আশরাফ রোকনের স্মৃতিগদ্য ‘মানবিকতা এখন শূন্যের কোঠায়’

প্রকাশিত : জুন ২৮, ২০২০

শৈশবের গাঁয়ে ঈদের দিন সকালে দেখতাম ভুলুর মা চাচি আসতেন। মায়ের পাশে গিয়ে বসতেন মিশামিশি হয়ে। একটা কলুইয়ের (কলুই=ধান/চাল/সরষে ইত্যাদি রাখার পাত্র,বাঁশ/বেত দিয়ে তৈরি) লাল গামছা দিয়ে বাঁধা থাকতো। মাকে দেখতাম কলুইয়ে সেরখানেক চাল, কয়েকটা শুকনা মরিচ, গোটাকয়েক পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শুকনো হলুদের টুকরো ইত্যাদি সামান্য পরিমাণে চাচির কলুইয়ে ঢেলে দিতে। চাচি গামছা দিয়ে আবারও মুখ বেঁধে মায়ের সঙ্গে খোশগল্প করে চলে যেতেন।

এভাবে চাচি গাঁয়ের বড় বাড়িগুলিতে যেতেন বিভিন্ন উৎসবের দিনগুলির সকালবেলায়। শুধু ঈদ নয়, বাড়ির কারোর বিয়েশাদিতেও তাদের আসতে দেখতাম। পালকি বা সওয়ারি নিয়ে যখন আসতো তখনও বরাবরের মতো চাল, ডাল, মরিচ, হলুদ দিতে হতো। পালকি/সওয়ারির বাহকদের পারিশ্রমিকের সাথে খাওন-খোরাকিও দেয়া হতো। হয়তো বা প্রথা হয়ে গিয়েছিল আমাদের সমাজে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে। ফলে তারাও সম্পৃক্ত হতেন, অপ্রত্যক্ষ ভাবে হলেও তারা আমাদের স্বজনের তালিকায় থাকতেন।

সকল উৎসবে, আনন্দে আমাদের একটা সামাজিক প্রীতিবন্ধনের ঐতিহ্য ছিল। মানুষের প্রতি মানুষের মনোযোগ, দরদ ছিল; হয়তো-বা মানুষ আজকের চেয়ে কতক অসহায় ছিল বলেই অধিক সহমর্মী ছিল পরস্পর পরস্পরের প্রতি। কিন্তু যখন আজ মানুষেরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে, এখন কেউ আর কারোর ধার ধারতে চায় না। ভাবে হয়তো যে মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আর এ আত্মম্ভরী ধারণার কল্পিত সুখের সায়রে বিসর্জিত মনে হয় আজ দিকে দিকে। মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, সব জায়গায় মানবিকতা শূন্যের দিকে ক্রমধাবমান।

আমাদের শৈশবের স্কুলের পাশেই চাচিদের বাড়ি। চাচিদের মুচি গোত্রের দু`তিনটে পরিবার মাত্র বাস করতো সে বাড়িতে। দফাদার চাচা ছিলেন এ বাড়িতে একজন। রামমোহন চাচা। তার আরও দুই ভাই, ভাতিজা মিলে একটা ছোট্ট বাড়ির পেছনে বালই নদ, বামপাশে খাল, খালের পাশে মাঠ, মাঠের এক কোণে ইমাম বাড়ি, একজন অলির মাজার, এক পাশে আমাদের শৈশবের বিদ্যালয়। প্রাথমিকে পড়ার সময় ওই বাড়িতে যেতাম খাল পাড় হয়ে। ছোট্ট বাড়ির সব ক`টি মাটির ঘরের বেড়ায় আশ্চর্য সব রঙের, গড়নের আল্পনা দেখে মুগ্ধ হতাম।

একটা বড় কুকুর ছিল, কালো। বাঘের মতো গর্জন করতো! আমরা ভয় পাব বলে চাচি এসে পরিচয় করিয়ে দিলে ঘেউ ঘেউ বন্ধ করতো। কতদিন গ্রামে যাই না। জানি না চাচি বেঁচে আছে কি না। জানা নেই এখনো ঈদের সকালে আমাদের বাড়িতে যায় কিনা `সিধা `তুলতে।

লেখক: কবি