আশরাফ রোকনের গদ্য ‘শৈশবের ইফতার’

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৬, ২০২০

শৈশবের গাঁয়ে মানুষে মানুষে যে সম্প্রীতি বন্ধন দেখতাম তার ছিটেফোঁটাটাও আজ আর অবশিষ্ট নেই। থাকবেই বা কেমন করে! এতদিনে অশিক্ষা, দারিদ্র্য, ক্ষুধার অভিশাপে পৃথিবীর পেট ক্রমে ফুলেফেঁপে ওঠেছে। তদুপরি বৈশ্বিক রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধংদেহি মনোভাব, সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার বেড়াজালে ক্রমে আবদ্ধ আজ স্বাধীন, মুক্তিকামী, উৎসবমুখর মানুষেরা প্রতিমুহূর্তে চরম অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠার সন্মুখীন। বুর্জোয়া বিশ্বনীতি মানুষকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, আর এ কোণঠাসা অবস্থাটা মানুষের সমাজে তৈরি করেছে নানা ভাঙনের, অস্বস্তির। এ ভাঙন আর অস্বস্তির কারণে দিনে দিনে মানুষ হতাশায় বিমূঢ় হয়ে বেছে নিচ্ছে আত্মকেন্দ্রিক জীবন। মানুষ দিন দিন একা হয়ে যাচ্ছে, নির্ভরতা হারিয়ে আস্থাহীন, আনন্দহীন জীবনের পরাকাষ্ঠা তাই আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি নাগরিক।

অনিশ্চয়তার বিষবাষ্পে প্রতিদিন মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। বিশেষত সমাজের খেটে খাওয়া মানুষেরা, পুঁজির কাছেই যাদের মাথা বিক্রি হয়ে গেছে, সেসব মানুষেরা যারা সারাজীবন ধরে গাধার মতো পরিশ্রম করে ফসল ফলায়, কারখানা চালায়, যানবাহনের চাকা ঘোরায়, যেসব মানুষেরা সারাজীবন অন্যের ঘানি টানে, সেসব মানুষদেরই অধিকার, ন্যায্য পাওনার অংশে বড় হওয়া সমাজের উঁচুপতিদের পুঁজির, লোভের ঘৃণ্য লালসার বলি সহস্র কোটি মানুষ এখন জীবনের মানে খুঁজে পায় না, তারা নতুন জীবন খুঁজে পাবার বাসনা থেকেও বহু দূরে। শৈশবের গাঁয়ে বিকেলে চাঁদ দেখার একটা আনন্দ ছিল। গোধূলির সোনালি আলোয় আকাশে যখন এক ফালি সাদা চাঁদ উঁকি দিতো, হৈ হল্লায় ভরে যেত পথঘাট। চাঁদ দেখা যায়... চাঁদ দেখা যায় শব্দের ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠতো শিশুদের দল।

কারা আগে চাঁদ দেখেছে সে তর্ক জুড়ে তখন কতই না যুদ্ধজয়ের আনন্দ! আজ আর দলবেঁধে কেউ চাঁদ দেখে না, তর্ক জোড়ে না! এখন আর কেউ বিকেলের মাঠের মুক্ত, খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আকাশে চাঁদ খোঁজে না! টিভিতে, মোবাইলে, কম্পিউটারে এখন রোজার চাঁদের, ঈদের চাঁদের কারেন্ট আপলোড পাওয়া যায়! ফলে, মাঠের পাড়ে দাঁড়িয়ে হল্লা করে চাঁদ দেখার দিন মনে হয় ফুরিয়েই এলো! এছাড়া এখন বাসার ছাদে ওঠলেই চাঁদ দেখা যায়, যে যার বাসার ছাদে বসেই যে যার মতো চাঁদ দেখে নিতে পারে; যার যার নিজের চাঁদ! সারাদিন রোজা রেখে সন্ধ্যার ইফতারে শরিকের আনন্দটাও ছিল অন্যরকম প্রশান্তিতে ভরা! যেমন পরিবারের রোজাদার ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, তেমনি আমাদের মতো শিশুরা যারা রোজা রাখা তো দূরে থাক রোজার মানেও খুঁজতাম না, তাদের জন্যে ইফতারের মুহূর্তটা ছিল দারুণ উপভোগের!

বাড়ির বড়রা রোজা থাকতো দেখে মাঝে মাঝে বায়না ধরতাম রোজা রাখবো বলে। দাদির আদরের টুকরো ছিলাম বিধায় সেহরির সময় ঘুম ভাঙাতেন। রোজা রাখতে পারবো, বড়দের দলে আমারও আসন হবে, যারপরনাই ভেবে খুশিতে আত্মহারা হতাম। কিন্তু সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই দাদি এসে নানা অজুহাতে আমাকে খাওয়ানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। আমি তবু কিছুই খেতে চাইতাম না। ছোটদের রোজা যে ছোটদের মতোই ছোট হয় সে কথা বুঝিয়ে বলতেন দাদি, মা, চাচিরা। তারা বলতেন `ছোট মানুষের রোজা বেশি বড় নয়, উল্ডিততলায় রোদ পড়লেই হয়ে যায়`, এছাড়া কখনো কখনো রোজা ভাঙবো না বলে শক্ত হয়ে ওঠলে একটা রোজা ভেঙে যে তিনটা রোজা হয়, সে সহজ অংকটা বুঝিয়ে বলতেন দাদি। এক. সেহেরি থেকে সকাল, দুই. সকাল থেকে দুপুর, তিন. দুপুর থেকে সন্ধ্যা— একসঙ্গে তিনটা রোজার সোওয়াব একসাথে পাবার এমন কাল্পনিক সহজ গণিতে শৈশবে আর কেউ না হোক দাদি আমাকে মুগ্ধ করতে পারতেন।

সন্ধ্যায় ইফতারের সময় হয়ে আসার আগে আগে বড় ঘরের বারান্দায় মওল্লা (মুত্তা বেতের তৈরি পাটি বিশেষ) বিছানো হলে জগ, মগ, গ্লাস, বাটি, চামচ, গামলা এনে ধীরে ধীরে জড়ো করতো বড়পা, মেঝোপা। কলপাড়ে ওযু করে আমরা ছোটরাও ধীরে ধীরে এসে ভিড়ে পড়তাম ইফতারের আসরে। পিতামহের চারপাশে জুড়ে বসতাম। দাদিকে দেখতাম সকালবেলায় একটা পেয়ালায় সাদা আল্লুয়া (আতপ) চাল গুড় ও আদার টুকরো দিয়ে ভিজিয়ে রেখে ঢেকে রাখতে। সন্ধ্যার ইফতারের সময় সে পেয়ালাও এসে হাজির হতো যথারীতি। মাগরিবের আজানের ধ্বনি কানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যেত ইফতার। দাদি প্রত্যেকের হাতে হাতে চামচ দিয়ে আদাগুড় মেশানো লোলা (ভেজা, নরম) আতপ চাল সামান্য তুলে দিলেই প্রথম মুখে দেয়া হত— এ পর্যায়টাকে `ইফতার খোলা` বলতে শুনতাম শৈশবে।

ইফতার খোলা হয়ে গেলে ক্রমান্বয়ে খেজুর, কীরা, তরমুজ, বাঙ্গি, বেল, কলা ইত্যাদি (ঋতুভেদে ভিন্ন ভিন্ন) আসতো। মুড়ি-ছোলার প্রচলন তখনো এভাবে আসেনি। তারপর আসতো খিচুড়ি অথবা চুনের জাউ! আজ অবশ্য সে আদাজলেগুড়ে মেশানো আতপ চালও নেই, নেই জাউয়েরও প্রচলন।

লেখক: কবি