আমি শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষে অধিকার কেবলই আমার

ফাতিহুল কাদির সম্রাট

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৫, ২০১৯

ব্রেইনে স্ট্রোকে আক্রান্ত বোনকে দেখে বাসায় ফিরছি। গাড়িতে বসে জ্যামের বিরক্তি কাটাতে ফেবুতে ঢুকে জুনিয়র সহকর্মী জাকিয়ার একটি স্ট্যাটাসে নজর পড়ল। সেই স্ট্যাটাসের সূত্রে জাকিয়াকে উদ্দেশ্য করে কতিপয় মানুষের মন্তব্য আমাকে ভীষণভাবে কষ্ট দিল। কাকতালীয় হলো, হাসপাতালে শায়িত আমার বোনটির নামও জাকিয়া। দুই জাকিয়ার কষ্ট ভাই হিসেবে আমার জন্যে বাড়তি চাপ তৈরি করল।

জাকিয়া ২২ বিসিএস-এর কর্মকর্তা, তিনি ইংরেজি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক। তিনি খাড়া মেরুদণ্ডের মানুষ। পরীক্ষাকে নকলমুক্ত রাখতে জাকিয়া সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন, কিন্তু ভয় পাননি। নৈতিক শক্তির কারণে তিনি কথাও বলেন সোজাসাপ্টা। কথাটা কার বিরুদ্ধে গেল সেটা তিনি দেখেন না, দেখেন কথার পেছনে যুক্তি ও সততার ভিত্তি। সে জন্যে তিনি নিজ পেশাতেও অনেকের অপ্রিয়ভাজন। এমন অপ্রিয় হবার জন্যে যে শক্তির দরকার, সেটার জন্যেই জাকিয়া আমার প্রিয়।

‘প্রথম আলো’ পত্রিকা ঠাকুরগাঁওয়ের ডিসি সাহেবকে নিয়ে একটি রিপোর্ট করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ডিসি সাহেব সুযোগ পেলেই রসায়নের ক্লাস নেন। শিক্ষার প্রতি ডিসি সাহেবের অনুরাগকে এখানে এপ্রিশিয়েট করা হয়েছে। জাকিয়া এই খবরটিকে সাংবাদিকের অতি উৎসাহের প্রমাণ হিসেবে দেখেছেন। তার লেখায় বোঝা যায়, একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হিসেবে তিনি খানিকটা বিব্রতবোধ করেছেন ওই খবরে। ডিসি সাহেবের এই শ্রেণি কার্যক্রম অন্যের পেশায় নাক গলানোর মতো মনে হয়েছে তার কাছে। তিনি একে স্টান্ট মনে করেছেন। একই সাথে তিনি প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজে মনোযোগ নিবদ্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি এ-ও বলেছেন যে, একদিন যদি তার ডিসিগিরি করার ইচ্ছে হয় তাহলে তাকে কেউ সেই সুযোগ নিশ্চয়ই দেবে না।

প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য যারা স্ট্যাটাসটি দেখেছেন, স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো তাদের মনোপুত হয়নি। তারা নাখোশি ভাব প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন। আবার শিক্ষা ক্যাডারের কেউ কেউ জাকিয়ার কথাকে বাহবা দিয়েছেন। এর মধ্যে যার মন্তব্য আমার কাছে খুব আক্রমণাত্মক ও আপত্তিকর মনে হয়েছে তার টাইম লাইনে ঢুকে দেখলাম, তিনি একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। আমি সততার খাতিরে বলছি, জাকিয়ার বক্তব্যের ভাষিক উপস্থাপনাটা আরেকটু নমনীয় হলে আমি খুশি হতাম। আমরা সরকারি কর্মচারী, সর্বোপরি সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিতশ্রেণি। আমাদের রুচি ও সাংস্কৃতিক স্বরূপটি সাধারণ মানের হলে চলে না। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, জাকিয়ার মতো শিক্ষকদের হৃদয়ে বঞ্চনা ও উপেক্ষাজনিত ক্ষোভের একটি গুমোট পুঞ্জ বিদ্যমান।

ওই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তার সিনিয়র ও মহিলা কর্মকর্তাকে আপত্তিকর ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তিনি একজনের মন্তব্যের বরাতে মন্তব্য করেছেন, ‘তুমি কত ব্যাচের? ২২ ব্যাচের মাস্টার বোঝ, জেলা প্রশাসক বুঝতে এত কষ্ট কেন? পণ্ডিতের দল।’ আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে, কারণ এই টিএনওরা আমাদেরই ছাত্র। আমরা তাদের চাকরি পাবার যোগ্য করেছি, কিন্তু ভদ্র ও রুচিশীল মানুষ বানাতে পারিনি। আমি আশা করব, ইউএনও সাহেব তার সন্তানদের কোনো তুচ্ছ মাস্টার বা পণ্ডিতের কাছে পাঠাবেন না।

একজনের মন্তব্য থেকে জানা গেল, জেলা প্রশাসক সাহেব ঢাবি থেকে ফলিত রসায়ন বিষয়ে পাস করেছেন ভালো ফলসহ। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। পিএইচডি গবেষণার সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারও দিয়েছেন। মন্তব্যকারী এ-ও বলেছেন যে, তার এই ক্লাস নেয়া শিক্ষার জন্যে ইতিবাচক। আমি শিক্ষানুরাগের জন্যে সেই জেলা প্রশাসক সাহেবকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। অন্তর্গত টান থেকে তিনি যেভাবে চক-ডাস্টার হাতে তুলে নিচ্ছেন সেটাকেও সাধুবাদ দিতে চাই। কিন্তু শ্রেণিকক্ষের একজন নিবেদিত শিক্ষক হিসেবে আমাকে যদি বলা হয় যে, আমার ক্লাসের সময় সেই ডিসি সাহেব ক্লাস নেবেন, তাহলে আমি খুব স্বস্তিবোধ করব না। আমার কাছে মনে হবে, পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে তিনি তাচ্ছিল্য করছেন। আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছে আমাকে হেয় করারই নামান্তর মনে করব সেটাকে। আমার ক্লাস চলাকালে আমার অধ্যক্ষ কখনো কখনো ক্লাসে ঢুকেন, নানা কথা বলেন। আমার কাছে খুব ভালো লাগে না বিষয়টি। শ্রেণিকক্ষে ক্লাস চলাকালে আমি সেই ক্লাসের সেনাপতি, নিয়ন্ত্রক ও মেন্টর। আমি একটি নির্দিষ্ট বিষয় মাথায় নিয়ে ক্লাসে ঢুকি। আমার একটি মানসিক প্রস্তুতি থাকে। সেখানে বাগড়া দিলে আমার খুব ভালো লাগার কোনো কারণ নেই।

আমি ব্যক্তিগতভাবে জীবনসংগ্রামে জয়ী, ঋদ্ধ ও সৃজনশীল মানুষদের আমার ছাত্রছাত্রীদের সামনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করি। আমি মনে করি, শিক্ষার্থীদের জীবনবোধ ও চেতনার ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে এরূপ ব্যক্তিদের সহায়তা নেওয়া উচিত। মোটিভেটর হিসেবে সেই ডিসি সাহেবও ভূমিকা রাখতে পারেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদের স্বপ্ন দেখাতে পারেন তার মতো জায়গায় যেতে। তিনি নিজের জীবনের কাহিনি শুনিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে প্রতিষ্ঠা লাভের আকাঙ্ক্ষা ও প্রেরণা জাগিয়ে তুলতে পারেন। কিন্তু নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রমের মতো বিষয়ভিত্তিক কোনো ক্লাস কেউ নিতে গেলে সেটাকে আমি মোটেই উৎসাহিত করব না। ডিসি সাহেব জেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে যদি ছাত্রদের মোটিভেট করেন আমি তাকে স্যালুট করব, কিন্তু তার রসায়ন পড়ানোটা আমার কাছে স্বস্তিকর মনে হবে না।

হুটহাট শিক্ষক বহির্ভূত কারো ক্লাস নেয়াটা ছাত্রদের জন্যেও খুব কল্যাণকর নয়। ধরে নিলাম, ডিসি সাহেব বা তার মতো অন্য কেউ ক্লাসে ঢুকে কোনো টপিক পড়ালেন। তার বিষয়জ্ঞান ও উপস্থাপন দক্ষতা অনেক ভালো। কিন্তু তিনি তো নিয়মিত ক্লাস নেবেন না। এই হঠাৎ ঝলক ছাত্রছাত্রীদের চোখে বিদ্যুচ্চমকের মতো ঘোর সৃষ্টি করবে। ঘোর লাগা চোখে নিজের শিক্ষককে সে দেখতে পাবে অনেক ছোট আকারে। মিষ্টি খাওয়ার পর সবকিছু যেমন পানসে পানসে মনে হয় তেমনি শ্রেণিশিক্ষকের পড়ানো তাদের কাছে মনে হবে পানসে। আবার ওই হঠাৎ শিক্ষকের ক্লাস যদি ছাত্রছাত্রীদের না টানে তাহলে বড় মানুষ সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হতে বাধ্য। ডিসি সাহেবদের মতো মানুষদের এই ক্লাসবিলাসকে আমি কিছুতেই শিক্ষকতাপ্রীতি বলতে নারাজ। শিক্ষকতা যদি এতই ভালো লাগে তাহলে তিনি বা তারা অন্য পেশায় গেলেন কেন?

প্রতি বছর শিক্ষা ক্যাডার থেকে অন্য ক্যাডারে চলে যান অনেকে। শিক্ষা ক্যাডারত্যাগী অনেকের সাথে আমাদের দেখা হয়। তারা বেশ আত্মশ্লাঘা নিয়ে জানান, তিনি কোন ব্যাচে শিক্ষা ক্যাডারে ছিলেন, কোন ব্যাচে ক্যাডার পাল্টিয়েছেন এসব। আবার অনেকে শিক্ষকতার প্রতি মুগ্ধতার কথা বলেন। আমার কাছে এটাকে মনে হয় চরম ভণ্ডামি। ব্যাপারটা এমন যে, কোনো একজন নারী পরকীয়ায় মেতে স্বামী-সন্তান ফেলে চলে যাবার পর সেই স্বামী-সন্তানের প্রতি ভালোবাসায় গদো গদো ভাব দেখাচ্ছে। এমন ভালোবাসা ভালোবাসা নয়, ভালোবাসার কলংক।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই কলা অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন অনার্স ও মাস্টার্সে। তিনি সুপরিচিত কবিও। ঢাবিতে শিক্ষক হিসেবে জয়েনও করেছিলেন। মেধা, যোগ্যতা ও সৃজনশীলতায় তিনি ছিলেন উজ্জ্বল। কিন্তু তিনি বিসিএস দিয়ে ক্যাডার সার্ভিসে চলে যান। তিনি যদি আমার কলেজে আমার ক্লাসে গিয়ে শিক্ষকতার ঝলক দেখাতে চান তাহলে আমি কী করব? আমি তাকে সোজাসাপ্টা বলে দেব, শ্রেণিকক্ষে আপনার কোনো অধিকার নেই। রাখেন আপনার শিক্ষাপ্রেম। আপনার প্রেম কিসে সেটা আমি জানি। ঢাবি ছেড়েছেন এখন এসেছেন মফঃস্বলের এক কলেজে। রাখেন আপনার স্টান্টবাজি, আমার কাজ আমাকে করতে দেন। আমি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলতে চাই, আমার সেই সিনিয়র ভাই যতই মেধাবী হোন, আমার চেয়ে কার্যকর ক্লাস নিতে সক্ষম হবেন না। কারণ শিক্ষা একটি ধারাবাহিক ও পদ্ধতিগত বিষয়। শিক্ষায় আপডেইট থাকাটা জরুরি। ক্ষণিকের রোমাঞ্চ বা ফ্যান্টাসি আর যাই হোক শিক্ষকতা নয়। নিরবচ্ছিন্ন সাধনা ছাড়া শিক্ষক হওয়া যায় না। কাজেই জাকিয়া কি সত্যি ভুল কিছু বলেছেন?

আমাদের দেশে সাংবাদিকতা পেশাদারিত্বশূন্য। নইলে ডিসি সাহেবের ক্লাস নেয়া নিয়ে এতবড় নিউজ হত না। আমার ধারণা, ডিসি সাহেব নিজেও এমন নিউজের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। কিছু দিন আগে একজন টিএনও ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলে সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন। ৩ আগস্ট ‘ইউএনও সাহেবের কপাল, আমার নিয়তি’ শিরোনামে এ নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। সেই কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি আর করতে চাই না। সংবাদপত্রের এই আদিখ্যেতা দেশের জন্যে মোটেই কল্যাণকর নয়। শখের বশে বা ভালোলাগার টানে কতজনই তো কতকিছু করেন। সব তো খবর হয় না।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, শিক্ষকদের অনেক দুর্বলতা আছে, শিক্ষকতা পেশা তার ব্রতচেতনা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে, কিন্তু জাতি আজ যেখানে এসেছে তা শিক্ষার হাত ধরেই। শিক্ষার রূপকার, জাতিগঠনের কারিগর শিক্ষক ছাড়া আর কেউ নয়। শিক্ষার উন্নয়নে তথা জাতীয় উন্নয়নের প্রয়োজনে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আসা প্রয়োজন। কিন্তু যেসব মেধাবী শিক্ষকতায় না এসে অন্য পেশায় গিয়ে শিক্ষকতার প্রতি মৌসুমি ভালোবাসা প্রদর্শন করবেন তারা আমাদের মনে কোনো অনুরাগ জাগাতে পারবেন না। আমরা যারা একনিষ্ঠ শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে কেবল তাদেরই অধিকার, তাদেরই রাজত্ব। শ্রেণিকক্ষ দেউড়ি ও বেড়াবিহীন কোনো সলিমুদ্দিনের বাড়ি নয়, যেখানে গলা খাকারি ছাড়াই যে কেউ যখন-তখন ঢুকে যেতে পারে। আমি গলা ছেড়ে বলব, আমি শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষে অধিকার কেবলই আমার।