আল্লাহর প্রজ্ঞা এবং মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য

ছায়াবীথি শ্যামলিমা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৪, ২০২১

আল্লাহ হিকমত বা প্রজ্ঞার গুণে গুণান্বিত। তাঁর মহান নামের মধ্যে রয়েছে আল-হাকিম বা প্রজ্ঞাবান। জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ কোনো কিছু অনর্থক সৃষ্টি করেননি। বরং তিনি অনর্থক কোনো কিছু করা থেকে পবিত্র। তিনি মহান হিকমত ও সার্বিক কল্যাণের ভিত্তিতে সৃষ্টি করে থাকেন। এ হেকমত কেউ জানে, কেউ জানে না। কুরআনে বলা হয়েছে, তোমরা কি মনে করো আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি? তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে? সত্যিকার বাদশা আল্লাহ মহান হন। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই; যিনি মহান আরশের অধিপতি।

আল্লাহ আরো বলেন, “আসমান ও জমিন এবং এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে, সেসব আমি তামাশা করে সৃষ্টি করিনি। আমি ও দুটিকে যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। আল্লাহ আরো বলেন, হা-মীম। এই কিতাব পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। নভোমণ্ডল, ভূ-মণ্ডল ও এ দুয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু আমি যথাযথভাবেই এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্যেই সৃষ্টি করেছি। কাফেরদেরকে যে বিষয়ে সাবধান করা হয়েছে তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

মানুষ সৃষ্টির হেকমত শরয়ি দলিল দ্বারা যেমন সাব্যস্ত তেমনি যৌক্তিকভাবে সাব্যস্ত। সুতরাং যে কোনো বিবেকবান মানুষ এটি মানতে বাধ্য যে, সবকিছু বিশেষ হেকমতের প্রেক্ষিতে সৃষ্টি করা হয়েছে। বিবেকবান মানুষ ব্যক্তিগত জীবনেও কোনো কিছু কারণ ছাড়া করা থেকে নিজের পবিত্রতা ঘোষণা করে। সুতরাং মহান প্রজ্ঞাবান আল্লাহর ক্ষেত্রে আমরা কি ভাবতে পারি? আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় আসমান ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্যে। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে। (তারা বলে) পরওয়ারদেগার, এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করোনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদেরকে তুমি দোজখের শাস্তি থেকে বাঁচাও।

শাইখ আব্দুর সাদি (রহ.) বলেন, আল্লাহ আসমান ও জমিনকে ন্যায্যভাবে, ন্যায়ের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তিনি এ দুটি সৃষ্টি করে বান্দাকে তাঁর মহান জ্ঞান, ক্ষমতা ও অবাধ পরাক্রমশালিতা জানাতে চেয়েছেন। জানাতে চেয়েছেন যে, তিনিই একমাত্র মাবুদ বা উপাসনার যোগ্য, যারা আসমান-জমিনের একটি বিন্দুও সৃষ্টি করেনি তারা উপাসনার যোগ্য নয়। আরো জানাতে চেয়েছেন, পুনরুত্থান দিবস অনিবার্য। অচিরেই আল্লাহ সৎ ও অসৎ মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবেন। আল্লাহর হেকমত সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তি যেন মনে না করে যে, আল্লাহ উভয়ের সাথে সমান আচরণ করবেন। আল্লাহ ঘোষণা করেন, যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে আমি কি তাদেরকে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের সমতুল্য গণ্য করব? নাকি আমি মুত্তাকিদেরকে পাপাচারীদের সমান গণ্য করব?

চতুষ্পদ জন্তুর মতো শুধু পানাহার ও বংশবৃদ্ধির জন্য আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেননি। আল্লাহ মানুষকে সম্মানিত করেছেন। অনেক সৃষ্টির উপর আল্লাহ মানুষকে মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কুফরিকে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং যে মহান উদ্দেশ্যে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেটাকে তারা বেমালুম ভুলে গেছে বা অস্বীকার করেছে। তাদের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে, দুনিয়াকে উপভোগ করা। এদের জীবন চতুষ্পদ জন্তুর জীবনের মতো। বরং তারা চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও অধম। আল্লাহ বলেন, যারা কুফরি করে তারা ভোগবিলাসে মত্ত থাকে আর আহার করে যেভাবে আহার করে চতুষ্পদ জন্তু জানোয়াররা। তিনি আরো বলেন, ছেড়ে দাও ওদেরকে, ওরা খেতে থাক আর ভোগ করতে থাক, আর (মিথ্যে) আশা ওদেরকে উদাসীনতায় ডুবিয়ে রাখুক, শীঘ্রই ওরা (ওদের আমলের পরিণতি) জানতে পারবে।

কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা দেন, আমি বহু সংখ্যক জ্বীন আর মানুষকে দোযখের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাদের অন্তর আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে কিন্তু তা দিয়ে শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারা একেবারে বে-খবর।

বিবেকবান মানুষ জানে, যে ব্যক্তি কোনো কিছু তৈরি করেন তিনি এর হেকমত সম্পর্কে অন্যের তুলনায় ভালো জানেন। আর আল্লাহর জন্য উত্তম উদাহরণ প্রযোজ্য, যেহেতু তিনিই মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষ সৃষ্টির হেকমত সম্পর্কে তিনিই ভালো জানবেন। দুনিয়াবি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটা যে সঠিক, এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। মানুষ নিশ্চিত যে, তার বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশেষ একটা হেকমত বা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। চক্ষু সৃষ্টি করা হয়েছে দেখার জন্য। কান সৃষ্টি করা হয়েছে শুনার জন্য।

এটি কি যুক্তিসঙ্গত যে, মানুষের প্রত্যেকটি অঙ্গ বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে আর মানবসত্তাকে অনর্থক সৃষ্টি করা হয়েছে? অথবা যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন তিনি যখন তাকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন তখন সে সেটা গ্রহণ করতে নারাজ?

আল্লাহ ঘোষণা করেন, তিনি আসমান-জমিন, জীবন-মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য। কে তাঁর আনুগত্য করে যাতে তাকে পুরস্কৃত করতে পারেন; আর কে তাঁর অবাধ্য হয় যাতে তাকে শাস্তি দিতে পারেন। তিনি বলেন, যিনি সৃষ্টি করেছেন জীবন ও মৃত্যু যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন আমলের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি মহা শক্তিধর, অতি ক্ষমাশীল।

এ পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহর নাম ও গুণাবলির প্রভাব ফুটে উঠে। যেমন:  আল রহমান, আল গফুর, আল হাকিম, আল তাওয়াব, আল রহিম ইত্যাদি আল্লাহর গুণবাচক নাম।

সবচেয়ে যে মহান উদ্দেশ্য ও মহা পরীক্ষার জন্য মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে সেটা হচ্ছে, তাওহীদ বা নিরংকুশভাবে এক আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশ প্রদান করা। আল্লাহ নিজেই মানুষ সৃষ্টির এ উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন, আমি জিন ও মানবকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র এ কারণে যে, তারা আমারই ইবাদাত করবে।

শাইখ আব্দুর রহমান আল সাদি (রহ.) বলেন, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য, তাঁর নাম ও গুণাবলির মাধ্যমে তাঁকে চেনার জন্য এবং তিনি মানুষকে এ নির্দেশই দিয়েছেন। যে ব্যক্তি তাঁর প্রতি আনুগত্যশীল হবে এবং নির্দেশ পালন করবে সে সফলকাম। আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিবে সে ক্ষতিগ্রস্ত। তাদেরকে এমনস্থানে সম্মিলিত করা অনিবার্য যেখানে তিনি তাদেরকে তার আদেশ-নিষেধ পালনের ভিত্তিতে প্রতিদান দিতে পারবেন।

মুশরিকদের প্রতিদানকে অস্বীকার করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, যদি আপনি তাদেরকে বলেন, নিশ্চয় তোমাদেরকে মৃত্যুর পরে জীবিত ওঠানো হবে, তখন কাফেররা বলে, এটা তো স্পষ্ট জাদু।

মানে, মুহাম্মদ (স.) যদি কাফিরদেরকে মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানের ব্যাপারে সংবাদ দেন তাহলে অবিশ্বাসীরা তাঁকে বিশ্বাস করবে না। বরং তারা রাসুলের ওপর মিথ্যার দোষারোপ করবে এবং অপবাদ দেবে।