ইউরোপ এক সভ্য চোর!

রিফাত বিন সালাম

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৬, ২০১৯

নটরডাম ক্যাথেড্রাল নিয়ে আমাদের একচোখা কান্নার মানেই পুঁজিবাদী অশ্রু। দার্শনিক নোওম চমস্কির বক্তব্য কিছুটা এমন ছিল, অর্থাৎ তার সার কথা, দুনিয়ার নানা প্রান্তের মানুষ পশ্চিমের দেশগুলোতে ছুটছে কারণ পশ্চিমের দেশগুলো সারা দুনিয়াকে ধ্বংস করেছে।

ফ্রান্সের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনার একটি প্যারিসের মধ্যযুগীয় নটরডাম ক্যাথেড্রাল। সোমবারের আগুনে তা অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। ৮৫০ বছরের প্রাচীন ভবনটি পুরোপুরি তৈরি করতে সময় লেগেছিল দুই শতকেরও বেশি। এরপরে যা হয়েছে তা খুব স্বাভাবিক অর্থাৎ দুনিয়ার তামাম একচোখা মানুষেরা কান্নাকাটি করছে। এই কান্না কেন একচোখা? এই অসময়ে কি এই প্রশ্ন তোলা ঠিক হবে? ন্যায় প্রশ্নের সময়-অসময় থাকে না। সব সময় এই প্রশ্ন ন্যায়। কারণ এই কান্না আরো আগেই শুরু করা উচিত ছিল আমাদের, নটরডাম ক্যাথেড্রালের চেয়েও মহান শিল্প লুট হয়েছে গত ২০০ বছরে, হয়তো আরো বা বেশি সময় ধরে। ফ্রান্স নিজেও সে লুটের ভাগ নিয়েছে নানা সময়ে। ফ্রান্সের মিউজিয়ামগুলোতে যে শিল্পকর্ম আছে, তার অধিকাংশই লুটের মাল।

সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে প্রাচীন শিল্প-সাহিত্যও নিস্তার পায়নি। এই লুটের পরিমাণ হিসাব করা প্রায় অসম্ভব। ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়া স্বয়ং কোহিনুর হীরা চুরি করেন, লুটও বলা যায় এটাকে। কারণ ভারত বারবার ফেরত চাওয়ার পরও তা ফেরত দেয়া হয়নি। এমনকি কিছুদিন আগে পাকিস্তান সরকারও এই হীরা ফেরত চেয়েছিল। তাও নাকচ করে ব্রিটিশরা। ইউরোপ এক সভ্য চোর!

শুধু তাই নয়, ১৯০৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি খনি থেকে পাওয়া যায় `কলিনান ডায়মণ্ড’। সেটিকে ৯ টুকরা করা হয় এবং এর বেশিরভাগই রয়েছে ব্রিটেনের রাজমুকুটে। ‘ব্রিটিশরা যদি মিশরকে নতুন করে আবিষ্কার না করতো, তাহলে হয়তো প্রাচীন মিশরের সভ্যতা সম্পর্কে মানুষ অন্ধকারেই থাকতো’ এই জঘন্য, ফালতু আর অবান্তর বাণী বহুবার শোনা হয়ে গেছে আমাদের। প্রাচীন মিশরকে যারা ৬০০০ বছর ধরে আগলে রেখেছিল, সেই মিশরীয়রাই একদিন ঠিক নিজেদের ইতিহাস আবিষ্কার করতো, তারাই নিজেদের জন্মদাতা, ব্রিটিশরা না। বরং ব্রিটিশরা প্রাচীন মিশর উদ্ধারের নামে লুটপাট চালিয়েছে প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। শুধু মিশর না, পুরো দুনিয়া জুড়ে একই কাণ্ড করেছে।

ভারতবর্ষও তা থেকে নিস্তার পায়নি, কোহিনূর কোথায়? টিপু সুলতানের তলোয়ার, রঞ্জিত সিংহের আসন, নাসাক হীরা, বুদ্ধপদ, বৌদ্ধমূর্তি, শাহজাহানের পেয়ালা কোথায়? প্রাচীন ভারতের আরো হাজারো শিল্পকর্ম ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কিভাবে গেল? কিছুদিন আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালেই ব্রিটিশদের লুট করা সম্পদ ফেরত চেয়েছে ইথিওপিয়া। ওই অঞ্চলের প্রাচীন সম্পদ একের পর এক নিলামে তোলা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। এটা ব্রিটিশদের একার দোষ না, বরং বলা যায় এই দোষ সাম্রাজ্যবাদের চরিত্রগত দোষ। ইউরোপীয় শক্তিধর দেশগুলোর চরিত্রও ভিন্ন কিছু না।

তবে হাল আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল সবচেয়ে নির্মম। সিরিয়া থেকে প্রায় ৫০ টন সোনার জিনিস যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছে সেনারা। সাদ্দামকে উৎখাত করে ইরাক দখল করার সময় ব্যাবিলনের ওপর হামলা চালিয়ে সেখানে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন মহামূল্যবান অনেক পুরাকীর্তি ধ্বংস করেছে। তারা কায়রোর জাদুঘরগুলোতে লুণ্ঠন চালিয়েছে। হাজার হাজার শিল্পকর্ম এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন লুটপাট করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চালান করেছে। কালো বাজারে সে সব মাল ঘুরছে।

আরো জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাবিলনে বোমাবর্ষণ করে এবং কায়রোর জাদুঘর লুণ্ঠন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্তান অর্থাৎ `ইসলামিক স্টেট` ইরাকের মশুল ইত্যাদি অঞ্চল দখল করে সেখানে গ্রিক, রোমান এবং অ্যাসিরীয় আমলের অনেক স্থাপত্য ধ্বংস করেছে। কিছু স্থাপত্য পাচারও হয়েছে, এসব তথ্য দিয়েছে খোদ পশ্চিমা মিডিয়া। জাদুঘর ধ্বংস ও লুটপাট করেছে। সিরিয়ায় গ্রিক-রোমান আমলের অতি মূল্যবান প্রাচীন স্থাপত্য ধ্বংস করেছে।

শুধু এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য না, আফ্রিকার প্রাচীন শিল্পের বাজারও ভালো। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখা যাবে, প্রায় প্রায় মার্কিন-ইউরোপীয় আর্ট নিলামকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুনিয়ার নানা দেশের প্রাচীন শিল্পকর্ম বিক্রি করে, যার অধিকাংশই লুটের মাল।

আমরা বা যাদের শিল্প এতোকাল ধরে লুট হলো তারা কি সেগুলো ফেরতের জন্য যুদ্ধ করবে? যদি যুদ্ধের সামর্থ্য না থাকে তাহলে জাতিগত ঘৃণা দেখাবে? নাকি কাঁদবে নীরবে? আমরা এই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো না? এই প্রশ্ন করতে হবে আবার।