শিমুল বাশার

শিমুল বাশার

আমি আমার বুকের কাছে একলা হয়ে কাঁদি

শিমুল বাশার

প্রকাশিত : জুলাই ১৪, ২০২০

জল আর সবুজে ঘেরা অপরূপ এক ভূখণ্ডের নাম দোহার। আমার জন্মস্থান। আমার শৈশব, কৈশোর সেখানেই। যৌথ পরিবার প্রথার যে কয়েকটা উদাহরণ এখনো টিকে আছে তার একটা আমাদের। বহুদিন পর বাড়িতে গেলাম। মাকে জড়ায়ে ধরলাম। কিচেনে ঢুকলাম... রীতিমতো একটা রান্নার আসর! সেখানে নানারকম আয়োজন! এককোণে এক হাঁড়ি ডিম সেদ্ধও আছে। দেখে যে কারো মনে হতে পারে, এখানে বুঝি ডিম সেদ্ধ বিক্রি চলছে।

এত ডিম কেন?
ভাবি জানালো, সবার জন্য একটা করে হিসাব করে দ্যাখো কয়টা লাগবে। তো আমি কয়েকবার চেষ্টা করেও পরিবারের সঠিক মেম্বার সংখ্যা কত কাউন্ট করতে পারলাম না। প্রতিবারই কেউ না কেউ কাউন্টিং থেকে বাদ পড়ে যায়।

বাবার মৃত্যুর পর মেঝো ভাই পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন মেঝো ভাই যা সিদ্ধান্ত নেন অন্যরা তা খুশি মনেই মেনে চলে। বাবা তার জীবনের শেষদিনটি পর্যন্ত পরিবারের জন্য বাজার করেছেন। এখন মেঝো ভাই বাবার মতোই খুব ভোরে নাস্তার টেবিলে বসে ভাবিদের সাথে বাজার সদাইয়ের পরামর্শ করেন, ছোটদের কাছে জানতে চান কে কী খাবে। আগের মতো এখন আর এক ফটোফ্রেমে জায়গা হয় না। এবার দেখলাম ভাইয়েরা, ভাবিরা, ভাতিজা এবং ভাতিজিরা আলাদা করে ফটো তোলার জন্য দাঁড়াচ্ছে।

সন্ধ্যায় নানা পদের পিঠা তৈরির আয়োজন হলো... মুকশাল্লা, পাটিসাপটা, নারকেল পাক্কন, নকশি পিঠাসহ কত পদ... সবগুলোর নামও জানি না। তবে আপার তৈরি করা পিঠাগুলো বেস্ট ছিল, মুচমুচে। আপা আমার ওপর খুব রেগে আছেন। কারণ আমি নাকি এক লেখায় বলেছি আপার রান্না ভালো না। আমাকে পেয়ে আড়ালে ডেকে কিছুটা অভিমান নিয়েই জানতে চাইলো, কেন আমি সব সময় শুধু খারাপটাই লিখি, ভালোটা কি চোখে পড়ে না?
বললাম, ভালো ভালো লিখলে কি আজকের পিঠাটা আরো ভালো হইতো?

আপার ছোট ছেলে এনাম হেব্বি সুন্দর একটা মটরসাইকেল কিনেছে। আমি সবাইকে ডেকে বললাম, আয় আমরা সবাই এই মটরসাইকেলের খুঁত খুঁজে বের করি এবং এমনসব নিন্দা করতে থাকি যেন ও মনে মনে এটা কিনে যে বিরাট ঠকা ঠকছে সারাদিন এই হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে।

কবির ভাই গাড়ি নিয়া আসছে। সে বললো, ২০২০ সালেই হ্যারিয়ারের চেয়েও দামি গাড়ি কিনবে। দশ বছরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার স্বপ্ন তার। সে আমাকে জানালো, স্বপ্ন দেখতে না জানলে হাঁটার পথ পাওয়া যায় না, অবশেষে জীবন স্থবির হয়ে পড়ে।

নয়া ভাইকে জানালাম, গণমাধ্যমের অবস্থা এখন ভালো না। সে আমাকে আশ্বস্ত করে বললো, এই যে পুকুরের পাড় ঘিরে ২০-৩০টা দোকান করা যাবে। অনেক ভাড়া পাওয়া যাবে, তুই নিস। বড় ভাইয়ের ফ্ল্যাট আছে সেটাও তরে দিবে বলছে, তুই শুধু আইসোলেটেড থাকিস না।

চারদিকে কত আশা, কত স্বপ্ন ছড়ায়ে আছে অথচ আমার শুধু একলা লাগে, ভীষণ একলা! আমি আমার বুকের কাছে একলা হয়ে কাঁদি। এ জীবন কেন এমন!

দোতলায় যে রুমটাতে বাবা থাকতেন আমার জন্য সেই রুম বরাদ্দ করা হয়েছে। সেই রুমের লাগোয়া বারান্দা হতে বকুলদের বাড়ির ঘন ছায়াবিথী দেখা যায়। বকুলের বাবা বানত আলী একজন মরমী ফোক শিল্পী ছিলেন। প্রতি বছর ও বাড়িতে বড় গানের আসর বসতো। দূর- দূরান্ত থেকে তখন শত শত মানুষ আসতো। ওসব দিনে ছোট্ট আমি সারাদিন ও বাড়িতেই বকুল, ছানা, মুক্তি ও মামুনদের সাথে খেলতাম। বকুলের বাবা বানত আলী নিবিড় মনে কাঠ দিয়ে নিখুঁত মাক্কু বানাতেন আর গুনগুনিয়ে গান গাইতেন। আমি আর বকুল সেই গানের সুরে সুরে হারায়ে যেতাম আর্মেনিয়ান কবরের পাশের ঝাড় জঙ্গলের ভেতর। গোরা লেবু বনে ঢুকে আমারা স্থলপদ্ম কবে ফুটবে এ নিয়ে গল্প করতাম। গোসাইবাড়ির মাজারের এককোনে হাজারি গোলাপের গাছ তারপাশে যষ্টিমধু। বকুল আমাকে সেই মধুর সন্ধান দিতো। ওর ছোট ভাই কিরণ তার বাবার স্বভাব পেয়েছে। এখন ওই বাড়িতে কিরণ গান করে
বকুল ফুল বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত
কেনে বান্ধাইলি?

দোহারে গেলে আমি শৈশব আক্রান্ত হয়ে যাই। অথচ সেখানে কিছুই আর আগের মতো নাই। গান্ধীজি যেমন আমাদের এ গ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন, নিজেকেও তেমন দূরের কেউ মনে হয়। বকুল এখন শ্বশুরবাড়িতে। চা খাবার দাওয়াত আর আসছে না। চারপাশ কেমন পাল্টে যায় আর আমি বারান্দায় বসে বসে শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়ি...

মনের মধ্যে ভাবনাগুলো ধুলোর মতো ছোটে
যে কথাটা বলবো সেটা কাঁপতে থাকে ঠোঁটে
বলা হয় না কিছু—
আকাশ যেন নামতে থাকে নিচুর থেকে নিচু
মুখ ঢেকে দেয় মুখ ঢেকে দেয়, বলা হয় না কিছু।

মস্ত বড়ো অন্ধকারে স্বপ্ন দিল ডুব—
বেঁচে থাকব সুখে থাকব সে কি কঠিন খুব?

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী