রিফাত বিন সালাম

রিফাত বিন সালাম

এক আউটসাইডারের নোট

দেবদুলাল মুন্না

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৯

কিছুই করা হয়নি। বেড়াতাম। এখন বাসায়ই থাকি। লিখতাম। ভাষা খুঁজে পাই না। চাকরি করতাম। হারিয়েছি। রাজনীতি নিয়ে ভাবতাম। ভাবিনা। স্বপ্ন দেখতাম। ঘুম হয়না আজকাল। একা একা থাকি। ভাগ্যিস আব্বাজান চারতলা বাসা রেখে মারা গেছেন। বাসাভাড়া দিয়েই চলে জীবনযাপন। সারাদিন বাসায় কাটে। সন্ধ্যের পর কোনো কোনো দিন বেরুই। উদ্দেশ্যহীন। হাটি। মানুষের ভীড়ে। একদিন দেখা হয় তুলির সাথে। মৌচাকের মার্কেটের সামনে। জানায়, তার লিভারে ক্যান্সার। ১১ দফা ভারতে গিয়ে কেমোথেরাপি দিয়েছে। মাথার চুল ছোট। রং পুড়েছে। বাসার ঠিকানা দিয়ে বলে একদিন বেড়াতে যেতে। যাই না। এর দু মাস পর আবার দেখা তুলির সাথে। হাইকোর্টের মাজারের সামনে, মানুষের ভীড়ে। আমিই তাকে আগে দেখেছিলাম। দেখে ফুটপাত পাল্টে অন্যদিকে পা বাড়াচ্ছিলাম। ডাকলো। বললো, মরে যাবো, বাসায় যেও। মানুষের মৃত্যু নিয়ে একধরণের রোমান্টিকতা আছে। আমার পছন্দ না। তবু একদিন গেলাম তুলির বাসায়। মানুষের জীবন আসলে কিছুই না—এ টাইপের কথাই বেশী শোনালো তুলি।

 

তার তিনমাস পর তুলি মারা গেলো। আমার মনের রোগ দেখা দিল এরপর । কমোডে বসে ভয়ে ভয়ে দেখি পায়ুপথে আমার রক্ত বেরুচ্ছে কিনা দেখি প্রতিদিন। একবার নয়,কয়েকবার। কমোডে বসার পরিস্থিতি না হলেও বসে থাকি। আবার বাথরুমে যেতেও ভয় পাই। মৃত্যু নিয়ে রোমান্টিকতা একদম আমার পছন্দ না। কিন্তু আমি রোমান্টিক হয়ে উঠতে থাকি। মৃত্যু বিষয়ক যেখানে যা পাই পড়ি, গান শুনি। অসীম আকাশ এভাবে আরো আরো আমার সসীম মাথার ভেতর ঢুকতে থাকে। আমি চুলোয় পানি ফোটাতে দিয়েছি, গরম পানি দিয়ে গোসল করবো বলে, দেখা গেলো, পানি ফুটতে ফুটতে হাওয়া। সেই পানি মেঘ হলো। বৃষ্টি এলো, ছাদে লুঙ্গি পড়ে খালি গা’য়ে ভিজি। ভাবি, আহা আমার চুলোয় ফোটানো পানি।

 

এক বিকালে ঘুম ভাঙলে কফির মগ নিয়ে বারান্দায় বসেছি। হঠাৎ মনে হলো, কনকনে হাওয়া টের পাচ্ছি, কিন্তু দেখতে পাইনা কেন? রাতে একা বাসায় ভয় পেতে শুরু করলাম। কমলাপুর স্টেশনে তিনরাত পার করলাম। তারপর গ্রামের বাড়ি থেকে এক বুড়োলোককে আনালাম-আমার সাথে থাকার জন্যে। আমারও মনে ঘুরপাক খেতে থাকে সবসময়, তুলির মতো আমিও একদিন মরে যাবো। আমি আমার পরিচিত মৃতদের মনে রাখিনি, জীবিতরাও আমায় মনে রাখবে কেনো? আমার মনে পড়তে থাকে বিদিশার মুখ। আমার মেয়ে। লন্ডনে থাকে। পড়তে গিয়ে স্থায়ী হয়েছে সেখানে। আমার মনে পড়তে থাকে রোমেনার মুখ। আমার বউ ছিলো। সংসার টিকেনি। আমার শৈশবের বন্ধুদের কারো কারো মুখ মনে পড়ে। কিন্ত কাউকে মনে পড়–ক আমি চাই না।

 

শেষমেশ এলিফেন্ট রোডে মনোরোগ চিকিৎসকের সাথে দেখা করলাম। মনে পড়ে, রাতে সব রোগী দেখার পর আমায় তার সামনে ডাকা হয়েছিল। রাত ৯ টা ২২ মিনিটে। মনে আছে সব। অনেক কিছু জানতে চাইলেন। বললাম। তিনি একা না থাকার এবং যে কোনো কাজে ব্যস্ত থাকার পরামর্শ ও কিছু অষুধ দিলেন। আমি ফুটপাতে, রেলস্টেশনে, পার্কে, নাগরিক  জ্যামে মানুষের পাশাপাশি হাটি। তারা কী নিয়ে মশগুল-বোঝার চেষ্টা করি, তাদের সংগতা এভাবে নিতে যাই। দেখি সবই পুরনো আলাপ। বাজার-সংসার-ক্যারিয়ার-সব একাকার। রাত হলে গোলাপী রংয়ের ল্যাক্সোটানিল। আধো ঘুম আধো জেগে থাকা।

 

এভাবেই যাচ্ছিল দিবারাত্রি। একদিন আমাকে একজন ফেসবুকের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দিল। আইডি করলাম। প্রোফাইল লিখলাম। কিছু পুরনো ছবি আপলোড করলাম। কিছু বন্ধু জুটল। ফেসবুকের খুটিনাটি ব্যাপারগুলো রপ্ত করতে বেশ কিছু দিন লেগে গেলো। এবার একটা স্ট্যাটাস লিখতে হয়, শেয়ার করতে হয়। কী লিখব কিছুই খোঁজে পাই না। বন্ধুদের স্ট্যাটাস পড়ি। কতোকিছু নিয়ে যে তারা মেতে থাকে। আহা, আমি যদি তাদের মতো মেতে থাকতে পারতাম। একদিন রাতে বসে আছি ফেসবুকের সামনে। কারো অ্যালবাম দেখছিলাম হয়তোবা। হঠাৎ মনিটরের নিচের দিকে ডানকোণে একটা লাল সিগন্যাল জ্বলে উঠতে দেখি, সাথে সাথে একটা ছোটো বক্স ভেসে উঠে। অরিন রহমান নামের একজন বলে

-হাই

জবাব দেই----হুম

হুম কি?

ঘুম ঘুম পেয়েছে তোমার?

না আমার এখানে এখন ভরদুপুর। তোমার তো বেশ রাত। জেগে আছো যে-  কি বিজি?

না কী করো তুমি? আমার হঠাৎ কি মনে হলো, ভাবলাম একটু ভয় দেখাই, উদ্ভট কথা বলি। টেক্সট পাঠাই

—তুমি কী জানো তুমি কার সাথে কথা বলছো?

কার?

মৃত মানুষের সাথে।

হিহিহিহি, তারপর বেচেঁ উঠলে কীভাবে? যার সাথে কথা বলছ, তিনি নেই? তুমি কে ?

হ্যাকার,যার আইডিতে কথা বলছ তিনি মারা গেছেন।

 হিহিহিহিহিহি তারপর অফলাইনে চলে গেলাম। অরিন রহমানের ইনফো, প্রোফাইল, এ্যালবাম কিছুই দেখলাম না । আগ্রহ কাজ করলো না।

 

শেষরাত। ঘুমানো দরকার। ঘুমঘুমঘুম। তুলিকে মনে পড়লো। শেষের দিকের অসুস্থ তুলি নয়। সুস্থ তুলির সুন্দর শরীর। পর্নো সাইটে সার্চ দিলাম। তুলিকে খুঁজলাম ওইসব মুখগুলোয়। ডুবসাতাঁরের নেশায় পেয়ে বসলো। তুলি মারা গেছে। তাতে কী, আমি তুলিকে নিয়েই ডুবসাতারে মেতে উঠলাম। পরদিন তুলিকে নিয়ে রাতের ওই ব্যাপারটা মনে পড়তে একটু অস্বস্তি। ধেৎ, নৈতিকতা।

 

দুপুরের পর দুই ভাড়াটিয়া ভাড়া দিয়ে গেলো। মাসের প্রথম উইক। মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যাবার কথা। ইচ্ছে করছে না যেতে। তবু গেলাম। সন্ধ্যেয়। ভীড় বেশী নেই। ডাক্তার জানতে চাইলেন,আমার মধ্যে আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জাগে কি-না। বললাম, খুব জাগে আজকাল। কিন্তু ওটি কখনোই করব না। ডাক্তার বললেন, ধর্মীয় মুল্যবোধ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে। না হেসে পারলাম না তার কথায়। হাসার কারণ জানতে চাইলে বললাম, ‘নাস্তিক কয়জন আর এ জগতে সুইসাইড করে, রিলিজিয়াসরাই তো বেশী করেন বলে জানি।’ তিনিও এবার হাসলেন। আমি বললাম,‘ আমি সুইসাইড করবো না, কারণ আমার কাছে আমার লাইফ মিনিংলেস। সুইসাইড করলে মিনিংফুল হয়ে যাবে।’ তিনি এ কথায় কি বুঝলেন তিনিই জানেন, আমাকে দুটো অষুধ বদলে দিয়ে বিদায় দিলেন। তার ওখান থেকে বেরিয়ে অষুধ দুটোও ফেলে দিয়ে শুন্যে পাখির মতো দু’হাত দু’দিকে মেলে দু পা শুন্যে তুলে অদ্ভুত কিসিমের লাফে কেন জানি মজা পেলাম।দুই,  একজন তাকালো। বাট হু কেয়ার্স?