একই যাত্রায় পৃথক ফল, ছফার ক্ষোভ
সালাহ উদ্দিন শুভ্রপ্রকাশিত : জুন ১২, ২০২০
অন্য অনেককে বাদ দিয়েও কবি সুফিয়া কামালের পাকিস্তান ও জিন্নাহর ওপর নানা সময়ে লেখা কবিতাগুলো জড়ো করে প্রকাশ করলে ‘সঞ্চয়িতা’র মতো একখানা গ্রন্থ দাঁড়াবে বলেই আমাদের ধারণা। অথচ ভাগ্যের কী পরিহাস, কবি সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে মস্কো-ভারত ইত্যাদি দেশ সফর করে বেড়াচ্ছেন। (কবি ফররুখ আহমদের কি অপরাধ/আহমদ ছফা)
লেখাটা ছফা কবি ফররুখ আহমদের দোষ খণ্ডাইতে লিখছিলেন। একই যাত্রায় ভিন্ন ফলে তার জোর আপত্তি এখানে দেখা যাইতেছে। আমি ছফার লগে একমত। ‘গরিব’ ঘাড় ত্যাড়া হইলে তার পরিণতি যন্ত্রণাহীন করার জন্য কিম্বা তারে অসহায়ত্ব থিকা উদ্ধারে সমাজ কেন ভূমিকা রাখে না? আহমদ ছফার আপত্তি এরকম। তিনি বুঝাইতে চাইলেন, ফররুখ আপসহীন বইলা ভাত পায় নাই। আর সুফিয়ার উল্টা-স্বভাব তারে বেশ আয়েসে রাখছে।
সুফিয়া কামাল লিখছিলেন—
তসলিম লহ, হে অমর প্রাণ
কায়েদে আজম, জাতির পিতা!
মুকুটবিহীন সম্রাট ওগো
সকল মানব-মনের মিতা।
ফররুখও জিন্নাহরে তার জাতির পিতা মানছিলেন। দুইজনেই একই রকমভাবে তেজ বা জাতির কাণ্ডারি হিসাবে জিন্নাহরে দেখতে চাইছিলেন। তাইলে পাকিস্তানের লগে বিরোধ বাড়ার আগপর্যন্ত দুই কবি পলিটিক্যালি কাছাকাছি আছিলেন দেখা যায়। যদিও কাব্যগুণ ফররুখেরই বেশি তখনও।
বাট ছফার কথা মতে পরে সুফিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ব্যবসায়ীগো লগে সুর মিলাইলেন আর ফররুখ মিলাইলেন না। তিনি গরিবির মধ্যে পড়ে গেলেন। সুফিয়ার সে সমস্যা হইল না। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, নারীমুক্তির প্রতীক হয়া গেলেন। ডেইলি স্টারের মাহফুজ আনাম ওনার ইন্টারভিউ নিয়া ফেললেন। ওনার মেয়ে সুলতানা কামালও পারিবারিক গুণাবলি অব্যাহত রাখলেন। আর ফররুখের মাইয়া মারা গেল বিনা চিকিৎসায়। যে মারা যাওয়া নিয়া ছফা এমনটা লিখলেন। ফররুখেরও মারা যাওয়ার সময় কাফনের কাপড় বা কবরের জমির বন্দোবস্ত ছিল না। অন্যের দয়ায় তিনি বাংলাদেশ পর্ব সমাপ্ত করছেন। একই যাত্রায় দুইজনের এমন ভিন্ন ফল নিয়া ছফার রাগ ফলে ঠিকাছে।
এই রাগের লগে আমি একটা বিশ্লেষণ যোগ করতে চাই। তা হইল, আমাদের এখানে পলিটিক্যালি যারা সেক্যুলার তারা যে সাহিত্য করার ভান করেন এতে সাহিত্যের কদর হারামও নাই। অথচ তারা সাহিত্যিকদেরই ইউজ করেন নিজেদের জাস্টিফাই বা গ্লোরিফাই করার জন্য। নইলে সুফিয়ার চাইতে তো ফররুখ কবি হিসাবে ভালো। কবির ভাব তার আছে বাইলা না, তখনকার সময়ে বাংলা তথা বাংলাদেশের কবিতা নির্মাণের কর্মকাণ্ডে তিনি উল্লেখযোগ্য। সুফিয়া তো মহিলা হিসাবেই থাইকা গেলেন জীবনাবধি।
তাই এই মহিলা পরিচয়ও অবশ্য সেক্যুলার প্রকল্পধারীদের নারিপন্থী হিসাবে ভাবাইতে সুবিধা দিছে। মানে সুফিয়া দিছেন আর নিছেন পদ্ধতিতে কবির চাইতেও মহিয়সি হিসাবে টিকা গেলেন। আর ফররুখ রইলেন রসাতলে। মানে স্বার্থ অটুট রাখলে একসময়কার পাকিস্তানপন্থীরাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কনভার্ট হইতে সমস্যা নাই। সিন্ডিকেট তোমারে আপন করে নিবে। আর সিন্ডিকেট না মানলে, টিকা থাকাই মুশকিল।
ডেইলি স্টারের মাহফুজ আনামের ইন্টারভিউতেও খেয়াল করেন, কবিতা নিয়া আলাপ নাই। অথচ সুফিয়া কামাল তো একজন কবি। নাকি হুদাই একজন বুইড়া মহিলা আছিলেন তখন। একজন কবিরে তার বাউণ্ডারির বাইরে আনার পলিটিক্স নিয়াই কিন্তু ছফার আলাপটা আছিল। আবার জিন্নাহ নিয়া আপনে সেই সময় কবিতা লেখছিলেন কেন, এমন প্রশ্নও নাই। জিন্নাহরে নিয়া যে সুফিয়া কবিতা লেখছিলেন এই ঘটনা কোনওদিন প্রকাশ করে নাই সেক্যুলাররা।
এই হইল হিসাব, একজন কবিরে মানবিক অধিকার দিয়াও তুমি বিচার করলা না আর তোমার লগে হ্যাঁ হ্যাঁ করলে তারে বুদ্ধিজীবীও বানাইতে কসুর নাই। এগুলা খারাপ। যারা লোক পুরস্কার লইতে চান তারা বুঝেন না এগুলা কত খারাপ। গোষ্ঠির পুরস্কার পাইতে গিয়া তারা অন্য আরেকজনরে গরিবির দিকে ঠেইলা দেন নিশ্চয়।
এখনকার কবিরা গরিব হইতে চান না বুঝলাম, কিন্তু পুরস্কার পায়া বড়লোক হওয়া যায় না, এটাও মালুম করেন না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী
























