আশিকুজ্জামান টুলুর স্মৃতিগদ্য ‘সাউন্ড কার্ড ও রেশন কার্ড’
প্রকাশিত : আগস্ট ২৬, ২০২০
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যেদিন ঢাকা ছাড়লাম, সেদিনের ঘটনা। আমার সাথে আমার সাউন্ড কার্ড, কম্প্রেসার, মাইক ও ল্যাপটপ। এগুলি আমি ক্যানাডা থেকে বিভিন্ন এয়ারপোর্ট ঘুরে লন্ডনে চার-পাঁচদিন থেকে ঢাকা নিয়ে গেছি এবং আবার ফিরে আসার সময় নিয়ে আসছি। শুনতে বড় লাগলেও আসলে অত বড় না, আমার ক্যারিঅনে খুব সাচ্ছন্দে হয়ে গেছে এবং ক্যানাডার পিয়ারসন, হিথ্রো, দুবাই কোনো এয়ার পোর্টে যাওয়ার সময় কোনো অসুবিধা হয় নাই। শুধু তাই নয়, এর সাথে চারজনের ক্যারিঅনে আরও অনেককিছু ছিল এবং কোনো এয়ারপোর্টে কিছুই বলে নাই।
ফিরে আসার দিন ঢাকা এয়ারপোর্টে এয়ারলাইন্সের চেক ইন করার পর ভিতরে ঠিক সিকিউরিটি চেকআপের জায়গাটায় অর্থাৎ প্লেনে ওঠার ঠিক আগের চেকিং পয়েন্টটায় টার্কিশ এয়ারলাইন্সের দেশি বাজখাই গলার ইলেক্ট্রনিক্স অবান্ধব একজন মহিলা এবং সাথে ওনার মতোই আরেকজন ইলেক্ট্রনিক্সে অবান্ধব লোক শুরু করলো আমার ক্যারিঅন লাগেজ চেক করা। ব্যাগে সাউন্ড কার্ড দেখেই মহিলা প্রশ্ন করল, এইটা কি?
আমি জবাব দিলাম, সাউন্ড কার্ড?
মহিলা বিস্ময় প্রকাশ করল, সাউন্ড কার্ড! সেইটা কি কার্ড?
আমি জানি, সাউন্ড কার্ড সবার বোঝার কথা নয়। তবু মনে হলো, উনি রেশন কার্ড পর্যন্ত চেনে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যেখানে ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যাপারে যথেষ্ট নলেজ থাকা দরকার, সেটা ওনার নাই। বলতে পারেন যে, সবার সবকিছু চিনতে হবে, এমন কথা নাই। তাহলে এটাও ভাবতে হবে, সবার সব জায়গায় বসতে হবে, এমন কোনো কথাও নাই। যে জানে, সেই বসবে।
এই রেশন কার্ডের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল ১৯৮৬ সালের কথা। এল্ভিস স্টুডিওতে চাইম নিয়ে রেকর্ডিং করছি। স্টুডিওটা ছিল ঠিক জোনাকি সিনেমা হলের অপজিটে। আমাদের সিফট চলাকালীন একজন গায়ক (নাম বললে চিনে ফেলবেন, তাই বল্লাম না) আসলো রেকর্ডিং প্যানেলে এবং দাবি করলো ওর খুব জরুরি দরকার। এখনই একটু ছেড়ে দিতে হবে স্টুডিওটা। এই ধরনের অযৌক্তিক রিকোয়েস্ট স্বজনপ্রীতি হিসাবে তখন দুয়েকটা স্টুডিওতে চলতো। তবে মুবিন সাউন্ড গার্ডেন খুলে এটা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং স্টুডিও ব্যবসায় প্রফেশনালিজম এনেছিল। যাই হোক, আমাদের ব্যান্ডের ম্যানেজার ও বায়ুচড়া বন্ধু টম বললো, এইটা আমাগো শিফট, আপনে যেই হন না কেন, স্টুডিও ছাড়ুম না। লাগে রক্তের বন্যা বয়াইয়া দিমু। একটু চিৎকার চ্যাচামিচি শুরু হয়ে গেল। এইসব দেখে কে যেন সামনেই মতিঝিল থানায় জানিয়ে দিয়েছে, এখানে গণ্ডগোল হচ্ছে। একটু পরেই তিন-চারজন পুলিশ এসে পড়লো এবং রেকর্ডিং প্যানেলে ঢুকে পড়ল। পুলিশদের একজন চিৎকার করে বলে উঠলো, দোকান বন্ধ করেন।
আমরা হো হো করে হেসে দিলাম দোকান বন্ধ করার কথা শুনে। দোকান টার্মটা স্টুডিওর সাথে খুবই বেমানান। যাই হোক, পুলিশ আসায় কারও রেকর্ডিং আর হয় নাই।
ফিরে আসি গল্পে। আমি খুব সহজ করেই মহিলাকে বুঝালাম সাউন্ড কার্ডের কাজ। উনি সব বুঝে জিজ্ঞাসা করলো, এইটা কেন ক্যারিঅনে আনছি, এইটাতো লাগেজে দিতে হয়।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় লেখা আছে যে এটা লাগেজে দিতে হয়? এটার সাইজ এবং ওজন, কোনোটাই তো বেশি না। বরং আমার ক্যারিঅন অ্যালোকেশন অনুযায়ী পারফেক্ট আছে।
আমি ক্যানাডা থেকে রওনা দেয়ার আগে বিশদ রিসার্চ করছি যাতে সাথে নিতে কোনো অসুবিধা না হয়। মনে মনে ভাবলাম, দেখতে এরকম হলেই কি লাগেজে দিতে হয়? আমার কোনো কথাই ওনার কানে ঢুকল না। উনি বললো, না না, ক্যারিঅনে এটা নিতে পারবেন না, লাগেজে দিতে হবে।
আমি বললাম, এটা অনেক দামি জিনিষ এবং খুবই সেনসিটিভ, গুতাটুতা লাগ্লেই শেষ হয়ে যাবে। আর তাছাড়া আসার সময় পিয়ারসন হিথ্রো দুবাই কোথাও কিচ্ছু বলে নাই আমাকে এবং এই টার্কিশ এয়ারলাইন্সেই আসছি। চেঞ্জ করি নাই।
উনি কোনো যুক্তি ছাড়াই আবার বললো, না-না, লাগেজে দিতে হবে।
আমি বললাম, লাগেজে আমি দিব না কোনোভাবেই। কারণ এটা নষ্ট হলে সেটার রিস্ক নেবে কে?
উনি একই মুখস্ত কথা বলতে থাকলো, না-না লাগেজে দিতে হবে।
এরপর উনি আমাদের পাশের কতগুলি সিট ছিল, সেখানে বসতে বললো। আমরা বসলাম। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি, ওনার কোনো ভ্রূক্ষেপই নাই। আমি আবার গেলাম এবং বললাম, আমাদের কতক্ষণ বসতে হবে?
মহিলা গম্ভীর হয়ে বললো, বসেন।
ফিরে এসে বসে আছি ধৈর্য ধরে। আমরা ছাড়া সবাই মোটামুটি চলে গেছে। আমরা শুধু ছাগলের মতো বসে আছি এমন ভাব যে, ট্যাক্সেবল আইটেম নিয়া আইসা কাস্টোমসে ধরা খাইছি। আমাদের ঠিক সামনে একটা টেলিভিশনে গান হচ্ছে। সবাই সেটা দেখছি মন দিয়ে। কারণ এটা ছাড়া ওই বিরক্তির সময় আর কিছু করার নাই। হঠাৎ দেখলাম মহিলাটা এক সময় এসে আমাদের সামনের টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল। ওনার ভাবখানা এমন, ইস মাল নিয়া আটকাইয়া গেছ, আবার টিভি দেখে!
উনি যে না বুইঝা আমারে আটকাইছে এবং সেইটা আমি যে বুইঝা গেছি, উনিও সেইটা বুইঝা গেছে। যাই হোক, আটকাইছে তাও এত খারাপ লাগে নাই। কিন্তু যখন টিভিটা বন্ধ কইরা দিছে তখন কিন্তু মেজাজটা আসলেই খারাপ হইছে। এইটা কোন ধরনের অভদ্রতা, উনি দেখতেছে টিভির সামনে আমরা বইসা টিভি দেখতেছি। কেন বসায় রাখছে, সেটা একটু পরেই বুঝলাম। টার্কিশ এয়ার লাইন্সের একজন টার্কিশ লোক আসলো। আমি আবার সব কিছু খুললাম। ও সবকিছু দেখে আমারে জিজ্ঞাসা করলো, কি করো তুমি?
আমি বললাম, মিউজিসিয়ান।
ও কইলো, আমি ডিজে। যাও গিয়া।
আমি মনে মনে কইলাম, কস কী মমিন! তুই এতক্ষণ কই আছিলি?
ও আর একটা কথাও কইল না। আমি দোকান পার্ট বন্ধ কইরা দৌড়াইয়া গিয়া প্লেনে উঠলাম। মাগার অসুবিধা যেইটা হইলো, প্রতিটা সিটের মাথার উপরের লাগেজ রাখার জন্য যে স্টোরেজগুলি, সেখানের একটাও খালি পাইলাম না। অবশেষে ক্যাবিন ক্রু আইসা সাইজ কইরা দিলো। মনে মনে ভাবলাম, ভাগ্যিস হালায় ডিজে করতো, নাইলে তো আর আমাগো বিদেশ আসা হইতো না।
লেখক: সঙ্গীতশিল্পী
























