিটির ধারে-কাছেও আপনারা ভিড়তে পারবেন না। আমাদের কাছে ভিড়তে হলে `এক্সট্রা অর্ডিনারি ব্রেন` দরকার হয়; জিপিএ-পাইপ সার্টিফিকেট দিয়ে এসব হয় না। আপনাদের হাতে একটি বন্দুক আছে বিধায় দেশের মানুষ আপনাদের ভয় পেয়ে কিছু বলে না, মুখ বন্ধ রাখে।
আমাদের মুখ বন্ধ করার যোগ্যতা, মেধা, দক্ষতা, শিক্ষা বা ক্ষমতা কোনোটাই আপনারা রাখেন না। সেই মেধাই তো আপনাদের নেই। পারবেন কিভাবে? দেশের মানুষের টাকা-পয়সা লুটেপুটে খাচ্ছেন, খেতে থাকেন। সময় আসবে, আপনাদেরও চিনে রাখা হচ্ছে, সামনে একদিন দাঁড়াতেই হবে। সে দিন কি করবেন?
তারচে বরং সুসভ্য হোন। ফ্যাসিস্টের দালালি না করে, দেশের মানুষের দালালি করুন, যাদের টাকায় নিজে স্ত্রী-সন্তানদের তিনবেলা খাবার কিনে খাওয়াচ্ছেন তাদের প্রতি দায়িত্ববান হোন।
মনের জানালা বিভাগটি পাঠকের মতপ্রকাশের খোলা একটি প্ল্যাটফর্ম। যে কেউ যে কোনো যৌক্তিত মত এখানে লিখতে পারে। এজন্য ছাড়পত্র কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। মতামতের দায় সম্পূর্ণ লেখকের।
























