আশরাফ রোকনের ৫ কবিতা

প্রকাশিত : মে ১৮, ২০২০

সমুদ্র নিয়ে কবিতা লেখা কঠিন

সমুদ্র নিয়ে কবিতা লিখা কঠিন
কেননা প্রকৃত মানুষ হতে পারিনি বলেই
কোনোদিন হইনি মুখোমুখি একবারও সমুদ্রের
পাড়ে গিয়ে বসে দেখা হয়নি তার উপরের উদার আকাশ
শোনাও হয়নি সুগভীর গর্জন, কুড়ানো হয়নি শঙ্খঝিনুক
লোনাবাতাসে চিরল নারকোল পাতার দূরগামী শিহরণে কেঁপে ওঠা গাঙচিল
কখনও অসীম জলরাশির ক্ষুব্ধ তরঙ্গভঙ্গ, আর
বিদঘুটে যত বিদ্রুপ পরিহাস তটের বালিয়াড়ি, চোরাবালি,
গুপ্ত, চোরাস্রোতে ভেসে না গেলে কবে কার
ইচ্ছে হয়েছে এখানে সমুদ্রকে নিয়ে কবিতা লেখার!

আত্মকুসুম

মননকে বানিয়ে ফেলো না আবদ্ধ কারাগার
বিবেককে দিও না ভাড়া অন্যত্র
হৃদয়কে রেখো না বন্দি অন্ধ কুয়োয় যেখানে নিজের ছায়া পর্যন্ত দেখতে পাও না
সেখানে মনুষ্যত্ব কী করে শিখবে তাহলে এখানে হে জীর্ণ,
বিচলিত চেতনার কাণ্ডে কোথা আর পাবে বলো স্থির সৌন্দর্য বাহার
অমন প্রাণদায়ী সরল বাতাস যা তুমি উপেক্ষা করছো দিব্যজ্ঞানে কোমলমতি শাখায় শাখায়
কচি নরম মোমের মতো ডগার শীর্ষে—সবুজ পাতার অবুঝ দুলুনি ছিঁড়ে কুটিকুটি করছো অস্তিত্ব যখন
তখন কী করে ফোটাবে চিরায়ত সৌরভে মুখরিত সে-ই আত্মকুসুম!

শয়তান

আমি ভুলে যাই সবকিছু কেবল ভুলি না মুখোশ
প্রতিদিন যা পরে বিপর্যস্ত তুমি ডানাহীন উড়ে যেতে পারো না বহুদূর
তোমার পথ খাটো হয়ে আসে যেন গর্তে ঢুকার সময় এখন তোমার অবিরাম গিরগিটির মতো চোখের রঙ বদলাচ্ছ
বদলাচ্ছ আর সাপের মতো ছলম পাল্টে হয়ে ওঠতে চাইছো শয়তানদের কেউ
যারা শশ্মানে আহার করে মৃতদের পচনদুষ্ট নাড়িভুড়ি যে সব শকুন, শৃগালেরা; নিভৃতি পেলেই কোনো।
ভুলে যাই তখন কত আরও পশুদের নির্যাতন, মানুষের বাইরে যে মুখোশ থাকে সেটা নয়
বলছি ভেতরে লুকানো যে পুঁতিগন্ধময় এঁটো মুখোশটা ওটার কথাই তো ভুলতে পারি না
ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখায় যে মহাশয়তান, কুকুরের সুরত ধরে, শয়ানকালে রেখে দিতে সাথে
ভুলি না তাই কখনো লোহার বড়শি, শয়তান এলে কানে গিঁথে দেব বলেই!

মুদ্রিত ধাতুলাভা
মানস রাহী, সবুজ পথের সবুজ

যেতে যেতে কতদূর পারো যেতে যতদূর গিয়ে থামতে হয় তারচেয়ে একটু দূরে আর পারো না যেতে
তোমার দ্বিধা হয়, বালিতে আটকে যায় পা অন্ধকারে অস্ত যায় তোমার সূর্য, না তারপরও যে চলতে পারছো
সে তোমার হিম্মত একটা আত্মমর্যাদার সিঁড়ি যা নির্মাণ করেছো আসলে তুমি নিজে গভীর শ্রমের বদলে নিজের একটা উপজগত!
হয়তো বা সে জগৎটাতে একামাত্র পথ এবং পথিক তুমি। অজস্র পরাহত বেদনা রেণুই সেখানে ফুল হয়ে ফুটে ওঠে রোজ!
ব্যতিক্রমের কোনো ঝরনাজলে মনে হয় হয়তোবা পাখিদের ধ্বনিময়তার পালক তুমি স্মৃতি থেকে
স্মৃতির দূরত্ব রেখে শূন্যতার পাহাড় হেঁটে কখনো ক্লান্ত হও না বলেই যাও আরও সুদূরের বর্ণিল
পাথুরেচুনের স্তর পার হয়ে যাওয়া একটা ক্ষীণ খনিজস্রোত
আশ্চর্য বজ্রপতনের রাতের পসরে কোনও মুদ্রিত ধাতুলাভা!

কী করে বলো!

যখন একটিও আর নেই কোনো প্রকৃত বৃক্ষ এখানে ফুল ফোটাবার
একটিও প্রকৃত পাখি কোনো ভোরের আগে গান শোনাবার
একটিও সুমধুর আজান কিংবা ঘণ্টাধ্বনি, শঙ্খফুঁও নেই উড়িয়ে নেবে যা জগতের সব পাপতাপ মারি ও মড়ক;
যখন একটিও আর ভরসাবিন্দু ছেয়ে আসে না স্বপ্নের প্লাবন,
একটুও আশা জাগায় না কোনো সুর, ভালোবাসা অকালে ঝরে পড়ে,
আস্থার কুসুমদলে অনীহার কীট মুখ গুঁজে গোপনে কাটে সৌরভজাল
যখন একটিও নেই আর স্বাধীন অলিন্দ কোনো মানুষের মুক্তিচিত্রের
যখন একে একে সকল সম্ভাবনার দুয়ারে
লাগে তালা, আর আন্দাজেই কাটা পড়ে আমাদের শিশুগুলির মাথা
স্বপ্নগুলো নির্বাসনে যায়, অনায়াসেই হারায় সাধের
আকাশ সাঁঝের আকাশে গিয়ে শূন্য হয়, ফলে
দুপুরেই যখন সন্ধ্যা নেমে আসে দিনের মাঠে, সূর্য অস্ত যায়—
অন্ধকার নামে সকলের মাথার উপর, পৃথিবীও নয় আলোকিত আর তখন কেবল সন্দেহ
ভয়, প্রশ্ন মনে মনে— হাতের কাছে সামান্যও
থাকে না যখন আলো, কেবল ছায়াদেরই উত্থান; আর যখন বাতাসেরাই হিংস্র হয়ে ওঠে লুট করে নিতে সব সৌন্দর্য রাতের
কী করে বলো তখন: আমার পৃথিবী বেঁচে আছে দুধভাতে পোষা বেড়ালের মতো যে বাঘের মাসি আর বাঘের থাবার মতোই যার থাবা!