আশিক আকবর

আশিক আকবর

আশিক আকবরের গল্পিকা

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৩, ২০১৯

এক.
দশটা টাকা একজনের হাতে কুচিমুচি কইরা দিয়া কইবান, দশ টাকা দিয়া আসো চায়ের দাম, ওই দোকানে।
উ দশ টাকা দিয়া চইলা আসলে, দোকানি দশ টাকা মনে কইরা রাইখা দিলে... কিছুক্ষণ পর, আবার ওই দোকানে চা পান করে বিশ টাকার নোট দিয়া কন, চায়ের দাম দশ টাকা রাখো। দশ টাকা ফেরত দাও।
দোকানি টাকা ফেরত দেবার জন্য ক্যাশ খুললে, যদি দেখে কুচিমুচি করা এক হাজার নোটটা একপাশে অবহেলায় পড়ে আছে, তখন বলবে, ওই কুচিমুচি করা দশ টাকার নোটটা আমারে দাও, পুরান টাকা আমার লাগবো...
দোকানি কুচিমুচি করা দশ টাকার নোটটা আপনাকে আবার ফিরিয়ে দিলে, আপনি দৈত্যদলের কাছের লম্বু গাছটার তলে বসে, একটা সিগরেট ধরিয়ে, রাজনের সামনেই ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে কুচিমুচি দশ টাকা ধরা নোটটা, নিজেকে এবং রাজনকে দেখিয়ে বলবেন, খাটো দৈত্য, দেখেন, এইটা একটা এক হাজার টাকার নোট। এইটা এতক্ষণ সরল বিশ্বাসে দশ টাকার নোটের কাজ করেছে।

দুই.
সে তিনকোনা জালি নিয়া জলায় নাইম্মা ছিল। দারকিনা, কুচো চিংড়ি, চাডা, হঠাৎ হঠাৎ ছোটো টাকি, গু খাওরা রাগগা মাছ পাচ্ছিল। তার কোমরে লটকানো খালুই পানি ছুয়ে ছুয়ে দুলছিল। আকাশে চমক দিলো একটা বিজলি। চমকে উইঠা তার চোখ পড়লো সোনারঙ পোনামাছের দিকে। একঝাঁক সোনালি পোনা পানিতে উপর-নিচ করছে। খেলছে। সোল মাছের পোনার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলো সে। কী সৌন্দর্য! কী সৌন্দর্য! কাঁচা সোনা। কাঁচা সোনা। জীবন্ত। জীবন্ত। সাট্ করে তিনকোনা জালি সে নামিয়ে দিলো জলে।
উঠে আসলো পোনা মাছগুলো। মা শোলটা লাফ দিয়া ছিটকে পড়লো। ঝটপট্ খালুইতে পোনা তুললো লোকটা। এবং হাঁটা দিলো বাড়ির দিকে। বউয়ের হাতে মাছগুলা দিয়া সে গেল গোসলে। ততক্ষণে বিজলির ঝলকে নেমে আসা সোনালি মাছগুলা স্বর্ণে পরিণত হয়ে গেছে। বউ এইসব দলা দলা মাছ মূর্তির সোনা দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, জামাই রে জামাই, গেলি কই, আজ তোরে মাছ খাওয়ামু, বলতে বলতে ছাইগাদায় ছুড়ে মারলো দলা দলা মাছ আকৃতির সোনার টুকরাগুলা। চাডা, পুডি না পাওয়ার দুঃখে ম্যাও ম্যাও করে উঠলো ওদের বিড়াল।

রাতে খেতে বসে লোকটা বেগুন পুড়া দিয়া খেতে খেতে কিছু বললো না। একবার শুধু ব্যথিত নয়নে বউয়ের মুখের দিকে তাকালো। আর এতেই বউয়ের কান্না উথলে উঠলো। আর উথলানো কান্নায় তড়িতাহত স্বামী, স্ত্রীর চোখে রাখতে গেল চোখ। আর তখন পৃথিবীর রমণী কান্না ঠেকানো জলের ধারা বহাতে বহাতে বলছে, সোনা দিয়া তুমি আমারে আবা।

তিন.
এমন ঝুম বৃষ্টিতে এক ছাতার তলে আমরা ছিলাম। আমি জড়িয়ে ধরে ছিলাম তার কোমর। আমাদের হা হা হি হি তে কাঁপছিল শ্যামলীর মোড়। হাঁটতে হাঁটতে আদাবরের রুমে এসে যখন লেপের তল নিলাম,  শে বলেছিলো, লেপের তলে আসতে ইচ্ছে করছে। বলতে পারিনি, আসেন। নিয়েও আসতে পারিনি লেপের তলায়। লেপের তলায় হি হি কাঁপছিলাম। আমার ছিল ঠাণ্ডার ধাত। শে ছিল পার্টি কমরেড।

ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। বউ কবুতরের খাঁচা নিয়া বড়ঘরে দৌড়াচ্ছে। ভারচুয়ালিনী বান্ধবীকে বৃষ্টিতে ব্রহ্মপুত্র দেখার দাওয়াত দিচ্ছি। মার ছাতা জানি কোথায়? ফেসবুক গুতাচ্ছি। দন্নায় রাখা ভাঙা ছাতাটি দেখছি। পার্টি কমরেড, কোথায় কোথায় না জানি বন্দুক কান্ধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার কলম আমাকে বোদার দিকে নিয়া যাচ্ছে। শে তো নারীই ছিল। তারও তো তা ছিল! তারপরও কেন রেইনকোট পরে তুমুল বৃষ্টিতে আমরা বনে জঙ্গলে মুক্তাঞ্চলে ঘাঁটি এলাকায় নেই?
কমরেড আমি আসছি।
আমাকেও সঙ্গে নিআ যাও!
শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ব্যক্তিজীবনের ছোটো ছোটো মৃত্যু আমি জানি।

চার.
এইটি ছিল আআ সাধুর ঘর। তিনি যখন নিজের উপর খুব ক্ষিপ্ত হন, তখন এইটি জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যান। তিনি নিজেকে ঘরে রেখে ঘরটি জ্বালিয়ে ছিলেন কিনা, এই নিয়া বিতর্ক আছে। ছিল। কিন্তু যখন কালো কয়লা দিয়ে মনা এই ছবিটি আঁকলো, তখনই ফেসবুক মারফত খবর পাওয়া গেল, সাধুকে কান ছুঁই ছুঁই লাঠি হাতে মধুপুরে গভীর জঙ্গলে হাঁটতে দেখা গেছে। এক বনমোরগ শিকারি এটি জানিয়েছে। কিন্তু ঘটনা ঘটলো চরম। সাধুর খবর পাওয়া মাত্র সবাই ঝাপিয়ে পড়লো বন মোরগ শিকারির স্ট্যাটাসে। লাইক, কমেন্ট, স্টিকার... কী না!
শিকারি ভয় পাইল। এবং ওই স্ট্যাটাস মুছে আইডি করলো ডিঅ্যাকটিভ। একে তো সে চোরা বনমোরগ শিকারি, তার ওপর সাধুর খবরে সে পরিচিত হলে তো মদে বুট ভিজিয়ে আর মোরগ ধরা যাবে না। সে মদে আজ একটু বেশি বুট ফেলে একটু আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলো। আর বউকে বললো, মোরগের ডবল রোস্ট করো। কাল বনে খাবার যাবে। ততক্ষণে মোরগ শিকারি মনার আঁকা সাধুর ঘরটি দেখে নিয়েছে।

পাঁচ.
সে বলেছিল, আসবে। কিন্তু আসলো না। তার মৃত্যুর খবর পেলাম। কেউ বিশ্বাস করলাম। কেউ করলাম না। কয়েক বৎসরের মধ্যে কেউ কেউ সাক্ষ্য দিলো, তার সমাধিক্ষেত্র দেখে এসেছে পশ্চিম দেশে। আমি তার অপেক্ষা কিন্তু ছাড়লাম না। আলখেল্লা পরিহিত ঝোলা কাঁধের মানুষটি ঠিকই কিন্তু একদিন আসলেন। আয়নায় আমি তাকে দেখলাম। চোখে পানি এলো। পানি মুছলাম। তারপর আর পরিচিত কেউ আমাকে খুঁজে পায়নি।

ছয়.
পরিচয় পর্বে হাসাহাসি ছিল, সাকুল্যে দু`চার দিনের কথায়, আপনিই বলতাম। এ ওর ওয়ালে লাইকের বেশি চারণা ছিল না। চল ছিল এমনিই। কেউ কারো কাছে বিশেষ হইনি। হঠাৎ পরশু দেখি এক চিরকুট, ভালো থেকো। এবং আইডিটা ডিঅ্যাকটিভ। কখন যে আপনিকে তুমি করে ছিল, সেই ভার্চুয়ালিনী, বুঝতে পারিনি। আজ বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি যাবার বেলার ফুল সে দিয়েছে, কিন্তু গাছসুদ্ধ উপড়ে নিয়েছে। ঘ্রাণ আছে ফুল নেই, গাছ নেই।

সাত.
লোকটি তার ঝোলা থেকে তালপাতার পাখা বের করে বললো, বাতাস কর। বাতাস করতে করতে দেখলাম, সে তার ঝোলা থেকে লাল খাতা বের করে ছবি আঁকতে শুরু করলো। সে পটাপট ছবি আঁকলো। কী নিখুঁত টান, কী রেখা! আর কী মজার মজারই না ছবি! ইলিন্দা মাছ। কাঁকড়া। বাইল্যা মাছ। চিংড়ি। সুবনখুরির ঝাঁক। শুশুক। একটা কুমির ও কাশবনও আঁকলো সে। বললো, ক্ষুধা লাগছে, কিছু খাবি? মন্ত্রমুগ্ধ তাজ্জব আমি ঘাড় নাড়াতে না নাড়াতেই সে বললো, মানুষের মাংস পুড়া খুব সুস্বাদু, চল শ্মশানের দিকে যাই।

উঠে দাঁড়ালো সে। চট করে আমার হাত থেকে পাখাটাও নিয়া নিলো। উঠে বসলো সে নৌকায়। আমি পা বাড়াতে না বাড়াতেই নৌকা ছেড়ে দিলো সে। পালবিহীন একটা নৌকা তরতর করে হিন্দুদের সমাধির দিকে যাচ্ছে। ওখানে পুড়া মাংসের স্তূপ, ঘ্রাণ।

সাত.
পাশাপাশি রেললাইন ধরে হেঁটে যাওয়া মানুষটিকে আর দেখতে পাইনি। সে কি শিমুল গাছের ছায়ায় একটু থেমে ছিল? ট্রেন আসার সময় তাকে দ্রুত ব্রীজ পার হতে দেখেছিলাম। যমুনার উপর একটা নৌকায় শুয়ে তাকে আকাশ দেখতে দেখা গিয়াছিল। নৌকাডুবির বা ট্রেন দুর্ঘটনার কোনো খবরও পাওয়া যায়নি। হঠাৎ খবর এলো, মেঘালয় পাহাড়ের কাছের এক মাজারে তাকে দেখা গেছে।
পড়িমরি করে ছুটলাম। আর কী আশ্চর্য, নৌকাঘাটে দেখি, সে একটা পরিত্যক্ত নৌকায় বসে আছে।
চিনলি?
চিনলাম।
খুঁজছিলি কেন?
জানি না।
না জেনে কোনো কাজ করা ঠিক না। না জেনে কোনো কাজ করবি না।
আচ্ছা।
পুলিশ হারামজাদারা কি এখনো খোঁজ করে?
আমি পুলিশে যোগ দিয়েছি।
তুই কি আমাকে ধরিয়ে দিবি?
সে দ্রুত তার ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেয়। টের পাই, পিস্তলের বাটে চলে গেছে তার হাত। আমিও জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলি, শ্রেণিশত্রু হত্যার লাইন পরিত্যক্ত হয়েছে। আপনি আমাকে হত্যা করতে পারেন না।

আট.
অনেক অনেক বৎসর পর সাইকেলঅলা ফেরিঅলা লোকটি যখন এলো, তার কাছে ছিল ছোটো ছোটো সোনার বিস্কুট, আর হীরার গোল গোল নকশাদার রঙিন মার্বেল। এবং হ্যামিলনের বাঁশিঅলার কাছ থেকে ধার করে আনা বাঁশি। তার বাঁশি শুনে বাচ্চার দৌড়ে আসছিল। আর বলছিল, আচার চাই। আচার চাই। মিষ্টি আচার। টক আচার।

বাচ্চাদের হাতে ছিল কমপিউটার আর মোবাইলের চিপস্ এবং পরিত্যাক্ত মাউস। ওদের কেউ কেউ কটকটি, কটকটি চাইও বলছিল। শিশুদের এই ভয়ঙ্কর মিছিল দেখে, সাইকেলঅলা ফেরিঅলা বনবন করে, চাকা ঘুরিয়ে, প্যাডেল মেরে পালাতে শুরু করলো। পাহাড় পর্যন্ত শিশুদের খাদ্য চাই মিছিল তাকে ধাওয়া করলো। পাহাড় হা করে তাকে গিলে নিলে, লোকটি হ্যামিলনের বাঁশিঅলার পাশে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে স্বপ্ন দেখলো, ফালতু সোনাদানা না, খাবার দাবার সে শিশুদের সাথে খাচ্ছে। তার মনে পড়লো তৎক্ষণাৎ, এককালে সোনাদানা হীরামানিক টাকা-পয়সার জন্য মানুষ খুনখারাপি, এমন কি যুদ্ধ পর্যন্ত করতো। ফেরিঅলা মৃদু হেসে ঘুমিয়ে গেছে ততক্ষণে।

নয়.
লোকটা তেমন কিছুই করেনি। হাত বাড়িয়ে মগডাল থেকে জাম পেরে এনেছে। তরতর করে পানির উপর দিয়া হেঁটে গিয়া কালো কালো পাকা তাল কুড়িয়েছে। শিশুরা তার দিকে গভীর বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল। ছোটো ছোটো মাছগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে লোকটার লম্বা আলখাল্লার পকেটে উঠছিল, তখন গৃহস্বামীরা ব্যাপারটা আমলে নিলো। কয়েক জনে মিলে লোকটাকে মেরে মাটি চাপা দিয়া দিলো। ওইখানে একটা লাল টুকটুকে রক্তজবা গাছ জন্ম নিলে, শিশুরা ওখানে যাওয়া শুরু করলো।

সেদিন সত্য দাদা, মানে ভাবনা সত্য করে ফেলা লোকটার উঁচু ডিবি থেকে ফেরা শিশুটি ফিরছিল চোখ মুছতে মুছতে। বললাম, কি হলো মামণি? ফুফাতে ফুফাতে হেঁচকি তুলতে তুলতে শিশুটি বললো, জবা গাছে লাল ফুল ফুটছে।
সত্য দাদা আসছেন। চমকে উঠলাম। তার মানে যুদ্ধ। ভাবনা সত্যের যুগে প্রত্যাবর্তন। শিশুরা যুদ্ধ ভয় পায়। আমি বেল্টটা কষে বাঁধতে লাগলাম।

দশ.
সে তখন ঠাঠারি বাজার পট্টিতে থাকতো। ক্ষুধা লাগলে কয়লাঅলার দোকানে যেত। গরম গরম কয়েকটা সোনারঙ কয়লা কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়ে নিতো। কয়লাঅলা কখনো তার কাছে দাম চায়নি। দা-কাঁচি হতে থাকা গনগনে লোহাগুলো যখন হাতুড়ির নিচে পিটন খেতে থাকতো, হঠাৎ হঠাৎ কয়লা খাওআ লোকটার কথা মনে হতো কামারের। একদিন খুব বৃষ্টি। হাপরের মুখে কয়লা জ্বলতে চাচ্ছে না। ধোঁয়াতে কামারের চোখে পানি আসছে। ছপছপ শব্দে কামার চোখ তুলে দেখে, জ্বলন্ত আগুনরঙা কয়লা খাওআ লোকটা কালো রেনকোট পরা। দাঁড়ানো। আজ হঠাৎ কাঁপলো সে। জ্বালানো কয়লা যে নাই। ততক্ষণে লোকটা বললো, গাদা বন্দুক বানাতে পারিস?

উঠে দাড়ালো কামার। চোখে চোখ রাখা দুজন। বাঘ সিংহের লড়াই শুরু। সুদূর বনে হাতির বৃংহন। ঢাকা শহরে তুমুল মিছিল। মাথার উপর গনগন তালু ফাটা সূর্য। কামার বললো, জ্বী জনাব, গাদা বন্দুক বানাতে পারি। কয়টা লাগবো?

এগারো.
পাখির মাংস খাবার তার ইচ্ছা হইছিল। বন্দুক নিয়া ঘুইরা ফিইরা যখন পাখি মিললো না, দুই একটা ঠুসঠাসও যখন ব্যর্থ হইলো, তখন সে নিজের ভিতরের পাখিটাকে বের করে গুলি করে দিলো। আমরা যখন তাকে কবর দিয়ে ফিরে আসছিলাম, তখন দেখলাম তার বালক ছেলেটি কাঁদছে। আর তার ভেতরে পাখির মাংস খাওয়া লোকটার পাখি হাসছে। তার রঙ মোলায়েম হলুদ। আমরা লোকটার হলুদ পাখিটাকে দেখতে পেয়েছিলাম। নিজেদের পাখিকে দেখতে পাইনি। তখন দুই চোখে অনেক কিছুই দেখা যেত না।

বারো.
গলির মোড়ে লোকটাকে যখন পেলাম, তখন তার হাতের টোপলা থেকে টপ্ টপ্ করে লাল রক্ত পড়ছিল। কিছুক্ষণ আগে তাকে তরমুজের দরদাম করতে দেখা গেছে। দেখা গেছে অন্ধকার বস্তি থেকে তীব্র চিৎকারের পর বেরিয়ে আসতে। মাথাহীন বুদ্ধিজীবির লাশের পাশেও সে ঘুর ঘুর করছিল। ওর পোটলায় কি? বুদ্ধিজীবির কাটা মাথা? তরমুজ? নাকি বস্তির কোনো কিডনি, চোখের কর্ণিয়া, রক্ত... বেচা শিশুর মুণ্ডু।

ভাবতে ভাবতে রক্তজল অনুসরণ করে চারতলায় উঠি। নক করি। দরোজা খুললেই লোকটাকে ঠেলে ভিতরে ঢুকি। আয়নায় গোফঅলা আমাকে দেখি। আর দেখি অনেকগুলা পাকা তাল। রস পড়ছে একটার। টনক নড়ে আমার। লোকটা হা হা করে হাসে। আর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কী আর করা, নয়টা তাল দিয়ে নিজের দশটা মাথা বানিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি, বুদ্ধিজীবির কাটামুণ্ডুর, বস্তির শিশুর কাটা মাথার, ছাগল খাসির কাল্লার... একটা তাল পড়ে আয়নাটা ভেঙে যায়। ভাঙা আয়নাটাকে বাংলাদেশ বাংলাদেশ মনে হয়।

তেরো.
ব্রক্ষ্মপুত্র নদের পাড়ে এক কুঁড়ে। চারপাশ লম্বা কলাগাছ ঘেরা। বাড়িতে থাকে অনিন্দ্য সুন্দর তরুণী, যেন চাঁদ। ১৮-১৯। শে বালিশের কভারে ফুল আঁকে, পাতা আঁকে। ব্রক্ষ্মপুত্র এক পূর্ণিমা রাতে চাঁদকে বলে, অ্যাঁই!
চাঁদের সর্বাঙ্গে শিহরণ। শে নেমে আসে কুঁড়ের কাছে।
চাঁদকে চিনতে পারে অনিন্দ্য সুন্দর। বলে, বড় আপা, হ্যারে, তুই তো হারিয়ে গেলি। আমিও হারাবো সূর্য মরলেই। চল ব্রবহ্মপুত্রে নামি, সাঁতরাই। মহাজগতের অনন্ত সময়ের পরিক্রমায় হারানো চাঁদ বলে, ও তো পুরুষ!

চোদ্দ.
চলেই গ্যালো দিনটা। লোকটা জন্তুর মতো খাইতে বসেনি। ফ্যান ছাড়েনি। খুনসুটিতেও জমেনি মেয়েদের সাথে। একটু স্মৃতি চারণ করেছে মাত্র। লেসবুদের জ্বালায় ওর প্রেম প্রার্থিনী যখন পালালো, বৈদেশের বোস্টনে বিবাহ করলো। একরাতে মূর্তিমান স্বামীকে জবাই করতে গেল। আর পালিয়ে এলো বাংলাদেশে। ততদিনে লোকটার বউ হয়েছে। বউয়ের সাথেও খিটিমিটিরও একশেষ। একরাতে সিগন্যাল দিতে থাকলো কম্পু।
কল ইউ ম্যান, এসএসএস।
হ্যালো।
আমরিকা থেকে ফ্রান্সে যাচ্ছি। একটা পাহাড়ের পাশে ওর বাড়ি। ওখানে থাকবো।
পারি থেকে ওটা কত দূর।
এই তো ভার্সাইয়ের পাশে।
কবে যাচ্ছেন?
বাবা-মাকেই বলতে পারিনি।
তাহলে তো এই জোড় বাধা উপরি উপরি।
জুনে আসছি। জুনে কথা হবে।
আসুন।
জুন এলো। লোকটা মরণ বাচন রোগে পড়লো। পালালো। সুস্থ হলো। জুনের পর আরো জুন গেল। আজ আবার কল করলো লোকটা, মমমমমমণণণণণণণ9টু টু টু... করে করে কল থামলো। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে লোকটা খেতে বসলো। হঠাৎ কষ্ট হলো তার। মনে পরলো সাধা ঈদের শিরনি মেয়েটির হাত থেকে সে নিয়ে খায়নি। লোকটা জানোয়ারের মতো খাচ্ছে এখন।

পৃথিবীতে বছর ঘুরে ঘুরে ঈদ আসছে। আর মেয়েটার ফোন আসলেও সে ধরছে না।