
একটা রিকশা উল্টে দেয়া মানে একটা সংসার উল্টে দেয়া
পর্ব ৮
প্রকাশিত : এপ্রিল ২৫, ২০২১
কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো অষ্টম পর্ব।
২২ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার
রিকশা উল্টানো অব্যাহত আছে। আজও দেখলাম রাস্তার মোড়ে মোড়ে উল্টে আছে রিকশা। করুণ, বিষণ্ণ, ভয়ার্ত মুখ নিয়ে উল্টানো রিকশার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক একজন চালক।
আমি অফিস থেকে বেরিয়েছি তখন। বিকেলের সোনা সোনা রোদ থইথই করছে রাস্তায়। এমন অপার্থিব পবিত্রতার সঙ্গে এই নারকীয় অপবিত্র দৃশ্য একেবারেই যায় না। পুলিশ ভাইদের কাছে গিয়ে আমার খুব বলতে ইচ্ছে করল, ভাই, চারপাশটা একটু তাকিয়ে দেখেন, কী সুন্দর হলুদ আলোর বন্যা, যেন ভ্যান গঘের আঁকা হলুদ পেইন্টিং। এরমধ্যে হঠাৎ আপনি আলকাতরা ছিটিয়ে দিয়েছেন। কাজটা কী ঠিক হলো?
পরে মনে হলো, ওসব ভ্যান গঘ টঘ ওরা বুঝবে না। তারচেয়ে বরং রুঢ় বাস্তবতার কথাই বলি। কাছে গিয়ে বলি, ভাই, একটা রিকশা উল্টে দেওয়া মানে রিজিকের চাকা উল্টে দেওয়া, একটা সংসার উল্টে দেওয়া। এমন কাজ করবেন না। মোড়ে মোড়ে রিকশা উল্টে দিয়ে ১২০০ টাকা জরিমানা করলেই করোনা পালাবে না। এই সহজ সত্যটুকু বোঝার চেষ্টা করুন।
বোঝার সমস্যা নিয়ে দারুণ একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। গিন্নি বলছেন, হাঁস নিয়ে এসো বাসায় আসার সময়। কর্তা বুঝেছে, বাঁশ। লম্বা এক বাঁশ কাঁধে নিয়ে চলে এসেছে বাসায়। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, পুলিশদেরও কোথাও এরকম বোঝার সমস্যা হচ্ছে। তারা হাঁস বললে বাঁশ শুনছেন। তাদেরকে উর্ধ্বতন কর্তারা বলছে এক কথা, তারা শুনতে পাচ্ছে আরেক কথা। তাদেরকে বলা হচ্ছে প্রাইভেট কার, তারা শুনতে পাচ্ছে রিকশা। তাদেরকে বলা হচ্ছে, অযথা ঘোরাঘুরি করা ভবঘুরে, তারা শুনতে পাচ্ছে, জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া শ্রমজীবী-পেশাজীবী!
এত বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্য দিয়ে একটা দেশ কীভাবে চলছে, এত সমন্বয়হীনতায় মধ্য দিয়ে একটা রাষ্ট্র কীভাবে চলছে ভাবতে ভাবতে মোহাম্মদপুর এলাম। বাজারে ঢুকব কিনা ভাবছি। কারণ এই মর্ত্যের পৃথিবীতে এটাই একমাত্র ভূনরক যেখান থেকে আমি কোনোদিন ভালো মেজাজ নিয়ে বেরুতে পারিনি।
ভাবলাম, বাসায় একটা মাছ নিয়ে যাই। পাঁচ ছয়টা মাছের দোকান আছে এই বাজারে। আজ মাছের যোগান তেমন ভালো না। পেটভর্তি ডিমওলা কার্পু মাছ দেখলাম কয়েকটা। সাইজে বেশ বড়। দাম চাইবে অনেক। কতগুলো বড় বড় চিংড়ি মাছ দেখলাম। সে-ও তো বনেদী গোত্রের। অনেক দাম। আমি খুঁজছিলাম সস্তা গোত্রের ছোটখাট রুই মাছ। একটা দোকানে পেলাম বটে, ৩০০ টাকা কেজি দাম চাইলো, আঙুল দিয়ে টিপে দেখি নরোম।
দোকানদার কানকো ফাঁক করে দেখানোর চেষ্টা করল। আমি বললাম, একেবারে তাজা মামা। মনে হচ্ছে মাত্রই পুকুর থেকে তুলে আনছেন। কি সাংঘাতিক! এত তাজা মাছ মাত্র ৩০০ টাকা কেজি? কীভাবে দিচ্ছেন মামা! আপনার লস হয়ে যাচ্ছে না?
দোকানদারের মুখ চুন হয়ে গেল। সে আমার রসিকতায় মজা পেল না। মুখ গোমরা করে বলল, আপনের কপালে মাছ খাওন নাই!
কপাল বড় দেখে এখন মাছঅলারাও আমার কপালের লিখন পড়তে পারছে। বিরাট ব্যাপার!
আমি মাছ বাজার থেকে বেরিয়ে এক কেজি পেঁয়াজ কিনলাম। তারপর এক হালি লেবু কিনলাম। বাসায় মুরগি আছে, সবজি আছে। চলে যাবে আজ। কাল শুক্রবার আছে। প্রয়োজনে টাউন হল বাজারে যাব। বড় বাজার। দেখেশুনে কেনাকাটা করা যাবে।
এখান থেকে সাধারণত হেঁটেই বাসায় যাই। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল, ফেসবুকে রিসাইকেল বিন নামে একটা গ্রুপ আছে। পুরনো জিনিসপত্র বিক্রি হয়। নিজেও তো পুরনো হয়ে গেছি। কত বয়স হয়ে গেল। নিজেকে যদি রিসাইকেল বিনে বিক্রি করে দিতে পারতাম! কত ভালো হতো! চলবে