আশিকুজ্জামান টুলুর গল্প ‘ধূসরতা ছায়া ছায়া’

প্রকাশিত : মে ২৭, ২০২১

বিকেল হয়ে গিয়েছিল। তিনটে বাড়ি দেখানোর কথা ছিল আজ এবং এটাই শেষ বাড়ি, যেখানে এসে আমার গাড়িটা থামলো। আমার ক্লায়েন্ট সোহেল আমার সাথেই এসেছিল, পাশের সিটে বসে। খুব সাদাসিধা ছেলে, দেখে বোঝা যায় না ওকে কীরকম ফিলদি রিচ ও। বিরাট ড্রাইভওয়েতে গাড়িটা রাখলাম। বিকেল ঢলে পড়ে সন্ধ্যা হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্ত। একতলা বাড়ি, তবে বাংলো নয়, আবার দোতলা বাসা কিংবা ব্যাকস্প্লিটও নয়। কিছুটা কাস্টোম বিল্ড বাসা এবং আরকিটেকচারটা কিছুটা ইরানি মনে হয়। এদেশে ইরানিদের টাকা মনে হয় সবচাইতে বেশি এসেছে। ইরান থেকে আসা বড়লোকদের বেশিরভাগ মানুষজনের বাসা দেখলে বোঝা যায় যে, ওদের ইরান থেকে চলে আসার সময় ওরা কি পরিমান টাকা নিয়ে এসেছে। ওরা ওদের বানানো বাসাগুলি ইরানি স্টাইলে বানিয়ে থাকে।

গাড়ি থেকে ড্রাইভ ওয়েটা পার হয়ে মেইন গেটের সামনে গিয়ে লকবক্স থেকে চাবিটা বের করলাম। বললাম, সোহেল ভাই চইলা আসেন।
সোহেল নামলো গাড়ি থেকে। অসম্ভব হ্যান্ডসাম। পোলিওতে একটা পায়ের একটু ক্ষতি হয়েছিল বিধায় একটু খুড়িয়ে হাঁটে। বয়স আমার মতোই। ও এলো এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, এটা কত?
আমি জবাব দিলাম, ৩.৫। তবে বারগেইনের একটা অপশন আছে। যেহেতু প্রায় চার মাস পড়ে আছে।

সোহেল কোনো কথা বললো না। আমি দরজা খুলে ফেললাম। ভিতরে ঢুকলাম। আমার সাথে সেও ঢুকলো। ঢুকেই নয়নাভিরাম দৃশ্য আমাদের দুই জোড়া চোখকে কী এক প্রশান্তিতে ভরে তুললো। বিরাট একটা লিভিং রুম, কোনো জানালা নাই তবে ওয়াল টু ওয়াল পুরু কাচের দেয়াল যা ভেদ করে এক হাজার ফিট নিচের বিশাল অন্টারিও লেক দেখা যাচ্ছে। বিশাল সেই দেখার পরিধি। কারণ স্ট্রাকচারটা যদি ৬০ ফিট চওড়া হয়ে থাকে তবে সেই মোটা কাচের দেয়ালটাও ৬০ ফিট চওড়া। সে কারণেই অন্টারিও লেকের বিশালতা ওই লিভিং রুমে বসেই ফিল করা যাচ্ছে। আমি গিয়ে ভারি স্লাইডিংটা খুলে দিলাম। অন্টারিও লেক রাজ্যের প্রাণ শীতল করা দক্ষিণা বাতাস এসে প্রচণ্ড ধনাঢ্য ঐশ্বর্যমণ্ডিত লিভিং রুমটাকে ভরিয়ে দিলো।

সোহেল এসে আমার পাশে দাড়িয়ে বললো, টুলু ভাই আমি এই বাসাটা নেব, এজেন্টরে কন।

সোহেল দাঁড়িয়ে থাকলো এক দৃষ্টিতে লেকের দিকে তাকিয়ে। আমি ওকে স্পেস দিয়ে চলে এলাম অন্য আরেকদিকে। ওর একাকিত্বের হিসাব নিকাশটা মিলিয়ে নেয়ার জন্য।

প্রথমে এসে মেইন দরজা খুলেই দেখতে পেয়েছিলাম চার মাস ধরে ওই বাসার ঠিকানায় আসা চিঠির স্তূপ গেটের কাছে পড়ে থাকতে। সম্ভবত গেটের একটা ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভিতরে ফেলে দিয়ে গিয়েছে পোস্টম্যান। মর্মর পাথরের মেঝেতে পড়ে আছে মোটা আস্তরের ধুলো, একটা দেয়ালের পাশে টেলিফোনের তার অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। কোনো আসবাবপত্র নাই বাসাটায়। দেখে মনে হচ্ছিল, যারা ছিল তাদের জীবন কোনো একপর্যায়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল এত প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও এবং সবকিছু ছেড়েছুড়ে ফেলে রেখে হয়তো কোথাও চলে গিয়েছে এবং এই চলে যাওয়ায় অর্থনৈতিক যে অপচয় হয়েছে, তা ওদের গায়েও লাগেনি অত্যধিক প্রাচুর্যের কারণে।

আমি চলে গেলাম বেড রুমগুলি দেখতে। বড় বড় তিনটা বেডরুম, একটা ফ্যামিলি রুম, ভিতরের দিকে আরেকটা কোজি লিভিং রুম। সারা বাসায় সাত থেকে আটটা বাথরুম এবং সবগুলি প্রমাণ সাইজের। সোহেল তখনও দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে অন্টারিও লেকের দিকে। আমি এবার চলে গেলাম বেজমেন্টটা দেখতে। বেজমেন্টে গিয়ে আমি খুবই ধাক্কা খেলাম মানসিকভাবে। এই প্রথম দেখলাম যে, এত দামি একটা বাসার বেজমেন্ট একেবারেই আনফিনিশড এবং ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমার ফোনের লাইট জ্বালিয়ে ধরলাম, চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠলো জায়গেন্টিক সাইজের একটা আনফিনিশড বেজমেন্ট। ঢুকে হাঁটতে থাকলাম ফাউন্ডেশন ওয়াল ঘেঁষে এবং দেখতে চেষ্টা করলাম ফাউন্ডেশন ওয়ালের অবস্থা। আঁচ করলাম, বাসাটার বয়স ৪০ বছর হবে। বেজমেন্টটা ড্রাই তবে অসম্ভব ঠাণ্ডা এবং একটাও জানালা নাই। ফিরে এলাম উপরে। সোহেল এরই মধ্যে দুটো রুম শেষ করে তৃতীয় রুমের দিকে যেতে যেতে আমাকে প্রশ্ন করল,
৩২০০ তে  দেবে?

বাংলাদেশ থেকে আসা কিছু বড়লোকদের দেখেছি, এরা ঠিক ডলারের ভাষায় কথা না বলে বাংলা ভাষায় টাকার অংকটা বলে এবং সেই বলার মধ্যে বেশ একটা ‘টাকা কোনো ব্যাপার না’ টাইপের ইগো কাজ করে। বাড়িটার দাম ছিল 3.5 মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ সাড়ে তিন মিলিয়ন ডলার, সেটাকেই সোহেল ৩২০০ অর্থাৎ 3.2 মিলিয়নে দিবে কিনা জিজ্ঞাসা করছিল। আমি বললাম, একটা সম্ভবনা আছে 3.2 তে পাওয়ার। কারণ ৪/৫ মাস পড়ে আছে বাসাটা।

সোহেল বলল, এহনি ফোন দেন ওরে।
যে লিস্টিং করেছে সেও এক জাঁদরেল এজেন্ট এ তলাট্টের। সব বড় বড় বাড়ির ডিল ও করে থাকে। অসাধারণ আমুদে ইটালিয়ান লোক এই এজেন্টটা। ওর সাথে আমি আগেও ডিল করেছি, খুব খোলামেলা মেজাজের মানুষ, মন খুলে কথা বলে এবং বিরাট হৃদয়ের অধিকারী। আমার সাথে ওর চমৎকার একটা রিলেশন। প্রচুর জুয়া খেলে ও মদ খায়। কেন যেন আমার এরকম লোকগুলিকে খুব ভালো লাগে যারা দুহাত খুলে জুয়া খেলে, মদ খায়, সিগারেট খায়, হাহাহা করে মন খুলে হাসে। আমার কাছে মনে হয়, এদের মন আকাশের মতো বড় হয়, ভিতরে আর বাইরে একই কথা, দুই রকম কথা নয়। পিছনে কোনো পুতপুত করার অভ্যাস থাকে না।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম বাসাটার খুটিনাটি যা আমাদের সাধারনণত জেনে নিতে হয়। শেষে জানতে চাইলাম, টনি, 3.2 তে দিতে পারবা? ক্লোজিং এক মাসের মধ্যে।

টনি বলল, দুই ঘণ্টার মধ্যে যদি অফার আনতে পারো আর ফাইভ পারসেন্ট ডিপোজিট, দিয়ে দিব তোমাকে।
আমি বললাম, এক্সেলেন্ট দাঁড়াও ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলে জানাচ্ছি।

রেখে দিলাম ফোন । সোহেলকে বললাম, দেবে ও। তবে দুই ঘণ্টার মধ্যে অফার করতে হবে এবং ও বলেছে ৫% ডিপোজিট লাগবে কালকের মধ্যে।
সোহেল বলল, দিয়া দেন অফার আর আমার কাছে ১৫০ মতো আছে ক্যাশ, বাকি আমি কাইল ব্যাংক থেইকা উঠাইয়া দিমু।

আগের দিন সোহেলের সাথে আমি নায়গ্রার ক্যাসিনোতে গিয়েছিলাম। নিজের চোখে দেখেছিলাম ও প্রায় ১৫০ হাজার ডলার জিতেছিল সারারাত খেলে। ভোরের দিকে ক্যাশ ১৫০ হাজার ডলার নিয়ে ফিরেছিল ও আমার সাথে। সেই টাকাটাই ও ডিপোজিট দিতে চেয়েছে। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার অফিসে যাবেন?
সোহেল বলল, কেন?
আমি বললাম, অফারটা লিখবো।
সোহেল বলল, এইখানে বইসা লেখেন না কেন।
আমি বললাম, ওকে, সেটাও করতে পারি।

গাড়ি থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে আসলাম অফার লেখার জন্য। লিভিং রুমের মেঝেতে বসে পড়লাম। ও দাঁড়িয়ে থাকলো বিরাট কাচের দেয়ালের সামনে অন্টারিও লেকের দিকে তাকিয়ে। ওইখানকার দরজা দিয়ে বের হয়ে বিশাল একটা ঝুলন্ত ডেক, ডেকের বেশ নিচে মাটি এবং কিছুটা খাড়ি টাইপের, ঢালু হয়ে ১০০০ ফিট নিচে নেমে অন্টারিও লেকে মিশে গিয়েছে।

আমি লিখছিলাম, সোহেল লেক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশের ঘরে গেল। যাওয়ার পরপরই ধপাস করে একটা শব্দ পেলাম এবং একটা চাপা ম্রিয়মাণ আর্তনাদ। আর্তনাদটায় কেমন একটা লজ্জা জড়ানো। আমি দৌড়ে গেলাম ওই রুমটায়। গিয়ে দেখি, সোহেল চিৎ হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে, দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওকে এবং জিজ্ঞাসা করলাম, সোহেল ভাই ব্যথা পাইছেন?

সোহেল কথা বলতে পারলো না ব্যথায়। আমি বুঝতে পারলাম ও আসলেই খুব ব্যথা পেয়েছে, এমনি ওর একটা পা খুব কমজোর পোলিও হওয়ার কারণে এবং সেকারণেই ও খুঁড়িয়ে হাঁটে। বুঝতে পারলাম, পা’টা মচকে গিয়েছে। ওকে ধীরে ধীরে উঠিয়ে বসালাম আমার উপর ভর করিয়ে। আমাকে ঘেঁষে ও বসে রইলো অনেকক্ষণ, আমিও বসে রইলাম। ও খুব উদাস হয়ে গেল, বুঝতে পারলাম মনের কোনো একটা জায়গায় ও লজ্জার আঘাত পেয়েছে অথবা কোনো একটা কষ্ট মনে পড়ে গিয়েছে। আমরা দুজনেই চুপ করে বসে রইলাম বেশ লম্বা একটা সময়।

একটা সময় ও জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা টুলু ভাই, আপনের জীবনের সবচাইতে কষ্টের ঘটনা কি? যদিও প্রশ্নটা পার্সোনাল তবুও আপত্তি না থাকলে কইতে পারেন।

আমি স্ক্যান করতে থাকলাম আমার অন্ধকার রাতগুলো কিন্তু ওকে বলতে পারলাম না, একটু হাসি হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ও বলে উঠলো, জানতাম কইতে পারবেন না, আমিও পারুম না। কারণ আমাগো কষ্টগুলি আমরা ভাগ করি না।

আমি নীরব। এরই মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আমরা আর বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করি নাই। ভালোই লাগছিলো অন্ধকারের ওই নীরবতা। এক সময় ও বলে উঠলো, চলেন ভাই যাইগা।
আমি বললাম, চলেন।

ওকে ধরে ধরে নিয়ে এসে গাড়িতে বসালাম। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ব্যাক করে রওনা দিয়ে দিলাম অন্ধকার রাস্তা ধরে। ও চুপ, আমিও চুপ। ও একা স্ক্যান করতে থাকলো ওর কষ্টগুলো আর আমি আমার ফেলে আসা দিনগুলো।