ইতালো কালভিনো

ইতালো কালভিনো

ইতালো কালভিনোর গল্প ‘চাঁদের দূরত্ব’

ভাষান্তর: রথো রাফি

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০

ইতালো কালভিনোর জন্ম ১৯২৩ সালে হাভানার সান্তিয়াগো ডি লাস ভেগাসে। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষিবিদ, যার বদৌলতে তার শৈশবের একটি অংশ কেটেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয়। আর মা ছিলেন একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী। পরবর্তী জীবনে কালভিনো যখন বিখ্যাত হয়ে উঠছেন আর বিশ্বের সামনে হাজির করছেন চির পরিচিত ভঙ্গিমায় অভিনব গল্প কথনশৈলী, তখন এ দুজনের উত্তরাধিকার হিসেবে তাকে খুব গভীরে শনাক্ত করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিলেন ইতালির তুরিনে। সে সময় থেকেই বাম-বলয়ের সঙ্গে তরুণ কালভিনোর ওঠাবসা শুরু। যুদ্ধের পর যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। কিন্তু পরে ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাঙ্গেরি আক্রমণের প্রতিবাদে পার্টি রাজনীতি থেকে সরে আসেন। কিন্তু গোটা সময়ে লেখায় কখনো খামতি হয়নি। মূলত ছোট গল্পই তার বিচরণ ক্ষেত্র। লিখেছেন তিনটি উপন্যাসও। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে, দ্য ক্রো কামস লাস্ট, দ্য ব্যারন ইন দ্য ট্রিজ, কসমিকোমিকস ও দ্য পাথ টু দ্য নেস্ট অব স্পাইডার্স এবং দ্য হোয়াইট শুনার, ইয়ুথ ইন তুরিন ও দ্য কুইনস নেকলেস। পেশায় সাংবাদিক এ লেখক মারা যান ১৯৮৫ সালে। ছাড়পত্র ডেস্ক

স্যার জর্জ এইচ ডারউইনের মতে, চাঁদ এক সময় পৃথিবীর একেবারেই কাছে ছিল। তারপর জোয়ার ক্রমে তাকে দূরে ঠেলে দেয়। চাঁদের নিজের কারণেই পৃথিবীর জলভাগে সৃষ্টি হয় জোয়ার, যেখানে পৃথিবী ক্রমে নিজের শক্তি হারায়।

কী ভালোভাবেই না আমি জানি... বুড়ো কফওফক চেঁচিয়ে ওঠলো, বাকি তোমরা স্মরণই করতো পারো না, আমি ঠিকই পারি। সবসময়েই আমাদের উপর থাকতো শে, সেই বিশাল চাঁদটা: যখন শে পুর্ণ গোল হয়ে উঠতো— দিনের মতোই আলোকিত হতো রাতগুলো, তবে ওই আলো ছিল ঘি-রঙের— দেখে মনে হতো শে আমাদের চেপে চিড়ে চ্যাপ্টা করে দেবে; আর যখন শে একেবারেই নতুন, বাতাসে উল্টে যাওয়া কালো ছাতার মতো আকাশে গড়াগড়ি যেত, আর যখন ক্রমে শে বাড়তে থাকতো, তার শিংগুলো এত নিচে নামিয়ে এত ঝুঁকে আসতো, মনে হতো গ্রহের গায়ে গুতো মারবে, এবং সেখানেই আটকে যাবে। চাঁদের ষোলকলার এই পুরো প্রক্রিয়াটা ভিন্নভাবে কাজ করতো তখন: কারণ সূর্যের থেকে দূরত্ব, এবং কক্ষপথগুলো, এবং একটা কিছু বা ভিন্ন কিছুর কৌণিকতা, ভুলে গেছি কী তা, ভিন্ন ছিল; যেহেতু পরিক্রমণের জন্য, পৃথিবী ও চাঁদ একসাথে সেঁটে থাকতো, যেমনটা ছিল, এ কারণে, আমরা স্বাভাবিকভাবেই মিনিটে একবার করে পাক খেতাম, ওই বিশাল রাক্ষসদুটি একে অপরের ছায়াতলে থাকা বজায় রাখতো সারাক্ষণই, প্রথমে একটা, তারপর অন্যটা।

কক্ষপথ? অবশ্যই উপবৃত্তাকার: এক মুহূর্তে আমাদের দিকে ছুটে আসতো তো, পর মুহূর্তেই ছুটে যেত দূরে। চাঁদ খুবই কাছে এলে জোয়ারে জলের বুক এত উঁচু হয়ে ওঠে, যে ঢেউয়ের উপর কেউই টিকে থাকতে পারতো না। পূর্ণিমার রাতগুলোতে চাঁদ খুবই খুবই নিচু হয়ে আসতো, আর স্রোতের বুক এত উঁচু হতো যে, সাগরের বুকের উপর চাঁদ প্রায় নেমেই আসতো, মাত্র চুল পরিমাণ ব্যবধান থাকতো; যাই হোক, কয়েক গজ মাত্র। চাঁদে চড়া? চড়তাম তো অবশ্যই। নৌকো বেয়ে চাঁদের দিকে গেলেন, চাঁদের ঠিক নিচে এলেন, একটা মই উঁচু করলেন তার দিকে, এবং বেয়ে উঠলেন। বেশ, হয়ে গেল।

যে-জায়গাটায় সবচেয়ে নিচু ছিল চাঁদ, শে যখন পেরিয়ে যেত, সে-জায়গাটা ছিল জিংকের টিলায় ভরা। ছোট নৌকা নিয়ে আমরা ভেসে পড়তাম। তখনকার দিনে যে ধরনের নৌকা ছিল আর কী, গোল এবং সমতল, কর্কের তৈরি। একসাথে বেশ ক’জন চড়তে পারতাম: আমি, ক্যাপ্টেন, ভহড ভহড, তার বউ, আমার বধির চাচাত ভাই, আর মাঝে মাঝে পিচ্চি জলটহলজ— শে তখন বারোর কাছাকাছি। সেসব রাতে পানি খুবই প্রশান্ত থাকতো, এত রুপালি যে পারদ মনে হতো, ছিল বেগুনি রঙের মাছ, চাঁদের টান এড়াতে পারতো না, একদম জলের পিঠে ভেসে উঠতো, সমস্ত মাছই, অক্টোপাসেরও একই দশা হতো, একই দশা সাফরন মেডুসাদেরও। ক্ষুদে প্রাণিদের ওড়াউড়ি সবসময়েই লেগে থাকতো— ছোট কাঁকড়া, স্কুইড, এমনকি ছোট ছোট আগাছাও, হালকা আর পাতলা, এবং কোরাল উদ্ভিদও— সাগরের বুক থেকে যারা ছিটকে যেত তারা চাঁদে গিয়ে ঠোক্কর খেতো, চুনসাদা সে-ছাদ থেকে তারা ঝুলতো, কিংবা ভেসে থাকতো বাতাসে, আলোকবিচ্ছুরণ করতে থাকা এদের একেকটা ঝাঁক ঠেলে ঠেলে আমাদের এগোতে হতো, তাদের গায়ে কলাপাতা দিয়ে ঝাঁট দিতে দিতে।

এভাবেই কাজটা সারতাম আমরা: একটা মই থাকতো নৌকায়। একজন মইটাকে উঁচিয়ে ধরতো, আরেকজন চড়তো, তৃতীয় কেউ দাঁড় বাইতে থাকতো, যতক্ষণ-না আমরা চাঁদের ঠিক নিচটায় চলে আসতাম; আর একারণেই নৌকায় একসাথে অনেককে থাকতে হতো (আমি কেবল আসল লোকদের কথাই উল্লেখ করলাম)। মইয়ের চূড়ায় থাকতো যে-লোকটা, নৌকা চাঁদের কাছে এলেই সে ভয় পেয়ে যেত, চেঁচিয়ে উঠতো: ‘থামো, থামো, আমার মাথা ফেটে যাবে তো!’ মাথার উপর চাঁদটাকে দেখে আপনারও একই দশা হতো, বিশাল আর তীক্ষ্ণ কাঁটায় ভরা, আর দাঁতালো কাঠকরাতের মতো তার ধারগুলো। এখন হয়তো ভিন্ন রকম, কিন্তু তখন চাঁদ তেমনি ছিল, কিংবা চাঁদের নিচটা, মানে তলপেটটা, যে-অংশটা পৃথিবীর বুকের একবারে কাছাকাছি দিয়ে যেত, আর প্রায় ঘষাই খেতো, তীক্ষ্ণ ধারালো আঁইশের স্তরে ঢাকা ছিল। তা দেখতে মাছের পেটের অংশের মতোই ছিল, এমনকি গন্ধটাও মাছের মতোই, যতটা মনে করতে পারি, একেবারে মাছের মতো না-হলেও প্রায়-একইরকম, ভাঁপানো রুইয়ের মতো অনেকটা।

বাস্তবে মইয়ের চূড়ায় শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে যদি হাত তুলতেন, চাঁদকেই আপনি ছুঁতে পারতেন। সতর্কভাবে আমরা হিসেবেনিকেশ করে নিয়েছিলাম (আমরা তখনো চাঁদ দূরে সরে যাচ্ছে এমন সন্দেহ করতাম); আপনি কোথায় হাতটা ফেলছেন সে-বিষয়ে শুধু সাবধান থাকতে হতো। আমি সবসময়েই একটা আঁইশ বাছাই করতাম যেটাকে মনে হতো বেশ বেগবান (আমরা সবসময়েই পাঁচ-ছয়জনের দল নিয়ে নৌকায় চড়তাম) তারপর, একটা হাতে প্রথমে তা আঁকড়ে ধরতাম, তারপর দুই হাতেই, সাথে সাথেই টের পেতাম মই আর নৌকা নিচে সরে যাচ্ছে, চাঁদের গতি আমাকে পৃথিবীর টান থেকে ঠিকই ছিনিয়ে নিচ্ছে। হ্যাঁ চাঁদটা এতই শক্তিশালী ছিল যে, আপনাকে শে উপরে টেনে তুলতো; আপনি একটা থেকে অপরটায় পেরিয়ে যাওয়ার সময় তা টের পেতেন। আপনাকে এক ঝটকায় নিজেকে ঘুরিয়ে নিতে হতো, ডিগবাজির মতো, আঁইশের চাঙর আঁকড়ে, পা দুটি মাথার উপর ছুঁড়ে দিয়ে, যতক্ষণ-না আপনার পা চাঁদের পিঠে গিয়ে লাগছে। পৃথিবী থেকে দেখা যেত, আপনি যেন নিচের দিকে মাথা দিয়ে সেখানে ঝুলে রয়েছেন, কিন্তু আপনার নিজের কাছে তা ছিল স্বাভাবিক এক অবস্থা, একমাত্র অস্বস্তিকর ব্যাপার ছিল যখনই আপনার চোখ উপরে তুলতেন, দেখতে পেতেন আপনার মাথার উপর একটা সাগর, ঝলমল করছে, নৌকাটিও বাকি লোকজন নিচের দিকে উল্টে রয়েছে, আঙুরের ঝোপ থেকে আঙুরের থোকার মতো ঝুলে রয়েছে।

আমার চাচাতভাই, কানে খাটোটা, ওইসব ঝাপাঝাপির কাজে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছিল। ওর ময়লা হাত চাঁদের পিঠ আকড়ে ধরার সাথে সাথে (মই থেকে লাফ দেয়ার ক্ষেত্রে সে সবসময়েই সবার আগে) দক্ষ ও সংবেদনশীল হয়ে উঠতো সে, এক মুহূতের্ই। তারা ঠিক তখনই দেখতে পেত, সে কোন জায়গায় নিজেকে আঁকড়ে রাখতে পারলো; আসলে তার হাতের পাতার চাপ দেয়াটুকুই উপগ্রহটির কঠিন উঁচুনিচু পিঠে তাকে আটকে রাখতে যথেষ্ট বলে মনে হতো। একসময় তো ভাবতাম, হাত তুললেই বুঝি চাঁদটা তার দিকে ছুটে আসে।

পৃথিবীতে নেমে আসতে তাকে ততটাই দক্ষতা দেখাতে হতো, এই কাজ আরো কঠিন। আমাদের হাতগুলো উপরে তুলে যতটা উঁচুতে সম্ভব আমরা লাফিয়ে উঠতাম (চাঁদ থেকে দেখলে এমনই মনে হতো। অর্থাৎ, পৃথিবী থেকে দেখলে, নিচে ঝাঁপ দেয়ার মতো মনে হতো বরং, কিংবা নিচের দিকে সাঁতরে নেমে আসা, আমাদের দিকে হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে), অন্য কথায়, পৃথিবীর পিঠ থেকে উপরের দিকে লাফিয়ে ওঠার মতো, এক্ষেত্রে এখন আর কোনো মই নেই, চাঁদেও এমন কিছু নেই যে, চাঁদের পিঠ থেকে নিচের দিকে ঝুলিয়ে দেয়া যায়। এখন হাত তুলে লাফের বদলে আমার ভাইটা চাঁদের পিঠের দিকে বাঁকা হয়ে পড়তো, ঘূর্ণি-ঝাপের জন্য যেন মাথাটা নিচু করছে মনে হতো, এরপরই হাত দিয়ে চাঁদের পিঠে ধাক্কা দিয়ে লাফ মারতো। নৌকা থেকে তাকে দেখতে পেতাম, বাতাসে নেমে আসছে সে, যেন চাঁদের বিশাল বলটাকে ছুঁড়ে মারবে বলে আঁকড়ে আছে সে এবং ওটাকে ঠোকাঠুকি করছে, হাতের তালু দিয়ে ঠুকছে; তারপর তার পা যখন নাগালে আসে, আমরা কোনো-না কোনোভাবে তার পায়ের গোড়ালি আঁকড়ে ধরি, টেনে নৌকায় নামিয়ে আনি তাকে।

এখন আপনি জিগ্যেস করতে পারেন, কেন আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদে যেতাম; আমি নিশ্চয় আপনাকে তা ব্যাখ্যা করবো। দুধ সংগ্রহ করতে যেতাম আমরা, বড় একটা চামচ ও বালতি নিয়ে। চাঁদের দুধ খুবই ঘন, ক্রিমের পনিরের মতো অনেকটা, আঁইশের একটার সাথে অপরটার মাঝের ফাঁকা-জায়গাতেই এই দুধ তৈরি হয়, প্রেইরির সমতল ভূমি, বন আর হ্রদের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় চাঁদে পৃথিবীর যেসব জৈব ও অজৈব বস্তু উড়ে আসতো সেসব ফার্মেন্টেশনের, ফলে পচে-গলে তৈরি হয় এ দুধ। এটা মূলত সবজিরস, টেডপুলস, বিটুমিন, লেনটিলস, মধু, স্টার্চ, ক্রিস্টাল, স্টারজিয়নের ডিম, মোল্ড, পরাগ, জিলাটিন জাতীয় উপাদান, তাপ, রেজিন, মরিচ, খনিজ লবণ, দহিত অবশেষ দিয়ে তৈরি। চামচটা আঁইশের গভীরে ডুবিয়ে দিলেই হলো, চাঁদের খরখরে এলাকাটা এসব আঁইশে ছাওয়া ছিল, ওই মূল্যবান নোংরা জঞ্জালে ভরা চামচটি তুলে আনলেই হলো এবার। বিশুদ্ধ নয়, নিশ্চয়; প্রচুর আবর্জনা থাকতো। ফার্মেন্টেশনে (বিস্তৃত মরুভূমির তপ্ত বাতাসের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় এমনটা ঘটতো) সমস্ত বস্তুই গলতো না অবশ্য; কিছু বস্তু অবিকৃতই থাকতো: ফিঙ্গার নেইলস আর কার্টিলেজ, বোল্টস, সি-হর্স, নারকেল-সুপারি, পেডাঙ্কলস, হাঁড়ি-পাতিলের টুকরাটাকরা, মাছের কাঁটাকোটো, এমনকি মাঝে মাঝে চিরুনিটাও। চাঁদের লেই সংগ্রহের পর পরিশোধন করে নিতে হতো। সেটা কঠিন কাজ নয়। পৃথিবীতে একে পরিবহন করে আনাই ছিল কঠিন। দুইহাতে চামচটাকে আঁকড়ে চামচের বস্তুটাকে বাতাসে ছুঁড়ে দিতাম, চামচাকে নিক্ষেপক হিসেবে ব্যবহার করতাম—  আমরা এইভাবেই এই কঠিন কাজটা সারতাম। মাখনটি ওড়ে যেত, এবং আমরা যদি যথেষ্ট জোড়ে ছুঁড়তে পারতাম, মাখনটা ছাদে ঠোকা খেত, আমি ছাদ বলতে সমুদ্রের পিঠ বোঝাচ্ছি। একবার সাগরের পিঠে এসে পড়তো তো ভাসতে থাকতো, তখন একে সহজেই নৌকায় তুলে নেয়া যেত। এই কাজে আমার বধির ভাইটা প্রতিভার পরিচয় দিতো; তার শক্তি ছিল আর ছিল লক্ষ্যে ভেদের দক্ষতা; জোড়ে ছুড়ে এক ঢিলেই সে বালতিতে মাখনটা ফেলতে পারতো, আমরা নৌকা থেকে তার দিকে বালতিটা উঁচিয়ে ধরতাম। আর আমিতো লক্ষ্যভেদ প্রায় করতেই পারতাম না; চামচের মাখন প্রায়ই চাঁদের টানের বাইরে যেতে পারতো না, আর তারা ফের আমার চোখের উপরই এসে পড়তো।

আমার চাচাতো ভাইটার যেসব বিষয়ে দক্ষ ছিল, তার সব কিন্তু এখনো বলিনি আমি। আঁইশ থেকে চাঁদের দুধ সংগ্রহের কাজ তো তার কাছে নেহায়েত ছেলেখেলা। চামচের বদলে মাঝে মাঝে তার খোলা হাত বা একটা আঙুল ঢুকিয়ে দিলেই হলো আইশের ফাঁকে। কোনো নিয়ম মেনে সে এগোতো না, বরং একটা থেকে আরেকটায় লাফিয়ে লাফিয়ে, বিচ্ছিন্ন যত এলাকায় চলে যেত সে, যেন চাঁদে সে জাদু দেখাচ্ছিল, চাঁদকেই মুগ্ধ করতে যেন মগ্ন সে, বা চাঁদকেই কাতুকুতু দিচ্ছিল। আর যেখানেই সে হাত রাখতো দুধ ছিটকে বেরোতো, যেন তা গর্ভবতী ছাগলের বাট থেকে বেরিয়ে আসছিল। তাই বাকিরা তার কাজকারবার অনুকরণ করে চলতাম, তার বের করতে থাকা দুধ আমরা চামচে তুলতাম, প্রথমে এই এখান থেকে তো পরে ওই ওখান থেকে, কিন্তু আকস্মিক তা সবসময়েই, যেহেতু কোনো স্পষ্ট বাস্তবসম্মত যুক্তি মেনে কাজ করতো না বধির ছোকরাটা।

এমনসব জায়গা আছে যেগুলো সে ছুঁয়ে দেখতো শুধু ছোঁয়ার কৌতূহলেই। যেমন দুই আঁইশের মাঝে চাঁদের মাংসের খোলা ও কোমল ভাঁজ। হঠাৎ হঠাৎ আমার ভাইটা যে কেবল তার আঙুলই চেপে ধরতো তা নয়,— সতর্ক মাপা লাফ দিতো— পায়ের বুড়ো আঙুলও ডুবিয়ে দিতো (সে খালি পায়েই চাঁদে চড়তো), আর মনে হতো এতেই বুঝি সবচেয়ে মজা, লাফঝাপের সময়ে তার গলা থেকে বেরোনো রসালো-শব্দ খেয়াল করলেই তা বোঝা যেত।

আঁইশ চাঁদের মাটিতে নিয়মিতভাবে সাজানো নয়, বিবর্ণ পিচ্ছিল কাদায় ভরা নাঙা এবং এলোমেলো টিলার সারিতে ছাওয়া। এই নরোম জায়গাগুলো ছেলেটাকে লাফিয়ে পাল্টি খেতে উৎসাহিত করতো, কিংবা পিছলে পাখির মতো উড়তে, যেন সে চাঁদের মণ্ড সমস্ত শরীরে মাখতে চায়। সে এমন করতে করতে দূরে চলে যেত, আমাদের জায়গা থেকে তাকে আর দেখতে পেতাম না। চাঁদে বিশাল বিশাল প্রান্তর পড়ে আছে, আমরা কোনো কারণেই বা নেহায়েত কৌতূহলেও সেসব জায়গা মাড়ানোর কথা ভাবতাম না, চাচাতো ভাইটি ঠিকই ওইসব এলাকায় হারিয়ে যেত, আমার সন্দেহ হয়েছিল, ওই সব লাফ-ঝাপ, পাল্টি-খাওয়া আমাদের চোখের সামনে নিজেকে বাজিয়ে দেখা, আসলে গোপন কোনো বিষয়েরই প্রস্তুতি, একটা পূর্বমহড়া, ওই গোপন জায়গায় পালানোর।

জিংকের টিলাগুলো থেকে দূরে ওইসব রাতে আমরা বিশেষ একটা অনুভূতিতে ডুবে যেতাম; আনন্দ, না-জানি কী হয় তেমন একটা অনুভূতির চোরাটান, যেন আমাদের করোটির ভেতর, মগজ নয়, মনে হলো চাঁদের আকর্ষণে একটা মাছ ভেসে চলেছে। তাই আমরা ঘুরাফেরা করলাম, খেললাম, এবং গান গাইলাম। ক্যাপ্টেনের বউ হার্প বাজাচ্ছিল; তার হাতপা কী লম্বা, কী রুপালি, যেন ইল মাছ। ওইসব রাতে বগল তার কালো এবং রহস্যময় যেন সি আর্চিন; মধুর থেকে মধুর হয়ে উঠতো হার্পের মূর্চ্ছনা। আর করুণ, অসহনীয় হয়ে উঠতো এর টান। চেঁচিয়ে উঠতাম আমরা, যত না মূর্চ্ছনার সাথে সঙ্গত করতে, তার চেয়েও বেশি করতাম ওই মূর্চ্ছনা আমাদের কানে যাতে না ঢোকে।

স্বচ্ছ মেডুসাগুলো সাগরের বুকে ভেসে উঠতো। এক মুহূর্ত থমকে থাকতো, পর মুহূর্তেই উড়ে চলতো চাঁদের দিকে। পিচ্ছি জলটহলজ বাতাসের বুক থেকে এদের ধরতে পেরে আনন্দ পেত খুব, ধরা সহজ নয় যদিও। একবার একটা মেডুসাকে ধরতে যেই হাত বাড়ালো, তার শরীরটা একটু লাফিয়ে উঠলো, বেশ শেও মুক্ত হয়ে গেল। হালকা পাতলা ছিল শে, তাই চাঁদের টান ছিন্ন করতে, এবং তাকে ফিরিয়ে আনতে পৃথিবীর প্রয়োজনীয় টান তৈরিতে যে ভার দরকার তার চেয়ে পিচ্চির ভার এক কি দুই আউন্স কম ছিল। তো উপরের দিকে শে উড়ে যেতে লাগলো, মেডুসাদের ভিড়ে, সমুদ্রের উপর বাতাসে ভাসতে লাগলো, ভয় পেলো, চেঁচিয়ে কাঁদলো, হাসলো তারপর, খেলতেও শুরু করলো একসময়, ধরতে থাকলো উড়ন্ত মেডুসা আর মিন্নোদের, এদের কিছু মুখেও পুরে ফেললো, চিবোতে লাগলো। শিশুটার নাগাল পেতে আমরা খুব জোরেসোরে নৌকা বাইতে লাগলাম, চাঁদ তার চক্রপথে ছুটতে লাগলো, সমুদ্রের ওইসব প্রাণীর ঝাঁক সাথে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে, আকাশের ভেতর দিয়ে, আর একটা আরেকটার সাথে প্যাঁচ খেয়ে লম্বা সব সমুদ্র উদ্ভিদেরা ট্রেনের মতো চলতে লাগলো, জলটহলজ ওই জটলার মাঝেই ঝুলে রইলো। তার বেনী দুটি চাঁদের দিকে প্রসারিত হয়ে ছুটে যেতে চাইলো, মনে হচ্ছে বেনী দুটি নিজে থেকে উড়ছে; কিন্তু সারাক্ষণই শে বাতাসে হাত পা ছুঁড়ছিল, গড়াগড়ি খাচ্ছিল, শে চাঁদের প্রভাব থকে মুক্ত হতে লড়াই করছে, আর এই ওড়াউড়ির ভেতরে তার জুতা হারিয়ে গেল— পৃথিবীর টানে মোজা পা থেকে ছুটে পতপত করে উড়তে লাগলো। মইয়ের উপর চড়ে তাদের ধরতে চাইলাম।

বাতাসের ছোট প্রাণী খাওয়ার ভাবনা একটা ভাল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জলটহলজের যতই ওজন বাড়তে লাগলো, ততই শে পৃথিবীর দিকে তলিয়ে যেতে লাগলো। আসলে ভাসতে থাকা ওই প্রাণীদের মধ্যে শে-ই সবচেয়ে বড়। শামুক, সমুদ্র উদ্ভিদ আর প্লাঙ্কটন তার টানে পড়লো। আর দ্রুতই তার শরীর ছোট ছোট সিলিসিয়াস কোল, চিটিনিয়াস কারাপাসেস এবং সমুদ্র উদ্ভিদের আঁশে ঢাকা পড়লো। এবং পড়ে ওই জটলার ভেতর শে হারিয়ে গেল। যতই শে চাঁদের প্রভাব মুক্ত হতে লাগলো, ততই শে নিচে নামতে লাগলো, যতোক্ষণ-না জলের বুকে এসে নামলো।

তাকে বাঁচাতে আমরা দ্রুত এগিয়ে গেলাম। নৌকায় টেনে তুললাম। তার শরীর তখনো চুম্বকীয় অবস্থায়, তার শরীর থেকে ঘষেমেজে সবকিছু ছাড়াতে পরিশ্রম হলো প্রচুর। কচি কোরালগুলো তার মাথায় ক্ষত করে ফেলেছিল। তার চুলে চিরুনি চালালে প্রতিবারই ক্রে ফিশ ও সার্ডিনের এক পশলা করে বৃষ্টিপাত হলো। চোখের পাতায় জোঁক কামড়ে থাকার ফলে চোখ তার বন্ধ হয়ে গেল। অসংখ্য স্কুইডের শুঁড় তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। তার ছোট জামাটি মনে হলো এখন আগাছা আর স্পঞ্জ দিয়ে বোনা। আমরা সেসবের সবচেয়ে বাজেগুলো গা থেকে ছাড়িয়ে নিলাম। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরেও শে নিজের গা থেকে ফিন আর শেল বেছে চললো, তার চামড়া ডায়াটমের বিন্দু বিন্দু দাগে ভরে গেল, আর এই দাগ তাকে আর কখনোই ছেড়ে যায়নি— যারা তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করতো না তাদের মনে হতো, তার শরীর বুঝি তিলে ছাওয়া।

আপনি এ থেকেইে ধারণা পাবেন, পৃথিবী ও চাঁদের প্রভাব কেমন। আসলে সমান এবং তারা নিজেদের মাঝের জায়গা নিয়ে কিভাবেই বা লড়াই করতো। আপনাদের অন্যবিষয়ে বলবো, কোনো বস্তু উপগ্রহ থেকে পৃথিবীতে নেমে এলেও চাঁদের প্রভাবে চার্জ হয়ে থাকতো তখনো, এবং পৃথিবীর টানকে উপেক্ষা করতো। এমনকি আমি বড় ও ভারি ছিলাম যদিও, চাঁদে যতবারই গিয়েছিলাম, পৃথিবীর উপর ও নিচের সাথে খাপ খেয়ে নিতে কিছু সময় লেগেছিল। অন্যদেরকে আমার হাতপা টেনে ধরে রাখতে হতো, চলমান নৌকার একটি বাঞ্চের সাথে আমাকে শক্ত করে বেঁধে নিলেও আমার মাথা ঝুলে থাকতো, পাগুলো আকাশের দিকে মুখ করে থাকতো তখনো।

‘থাকো, আমাদের ধরে থাকো!’ চেঁচিয়ে বলতো তারা, ওইসব চেষ্টাচরিত্রের ভেতর আমি মাঝে মাঝে মিসেস ভহডভহড এর একটা স্তন আঁকড়ে ধরে এই আবিষ্টতা থেকে মুক্ত হতে পারতাম। স্তন দুটো ছিল গোল আর দৃঢ়, এবং স্পর্শ ছিল মধুর আর নিরাপদ, এদের টানও চাঁদের টানের সমানই শক্তিশালী, এমনকি তার চেয়েও বেশি, যখন আমি তাকে ঝাপটে ধরে নামতাম, বিশেষ করে আমার অন্যহাতটা তার কোমর জড়িয়ে ধরার সুযোগ করে নিতে পারতো যদি, এবং এর মাধ্যমে ফের আমাদের পৃথিবীতে নিজেকে নামিয়ে আনতাম, এবং নৌকার তলায় ধপাস করে পড়তাম, ক্যাপ্টেন ভহড ভহড আমার মুখে এক বালতি পানি ছুঁড়ে দিয়ে সেখান থেকে আমাকে তুলে আনতেন।

এভাবে ক্যাপ্টেনের বউয়ের প্রতি আমার প্রেমের গল্পের শুরু, আর আমার যন্ত্রণারও। কারণ ক্যাপ্টেনের বউ কার দিকে নিবিড় তাকিয়ে থাকতো তা বুঝতে আমার বেশি সময় লাগেনি। আমার চাচাতো ভাইটা যখনই উপগ্রহটার গায়ে হাতের পাতা চেপে ধরতো, মিসেস ভহডভহডকে লক্ষ্য করতাম আমি, চাঁদের সাথে বধির ভাইটার ঘনিষ্টতা মহিলার ভেতর উত্তেজনা ছড়াতো— তার চোখে তা আমি ঠিক পড়তে পারতাম; চাঁদের রহস্যময় অভিযানে যখন সে হারিয়ে যেত, মহিলাকে অস্থির হয়ে পড়তে দেখতাম আমি, পিন আর সুঁইয়ের উপর যেন শে, তখনই ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। মিসেস ভহডভডের চাঁদের প্রতি কত যে ঈর্ষা, আর আমার ঈর্ষা চাচাতো ভাইটার প্রতি। তার চোখ হীরের তৈরি যেন, মিসেস ভহড ভহডের; যখন শে চাঁদের দিকে তাকাতো চোখ জ্বলজ্বল করতো, দৃঢ়তায়, যেনো শে বিড়বিড় করতো, ‘তুমি তাকে আর পাবে না, পাবে না!’ আর নিজেকে আমার এক অচিন লোকের মতো মনে হতো।

এসব বুঝতেই পারতো না বলা যায় আমার চাচাতো ভাইটা। যখন তাকে নেমে আসতে সাহায্য করতাম, তাকে টেনে নামাতাম— যেমনটা বলেছি আপনাদের— তার পা টেনে, মিসেস ভহড ভহড তখন একেবারেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতো, তার নিজের শরীরের ভারের বিপরীতে ওজন বাড়াতে শে কিছুই করার বাকি রাখতো না, তার রুপালি লম্বা বাহু দিয়ে চাচাত ভাইটাকে জড়িয়ে ধরতো। দপদপ করে উঠতো আমার হৃদপিণ্ড (যে সময়ে আমি তাকে ধরে ঝুলে থাকতাম, তার শরীর ছিল কোমল ও দয়ালু, কিন্তু শরীরের সামনেটা নয়, যেভাবে তা আমার চাচাতো ভাইটাকে জড়িয়ে থাকতো) তখনো ভাইটা নির্বিকার থাকতো, তখনো সে চন্দ্রাবিষ্ট।

ক্যাপ্টেনের দিকে চাইলাম, বউয়ের আচরণ সে লক্ষ্য করলো কিনা ভেবে: নোনা পানির আঘাত আর কুচিরেখার কারণে ওই মুখের ভঙ্গিতে কখনোই এর কোনো ছাপ ধরা পড়তো না। যেহেতু সবসময়েই বধির ভাইটা, চাঁদ থেকে ফেরা শেষজন, তার ফেরাটা নৌকা ছাড়ারও একটা ইশারা ছিল। একটা অস্বাভাবিক ভঙ্গি করে তখন লোকটা নৌকার তলা থেকে হার্পটা তুলে বউয়ের হাতে দিতো। হার্প হাতে পেয়ে বউটা খুশি হতো, দুয়েকটা নোটও বাজাতে শুরু করতো। হার্পের ধ্বনি ছাড়া অন্য কিছু বউটাকে বধিরটার কাছে থেকে এত দূরে সরিয়ে নিতে পারতো না। নিচু গলায় আমি বেজে চলা করুণ ঐ গানটা গেয়ে উঠতাম, ‘প্রতিটি উজ্জ্বল মাছ ভাসছে ভাসছে; প্রতিটি কালো মাছ সাগরের তলায় তলায়...’ আর বাকিরা গলা মেলাতো আমার সাথে, শুধু আমার বধির ভাইটা ছাড়া।

প্রতিমাসে উপগ্রহটা সরে যেত, আর জগতের সমস্ত কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো আমার ভাইটা, নিজের নিঃসঙ্গতার ভেতর ফিরে যেত। পরিপূর্ণ গোল চাঁদটার আবির্ভাবই কেবল তাকে উত্তেজিত করতো। সে সময় আমি সবকিছু এমনভাবে করতাম যেন আমাকে চাঁদে যেতে না হয়, ক্যাপ্টেনের বউয়ের সাথে নৌকায় থাকতে পারি। কিন্তু আমার চাচাত ভাইটা যেই মইয়ে চড়তে শুরু করতো, মিসেস ভহড ভহড বলতো, ‘এবার আমিও ওখানে যাব।’ এর আগে এমন ঘটেনি; ক্যাপ্টেনের বউ কখনোই চাঁদে চড়েনি। কিন্তু ভহড ভহড কোনো আপত্তি করলো না। বরং বলা যায়, তাকে ‘ওঠো ওঠো তাহলে,’ বলে চেঁচিয়ে সে-ই মইয়ের উপর প্রায় ঠেলে দিলো, যখন সবাই তাকে চড়তে সাহায্য করতে শুরু করলাম; তাকে পেছন থেকে ধরলাম আমি, আমার বাহুতে তাকে কোমল ও মসৃণ অনুভব করলাম, উপরের দিকে ঠেলতে লাগলাম, তার শরীরে আমার মুখ দিয়েও চাপ দিতে লাগলাম, আমার হাত দুটি দিয়ে তার শরীরে ধাক্কা দিতে লাগলাম, আর যখন বুঝতে পারলাম, চাঁদের এলাকায় শে উঠে যাচ্ছে, আমার ছোঁয়ার বাইরে চলে যেতেই আমার হৃদয় কেঁদে উঠলো। তাই আমি তার দিকেই ছুটতে লাগলাম, চেচাঁতে লাগলাম, ‘তাকে সাহায্য করতে আমিও এক পলক উপরে যাচ্ছি।’

পেছন থেকে আমাকে কেউ যেন টেনে ধরলো। ‘এখানেই থাকো, তোমাকে এখানেই দরকার।’ ক্যাপ্টেন ঠাণ্ডা গলায় নির্দেশ দিলেন আমাকে। ওই মুহূর্তে প্রত্যেকের আকাঙ্ক্ষা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। তবু ঠাহর করতে পারছিলাম না আমি। এমনকি নিশ্চিত নই এখনো, আসলেই তা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পেরেছি কিনা। নিশ্চয়, ক্যাপ্টেনের বউটার বহুদিনের বাসনা ছিল আমার চাচাত ভাইটাকে নিয়ে একাকী ওখানে পালিয়ে যাওয়ার (চাঁদ নিয়ে একাকী ভাইটার পালানো ঠেকাতে অন্তত) বরং সম্ভবত বধিরটার সাথে কোনো চুক্তি মেনে চলার আরো বড় কোনো অভিলাষ ছিল তার। দুজনে একত্রে সেখানে লুকিয়ে থাকার, এবং মাসখানেক চাঁদে থাকার। আমার চাচাতো ভাইটা যেমন বধির ছিল, তেমনি মহিলা যা বোঝাতে চেয়েছিল তা-ও বোঝেনি। কিংবা এমনকি হয়তো বোঝতেই পারিনি সে যে ওই মহিলার বাসনার ধন। আর ক্যাপ্টেন? স্ত্রীর হাত থেকে মুক্ত হওয়ার অধিক কোনো কিছুই সে চায়নি। বস্তুত, ওই উপরে শে আটকে পড়ার পরপরই আমরা দেখলাম সে নিজের অভ্যাসের লাগাম আলগা করে দিলো, নিজের কু-অভ্যাসের ভেতর তলিয়ে গেল, আর এরপর আমরাও বুঝতে পারলাম, কেন সে মহিলাকে আটকে রাখতে কিছুই করেনি। কিন্তু সে কি শুরু থেকেই জানতো, চাঁদের কক্ষপথ প্রসারিত হতে শুরু করেছে?

এ বিষয়টি আমরা কেউই অনুমান করতে পারিনি। আমার বধির ভাইটা মনে হয় তা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু শুধু সে-ই আবছাভাবেই কেবল জানতো বিষয়গুলো। হয়তো সে বুঝতে পেরেছিল, ওই রাতে চাঁদকে বিদায় জানাতেই হবে। হয়তো তাই সে গোপন জায়গাতে লুকিয়ে ছিল। বেরিয়ে এলো যখন নিচে নৌকায় ফিরে আসার সময় ঘনিয়ে এলো। ক্যাপ্টেনের বউয়ের কাজই হলো তার পিছে পিছে ছোটা। ক্যাপ্টেনের বউটাকে আমরা ওই আঁইশভরা এলাকাটি পেরিয়ে যেতে দেখলাম, বেশ কয়েকবার। কি আড়াআড়ি, কি লম্বালম্বিভাবেও, তারপর নৌকায় আমাদের দিকে তাকিয়ে আচমকা থমকে যেতে দেখলাম। যেন জানতে চাইলো বধিরটাকে আমরা দেখেছি কিনা। ওই রাতে বিস্ময়কর কিছু ঘটেছিল নিশ্চয়। সমুদ্র বুক, পূর্ণিমায় যেরকম ফুঁসে টানটান হয়ে উঠতো, তা না হয়ে, কিংবা আকাশের দিকে অল্প একটু বেঁকে উঠেছিল মাত্র। এখন মনে হলো, সে নিচু আর সোজা সমতল। যেন চাঁদের চুম্বক পুরোটা শক্তি আর খাটাচ্ছে না। আর আলো, তাও অন্যান্য পূর্ণিমার রাতের সমাান উজ্জ্বল নয়; রাত্রির ছায়া যেন কোনো একভাবে অনেক ঘন হয়ে পড়েছে। ওখানে থাকা আমাদের বন্ধুরা নিশ্চয় টের পেয়েছিল, কী ঘটেছে। তারা বস্তুত ভয়-বিস্ফারিত চোখেই আমাদের উপর তাকাচ্ছিল। তারা কি আমরা, একসাথে চিৎকার করতে লাগলাম, চাঁদ দূরে চলে যাচ্ছে!

দৌড়াতে দৌড়াতে আমার চাচাত ভাইটা যখন চাঁদের উপর দৃশ্যমান হলো তখনও আমাদের চিৎকার হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। সে ভয় পেয়েছে, কিংবা বিস্মিত হয়েছে বলে মনে হলো না। সে সঠিক জায়গায় হাতের পাতা রাখলো, অন্য সময়ের মতোই ডিগবাজির জন্য নিজেকে বাঁকিয়ে নিলো। কিন্তু এবার মাটি থেকে নিজেকে হাওয়ায় ছুঁড়ে দেয়ার পর ভেসেই রইলো, যেমন পিচ্ছি জলটহলজের বেলায় ঘটেছিল। চাঁদ ও পৃথিবীর মাঝে একমুহূর্ত থমকে রইলো, উল্টে থাকলো, তারপরই প্রচণ্ডভাবে হাতপা ছুঁড়তে লাগলো, স্রোতের বিপরীতে কেউ যেমন সাঁতরায় তেমনভাবেই; খুবই ধীরে আমাদের গ্রহের দিকে এগোতে লাগলো সে।

চাঁদ থেকে অন্যান্য মাঝিরা তার কাজকারবার অনুকরণের ক্ষেত্রে দুনোমনো করছিল। নৌকায় সংগ্রহ করা চাঁদের দুধের কথা ভাবলো না কেউই, সে কাজে তাড়া দেয়নি স্বয়ং ক্যাপ্টেনও। তারা এরমধ্যে অনেক্ষণ অপেক্ষায় পার করে দয়েছে, দূরত্বটা পাড়ি দেয়া তখন মুশকিলের ব্যাপার আমার চাচাত ভাইটার পাল্টি-খাওয়া লাফের অনুকরণ করতেও চেষ্টা করলো না তারা, সেখানে বাতাসে ভাসতে লাগলো। ‘জট বাঁধো, হাবার দল! জট বাঁধো!’ ক্যাপ্টেন চেচিয়ে চললো। এই নির্দেশ পেয়ে মাঝিরা জোটবাঁধতে চেষ্টা করলো, একটা পিন্ডে পরিণত হওয়ার, একত্রে জটা পাকিয়ে নিজেদের ঠেলতে লাগলো যতক্ষণ না পৃথিবীর টানের ভেতরে এসে পড়লো, হঠাৎ করে অনেক দেহের একটা জটলা সমুদ্রে ছিটকে পড়লো, ভীষণ শব্দে জল ছিটকে গেল।

নৌকা তাদেরকে উদ্ধার করতে ছুটে গেল। ‘ক্যাপ্টেনের বউ এখনো আসেনি, একটু থামো তোমরা।’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। ক্যাপ্টেনের বউও ঝাপ দিতে চেষ্টো করলো, কিন্তু তখনো সে চাঁদ থেকে কয়েক ইয়ার্ড নিচে বাতাসে ভাসছিল, বাতাসে তার লম্বা বাহুগুলো ছুঁড়ছিল। মইয়ের উপর উঠলাম আমি, আর একটা কিছু যেন সে আঁকড়ে ধরতে পারে সে লক্ষ্যে তার দিকে হার্পটা উঁচিয়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। এবং আমি তার নাগাল পাচ্ছি না, তার দিকে এগোতে হবে। আমি হার্পটাকে তার দিকে উঁচিয়ে মই থেকে আরো উপরে লাফিয়ে উঠার চেষ্টা করলাম। মনে হলো মাথার ওপরে চাঁদের বিশাল থালাটি আগের মতো নেই। অনেক ছোট হয়ে গেল সেটা, চাঁদটা আমার কাছেই থাকতে চাইলো, কিন্তু আমার দৃষ্টি যেন তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিলো। শূন্য আকাশটা চার্চের চত্বরের মতো ফাঁকা হয়ে পড়লো, তার তলার দিকে তারার সংখ্যা বহুগুণে বাড়তে শুরু করেছিল, আর রাত আমার মাথার উপর শূন্যতার একটা নদী বইয়ে দিলো, আর আমাকে ঝিমুনি ও ভয়ের ভেতর ডুবিয়ে দিলো।

ভয় পাচ্ছি, ভাবলাম আমি,। আমি ঝাপ দিতে ভীষণ ভয় পাচ্ছি। আমি একটা কাপুরুষ। আর ঠিক সে-মুহূর্তেই আমি ঝাপ দিলাম। আকাশের ভেতর আমি পাগলের মতো সাঁতরাতে লাগলাম; হার্পটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম, সে আমার দিকে আসার বদলে কেবলই পাক খেতে লাগলো, তার অস্থির মুখটা প্রথমে একবার দেখালো, তারপরই আমার দিকে তার পিঠ ঘুরিয়ে দিলো।

আমাকে জোরে ধরুন, চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। এরই মধ্যে আমি পেরিয়ে যাচ্ছিলাম তাকে, আমার বাহুর সাথে তার বাহুকে আটকে নিচ্ছিলাম। ‘আমরা জোটবদ্ধ হলে নামতে পারবো।’ তাকে আমার সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরতে সমস্ত মনোযোগ ব্যয় করছিলাম, তাকে পরিপূর্ণভাবে আলিঙ্গনের আনন্দ লুটে নিতে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে নিয়োজন করলাম। এতাই মগ্ন হয়ে পড়লাম যে প্রথম দিকে টেরই পাইনি, তাকে আসলে হালকা অবস্থা থেকে মুক্ত করে নিচ্ছি, কিন্তু চাঁদের উপরেই আবার পড়তে বাধ্য করছি। আমি কি বুঝতে পারিনি? নাকি প্রথম থেকে আমার এমন উদ্দেশ্য ছিল? ঠিকঠাক বুঝার আগেই আমার গলা চিরে চিৎকার বেরিয়ে এলো, ‘আমিই তোমার সাথে সারামাস থাকার সেই লোকটা হতে চাই।’ কিংবা বরং ‘তোমার উপর।’ উত্তেজনার ভেতর আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘তোমার উপর টানা একটা মাস।’ সেই মুহূর্তেই আমাদের আলিঙ্গন টুটে গেল, ছিটকে পড়লাম চাঁদের পিঠে, আমরা এক অপরের থেকে দূরে গড়িয়ে পড়লাম, সেইসব আঁইশের ঠাণ্ডার মধ্যে।

চাঁদের মাটি স্পর্শ করার মুহূর্তে প্রতিবারই আমি উপরে তাকিয়ে দেখতাম, নিশ্চিত ছিলাম যে, মাথার উপর সীমাহীন এক ছাদের মতো পৃথিবীর সমুদ্রটা দেখতে পাব, এবং দেখলামও তা। হ্যাঁ, এবারও দেখতে পেলাম, কিন্তু তা অনেক বেশি উঁচুতে, আর অনেক বেশি সংকুচিত, পাড়, পাহাড় আর সমতল দিয়ে ঘেরা, নৌকাগুলোকে ওখানে কি ছোটই না মনে হলো, বন্ধুদের মুখ কী অচেনাই না মনে হলো, তাদের চিৎকারের শব্দও কত ক্ষীণ হয়ে গেছে। কাছ থেকেই একটা শব্দ আমার কানে এলো। মিসেস ভহড ভহড তার হার্পটা খুঁজে পেল। হার্পটাকে জড়িয়ে ধরলো, তারে টোকা দিতে লাগলো, করুণ কান্নার মতো বেজে ওঠলো।

একটা লম্বা মাস শুরু হলো। পৃথিবীকে ধীরে পাক খেতে লাগলো চাঁদটা। ভাসমান গ্রহটায় আমাদের পরিচিত সৈকতটা আর দেখতে পেলাম না, কিন্তু পাতালের মতো অতল গভীর সমুদ্র, জ্বলজল লাপিল্লি ভরা মরুভূমি, বরফের মহাদেশ, সরিসৃপের সাথে হামাগুড়ি দেয়া বন, নদীর খরস্রোতের ফলে গভীর খাঁজকাটা পর্বতমালার পাথুরে দেয়াল, ঘনীভূত শহর, পাথরের কবরখানা, মাটি-কাদার সাম্রাজ্যের চলাচল ঠিকই দেখতে পেলাম। দূরত্ব সবকিছুর ওপর একটা মসৃণ রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। দূরের প্রেক্ষাপট সমস্ত কিছুকেই কেমন অপরিচিত দৃশ্যে পরিণত করেছে। হাতির দল, গাছপালার বিশাল ঘনঝোপ সমতলের উপর দিয়ে ছুটছে। এলোমেলো আর ঘনিষ্টভাবে ঘুরছে, এমন এলোমেলো, এমন বিস্তৃত, এমন নিবিড় যে, তাদের স্বাতন্ত্র একেবারেই গুলিয়ে গেছে।

আমার খুশি হওয়াই উচিত। যে-স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম, আমিই শুধু তার সাথে আছি, চাঁদের সাথে আমার চাচাত ভাইটির যে-ঘনিষ্টতা, যা আমি ঈর্ষা করতাম, মিসেস ভহড ভহডের সাথে যে-ঘনিষ্টতা, সে-ঘনিষ্টতা এখন আমার সেরা প্রাপ্তি, চাঁদের দিনের রাতের টানা একমাস, আমাদের সামনে একবারেই নির্বাধ পড়ে রইলো, উপগ্রহটির পিঠের আঁইশের চাঙর আমাদেরকে চাঁদের দুধ দিয়ে আপ্যায়ন করলো, যার আলকাতরা স্বাদের সাথে আমরা আগেই পরিচিত, উপরের দিকে আমরা তাকিয়ে দেখলাম, ঐ পৃথিবী পর্যন্ত, যেখানে আমরা জন্মেছিলাম, এর সমগ্র মাঠের মাঝ দিয়ে আমরা ছুটোছুটি করলাম। নানান জায়গা আবিস্কার করলাম, যা পৃথিবীর কেউ কখনো দেখেনি। তাছাড়া চাঁদের চেয়ে বহুদূরে তারাদের দেখে আমরা অভিভূত হলাম। ফলের মতো বড়ো বড়ো, আলোর তৈরি, আকাশের বাঁকা-শাখে পেঁকে রয়েছে, সবকিছুই আমার সবচেয়ে জ্বলমলে আকাঙ্ক্ষাকেও ছাপিয়ে গেল। এরপরেও এবং এরপরেও, এ ছিল বস্তুত নির্বাসন।

আমি তো শুধু পৃথিবীর কথাই ভাবতাম। পৃথিবীটাই আমাদের অন্য কেউ হয়ে ওঠার বদলে আমরা যেমন ছিলাম তেমনই হতে বাধ্য করতো। সেখানে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, আমি যদি আর সেই আমি না হতাম, আমার কাছে, শে-ও আর সেই-শে না হতো। পৃথিবীতে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লাম, পৃথিবীকে হারিয়ে ফেলেছি এমন একটা ভয়ে কাঁপতে লাগলাম, সেই মুহূর্তেই আমার ভালবাসার পূর্ণতা ততটুকু সময়ই ছিল, যতটুকু সময় জড়িয়ে ছিলাম আমরা, আর পাক খাচ্ছিলাম পৃথিবী ও চাঁদের মাঝখানে। এর পার্থিব মাটির নাগাল হারিয়ে, এখন একটা কোথায়, একটা পরিপার্শ্ব, একটা আগে ও একটা পরের অভাবে আমার ভালবাসা কেবলই হৃদয়বিদারক স্মৃতিকাতরতায় ভুগতে লাগলো।

আমি এমনই অনুভব করেছিলাম। সে? নিজেকে যখন জিগ্যেস করলাম, আমার ভয় আমাকে বিদীর্ণ করে ফেললো। কারণ, যদি পৃথিবীর কথাই শে শুধু ভাবতো, হয়তো তা একটা ভাল লক্ষণই বলা যেত, যার অর্থ শে শেষপর্যন্ত আমাকে বুঝতে পারলো, কিন্তু এর অর্থতো তেমনও হতে পারতো যে, সবকিছুই তার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়েছে, তার সমস্ত বাসনা এখনো এবং একমাত্র আমার চাচাত ভাইটার জন্যেই কেঁদে মরছে। বস্তুত সে কিছুই অনুভব করছিল না। না, পুরোনো গ্রহটার দিকে কখনোই সে মাথা তুলে তাকায়নি, বিড়বিড় করে শোকের গান গাইতে গাইতে এবং তার হার্পটা বাজাতে বাজাতে বেহুঁশ হওয়ার দশা তার। ম্লান হয়ে পড়লো ওইসব পরিত্যক্ত মাঠে, যেন এ-কদিনের চন্দ্রবাসের সাথে শে একেবারেই একাত্ম হয়ে গেল (আমি যেমনটা ভাবলাম)। এর মানে কি আমার প্রতিযোগীর উপর জয়ী হয়েছিলাম? না; আমিই হেরেছিলাম: এ এক হতাশাভরা পরাজয়। কেননা শেষাবধি শে বুঝতে পেরেছিলো, আমার চাচাত ভাইটা শুধু চাঁদকেই ভালবাসতো, আর এখন শে নিজে চাঁদই হতে চাইলো, মিশে যেতে চাইলো ঐ মানবাতীত ভালবাসার বস্তুর সাথে।

চাঁদটা যখন গ্রহের চারপাশে পাক খেয়ে এলো, আমরা ফের জিংকের টিলার উপর এসে দাঁড়ালাম। আমি ঘৃণা নিয়ে সেদিকে তাকালাম: এমনকি আমি ভুলেও কল্পনা করিনি দূরত্ব তাদেরকে এতো ছোট বানিয়ে ফেলতে পারে, ঐ সাগরের কাদাটে তলে আমার বন্ধুরা আবার এগিয়ে এলো, এখন মই না-নিয়েই, দরকার নেই এর আর; কিন্তু এবার নৌকাগুলো থেকে লম্বা লম্বা খুঁটির একটা বন জেগে উঠলো; প্রত্যেকেই সাহসী লোক, হার্পুণ বা শিখরে আংটা আঁটা বর্শা হাতে, বস্তুত চাঁদের দুধ কুড়িয়ে নেয়ার শেষ সুযোগটি কাজে লাগানোর আশায়, কিংবা হতভাগ্য আমাদের কোন সহযোগিতা যোগাতে। কিন্তু দ্রুতই স্পষ্ট হলো ব্যাপারটা, কোনো খুঁটিই চাঁদের নাগাল পাওয়ার মতো লম্বা নয়। এবং সাগরে ভাসতে ভাসতে তারা খুঁটিগুলো নামিয়ে ফেললো একেবারে আচমকা, তাদের উচ্ছ্বাস চূর্ণ হলো। এই দ্বিধা-সংকটের মাঝে কয়েকটা নৌকা ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো, উল্টে গেল। কিন্তু এর পরপরই অন্য এক নৌকা থেকে অনেক লম্বা একটা খুঁটি, যেটাকে তারা সে-সময় পর্যন্ত পানিতে ভাসিয়ে টেনে এনেছে, উপরের দিকে উঠতে লাগলো। খুঁটিটা নিশ্চয় বাঁশের তৈরি হয়ে থাকবে, অনেক অনেক বাঁশ একটাকে অপরটার মাথায় গেঁথে বানানো হয়ে থাকবে। একে খাড়া করা হলো, খুবই ধীরে ধীরে। যেহেতু চিকন ছিল, যদি একে বেশি দুলতে দিতো তারা হয়তো ভেঙে পড়তো। তাই ভীষণ শক্তি ও দক্ষতার সাথে একে খাড়া করতে হচ্ছিল, যেন একেবারে খাড়া হলে খুঁটির ওজনের চুটে নৌকাটা দুলে না ওঠে।

হঠাৎ স্পষ্ট হলো যে, খুঁটির মাথাটি হয়তো চাঁদের বুক ছুঁতে পারবে। এবং একটু ছুঁয়ে যেতে দেখলাম, তারপর আঁইশে ভরা এলাকাটিতে মৃদু চাপ দেয়। সেখানে একপলক থমকে থাকে, একটা ছোট খোঁচা দেয়, কিংবা বরং বেশ জোরেই ঠোকর খেয়ে দূরে সরে যায় আবার। ফিরে আসে তারপরেই, পুনরায় একই জায়গায় এসে ঠোকর খায় যেন সে ওখানেই আসতে চায়। দূরে সরে যায় আরো একবার। আমার মনে পড়লো, আমাদের উভয়েরই— ক্যাপ্টেনের বউ ও আমি— আমার চাচাত ভাইটার কথা: সে ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না, চাঁদের সাথে তার শেষ খেলাটা খেলে চলছিল। তার দক্ষতাগুলোর একটা তার খুঁটির মাথায় চড়ে চাঁদের সাথে, যেন চাঁদের সাথে সে ঝাপ্টাঝাপ্টি করছিল। আমরা বুঝলাম, তার এ খেলার কোনো উদ্দেশ্য নেই, কোনো বাস্তব ফলাফলের জন্যও নয় এ খেলা। আসলে আপনি হয়তো বলে ফেলতেন, সে চাঁদটাকেই বরং তাড়িয়ে দিচ্ছিল। বলতেন, তাকে বিদায় নিতে সহযোগিতা করছিল। বলতেন, সে চাঁদকে তার আরো দূরের কক্ষপথটাই চিনিয়ে দিচ্ছিল। আর এটা একবারে তার স্বভাবের মতোই ছিল। চাঁদের স্বভাবের বিরুদ্ধে, চাঁদের চলাচল এবং গন্তব্যের বিরোধী কোনো বাসনা পোষণ করা তার পক্ষে ছিলো অসম্ভব। এবং চাঁদ এখন যদি তার কাছ থেকে দূরে যেতে চেয়ে থাকে, তাহলেও এই ছাড়াছাড়ির ফলে সে খুশিই হতো,এই এখনো, যেমন চাঁদ কাছে থাকতেও হতো।

মিসেস বহড ভহড কী করতে পারতো, এই ঘটনার সামনে? এই মুহূর্তেই শে বধির লোকটার জন্য তার অনুরাগ প্রমাণ করতে পারতো যে তা কোন আকস্মিক খেয়াল নয়, অমোচনীয় এক নতজানুতা। আমার চাচাত ভাইটা দূরের চাঁদটাকেই যদি ভালবাসতো তখন শে-ও তো দূরেই পড়ে থাকতো, ঐ চাঁদের বুকে। বাঁশের খুটির দিকে তাকে এক পা-ও না-এগোতে দেখে এমনই ভাবলাম আমি, তবে শে শুধু তার হার্পটাকেই পৃথিবীর দিকে তুলে ধরলো, আকাশের উঁচুতে, আর তারগুলোকে টেনে ছেড়ে দিলো। আমি বলে থাকি, তাকে দেখলাম, সত্য বলতে কি, আমার চোখের কোণে তাকে আসলে এক পলক ভেসে উঠতে দেখেছিলাম মাত্র। কারণ সে-সময়েই খুঁটিটা চাঁদের চাঙর স্পর্শ করলো, আর ঝাঁপ দিয়ে খুঁটির মাথাটা আঁকড়ে ধরলাম, আর এখন, সাপের মতো দ্রুত ওঠতে লাগলাম, বাঁশের গাঁট বেয়ে, ঝাঁকির সাথে ভারসাম্য রেখে চললো আমার হাতপা, ওই শূন্য হয়ে পড়া স্থানে হালকা হয়ে উঠলাম প্রাকৃতিক শক্তির সাহায্যে। যে-উদ্দেশ্য আমাকে এখানে টেনে এনেছিল সে-বিষয় ভুলে গিয়ে, কিংবা হয়তো সে-বিষয়ে, এবং এর দুর্ভাগা পরিণতি সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়ে এই শক্তি আমাকে পৃথিবীর দিকে ফিরে যেতে নিদের্শ করলো; দুলতে থাকা খুঁটির এমন জায়গায় ইতোমধ্যে এসে পড়েছিলাম যে, এখন আর বেয়ে ওঠার দরকার রইলো না, গড়িয়ে পড়তে পৃথিবীর টানের কাছে নিজেকে ছেড়ে দিলেই হলো, মাথা নিচের দিকে রেখেই, আমার এই গড়িয়ে নামা চললো যতক্ষণ-না খুঁটিটা হাজার টুকরোয় ভেঙে পড়লো, আর ছিটকে পড়লাম সাগরে, নৌকাগুলোর ভিড়ে।

আমাদের ফেরাটা ছিল মধুর, আবার ফিরে পেলাম নিজের ঘর। কিন্তু তাকে হারিয়ে আমার চিন্তা বিষাদে ছেয়ে গেল। আমার চোখ দুটো চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতো, চিরকাল নাগালের একেবারে বাইরে, যখনই তাকে খুঁজতাম। তাকে দেখতে পেতাম। সেখানেই সে পড়ে রইলো, তাকে ফেলে এসেছিলাম যেখানে, একবারেই আমাদের মাথার উপর এক সৈকতে শুয়ে থাকা অবস্থায়, কিছুই বলেনি শে, চাঁদের মতোই তার রঙ; শে তার পাশে হার্পটাকে রাখলো, মাঝে মাঝে একটা হাত ধীরে ধীরে নড়তো। আমি তার বুকের, তার বাহুর, তার ঊরুর গঠন আঁচ করতে পারতাম, ঠিক এখন যেমন তাদের স্মরণ করলাম, ঠিক এখন যেমন, যখন চাঁদটা যেমন একেবারেই চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছে। আর দূরের কক্ষপথে চলে গেছে। আমি আজও প্রথম রুপালি রেখাটা আকাশে উদয় হওয়া মাত্রই তাকে খুঁজতে থাকি, যতই এর কলা পুরু ও ভরাট হতে থাকে, তাকে, তাকে বা তার কোনোকিছু, বরং শুধু তাকেই, শত সহস্র রূপে দেখতে পাচ্ছি— ততই স্পষ্টভাবে এমন কল্পনা করতে থাকি, শে-ই-তো চাঁদকে চাঁদ বানালো এবং যখনই শে সুগোল হয়ে ওঠে, সমস্ত কুকুরদের চেঁচাতে বাধ্য করে, সারারাত, এবং তাদের সাথে আমাকেও।