একশো বছর পর আজও মান্টো কেন জরুরি

শাবানা আনসারি

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৯, ২০২৪

শাবান আনসারি ভারতের মুম্বাইয়ের মহারাষ্ট্রে বসবাস করছেন। তিনি রিজভী কলেজে বাণিজ্যবিভাগের শিক্ষার্থী। মূলত তিনি ইংরেজিতে লেখালেখি করেন। উর্দু সাহত্যের প্রতি তার বিশেষ ঝোঁক রয়েছে। সাদাত হাসান মান্টোর ওপর তার এ লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন ফারুক ইমন

চারণ ছোট গল্পকার হিশেবে নিন্দিত আধুনিক উর্দু সাহিত্যের অন্যতম পঠিত লেখক সাদাত হাসান মান্টো। অবিভক্ত পাঞ্জাবের একটি গ্রামে আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার লেখার মধ্যে পাওয়া যায় তার সমসাময়িক সমাজের গভীর পর্যবেক্ষণ। তার গল্প বলার ঢঙ বর্ণনার রসে ভরপুর, রহস্যময়তায় ঘেরা শৈল্পিকতা যার সাধারণ সৌন্দর্য। পাহাড় ও আকাশের নিচে দুজন মহান গল্পকথক এখনো মানুষকে বিমোহিত করে। তিনি তার একজন। তার জীবনকালে তার সেরা কাজগুলো ছিল অবহেলিত। কিন্তু উর্দু সাহিত্যের কাননে তিনি তার অবস্থান পোক্ত করে গেছেন জীবদ্দশাতেই।

৪২ বছর বয়সে অ্যালকোহলের প্রভাবে লিভার আক্রান্ত হয়ে মারা না গেলে এ বছর মে মাসে তিনি একশো বছরে পা রাখতেন। তার ক্ষণজন্মা জীবনে তিনি উর্দু ভাষায় ছোট ছোট ২০টি গল্পের বই লেখেন। যেখানে তিনি তুলে আনেন উর্দু ছোটগল্পের চিরহরিৎরূপ আদিম রস। তার গল্পগুলো সামাজিক ভ্রষ্টাচার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, রাজনৈতিক মোনাফেকির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ উচ্চারণ হয়ে আছে এখনো। তার সমসাময়িক সমাজব্যাবস্থা ও সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়ে গেছেন। জীবনে বেশ কয়েকবার তাকে অশ্লীলতার অভিযোগে অপদস্থ হতে হয়। ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের সময় এ বিভাজনের বিরুদ্ধে তার স্পষ্ট অবস্থান ছিল।

ধর্মব্যাবসায়ী ও অসাধু রাজনীতিবিদদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠেন তিনি। তার গল্পের ব্যাঙ্গ মারাত্মকভাবে উত্তেজিত করে তোলে ভ্রষ্টতাকে। মুম্বাইয়ের লেখক ও কলামিস্ট শামীম তারিক মান্টো সম্পর্কে বলেন, “নিজের ভেতরে মান্ট ছিলেন একজন চন্দ্রাহত মানুষ। আর সাধারণ বিবেচনায় তিনি ছিলেন সমাজের একজন নির্মোহ সত্যস্পর্ষী গল্পকথক। গোলযোগপূর্ণ অন্ধকার সময়ের তার গল্পগুলো মানব অনুভূতির বর্ণনাকারক, এখনো সমাজের জন্য সমান প্রাসঙ্গিক। কারণ তার গল্প শুধু সময়কে বর্ণনা করেনি, সেখানে রয়েছে সমাজ সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি। অনেক বিবেচণাতেই সেই সময়ে, এমনকি তার পরবর্তীতেও দেশভাগের ওপর সেরা কাজ তার গল্পগুলো। ধর্ম-বর্ণ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি দেশভাগ পরবর্তী সহিংসতায় নির্যাতিত মানুষের কথা বলেছেন। এমনকি সহিংসতায় জড়িতরাও তার গল্পে এসেছে ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের শিকার মানুষ রূপে, অপরাধী হিশেবে নয়।”

মুম্বাইয়ের আরেক লেখক ও ঐতিহাসিক রফিক বাগদাদি বলেন, “মান্টোর লেখা শুধু সাহিত্যকেই প্রভাবিত করেনি, তার লেখার সামাজিক প্রভাবও ব্যাপক। তিনি এখনও পর্যন্ত উর্দু সাহিত্যের সর্বাধিক (ইংরেজি) অনুদিত লেখক এবং তার বই সমসাময়িক অন্য লেখকদের তুলনায় অনেক বেশি পঠিত।”

মান্টোর অনেক গল্পকে মঞ্চায়ন করা বিখ্যাত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ মনে করেন, মান্টোর প্রাসঙ্গিকতা একটুও কমেনি। কেননা তার গল্প মূলত দুর্লভ মানবিক অনুভূতির কথা বলে। তিনি বলেন, “মান্টোর গল্প কারুকার্জময়, গল্পে আছে শক্তিশালী রূপকল্প এবং বর্ণনা সরল। এতে কোনই সন্দেহ নেই যে, তার কাজ আরও দীর্ঘকাল প্রাসঙ্গিক থাকবে।”

তৎকালীন মুম্বাই
শুধু ছোট গল্প বা প্রবন্ধে সীমাবদ্ধ ছিলেন না মান্টো। রফিক বাগদাদি মান্টো সম্পর্কে বলেন,“সাংবাদিকতা, থিয়েটার ও রেডিওতেও কাজ করেছেন মান্টো। এছাড়া মুম্বাইয়ে থাকাকালীন সময়ে তিনি সিনেমা নিয়েও কাজ করেছেন। দেশভাগের আগে তিনি বোম্বেতে প্রায় ১২ বছর বসবাস করেন। সেই সময়ে তিনি মির্জা গালিব, চল চল রে নওজোয়ান, শিকার আর খিচদিসহ প্রায় অর্ধ-ডজন সিমেনার চিত্রনাট্য লেখেন। চলচল রে নওজোয়ান সিনেমাটিতে তিনি একজন শেলসজ্জিত সৈনিকের ভূমিকায় অভিনয়ও করেন।”

সেই সময়ের সিনেমার তারকাদের নিয়ে তিনি Stars from Another Sky নামে একটি বইও লেখেন। ১৯৪৮ সালে মান্টো লাহোরে চলে যান। তিনি যেন পদার্পণ করেন এক মরুময় একাকিত্বের ভূমিতে। এখানে এসে ভরপুর মদের নেশায় আসক্ত হয়ে যান মান্টো। আমৃত্যু নিজেকে মদের নেশায় ডুবিয়ে রাখেন। সম্প্রতি লেখকের কাজ নিয়ে নতুন নাটক মঞ্চায়নের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করতে লাহোরে মান্টোর তিন কন্যার সাথে আলোচনায় নাসিরুদ্দিন শাহ মান্টোর কন্যা আয়েশা জালালের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “পাকিস্তানে মান্টোর মতো একজন উর্দু লেখকের মদে ডুবে যাওয়ার কাহিনির পেছনে রয়েছে এক করুণ উপাখ্যান। তিনি মান্টোর নিষ্কলঙ্ক হৃদয়ে সাত বছরের নরক যন্ত্রণার বর্ণনা দেন। এ সাত বছরে মান্টোর শোক ও যন্ত্রণা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।”

লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা শামা জাইদি বলেন, “পাকিস্থানে চলে আসার পরও মান্টো মানসিকভাবে মুম্বাই থেকে যান। তিনি বলতেন, মুম্বাই আমার মধ্যেই বাস করে।

মঞ্চ ও সিনেমায় মান্টোর ছোটগল্প: মান্টোর কাজ পাঠক, সিনেমাপ্রেমি ও মঞ্চের দর্শকদের মুগ্ধ করে চলেছে। শাহের থিয়েটার গ্রুপ মোটলি, কালী সালোয়ার সাথে তার প্রবন্ধ সফেদ যুথ নিয়ে কাজ করছে যেখানে কমার্সিয়াল যৌনকর্মীদের জন্য। এগুলোতে লেখকের মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে স্পস্টভাবে। দেশভাগের ওপর মান্টোর জনপ্রিয় দুটি ছোটগল্প তুবা টেক সিং ও সীমা হাশিয়ার নাট্যরূপ দিতে গ্রুপটি কাজ করছে। চলচ্চিত্র পরিচালক ফারিদা মেহতা কয়েক বছর আগে মান্টোর কালী সালোয়ার ছোটগল্প অবলম্বনে একটি সিনেমা বানান। যেখানে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা ইরফান খান ও সাদিয়া সিদ্দিক।

চলতি মাসেই আইডী এনামের মুম্বাইয়ের একটি নাটকের দল মান্টোর লেখা নিয়ে অনেকগুলো প্রযোজনার কাজ হাতে নিয়েছে। মান্টোর সময়কালের লেখক ও তার পাঠকরা মনে করে তুবা টেক সিং মান্টোর অন্যতম সেরা কাজ। দেশভাগের সময়ে পাকিস্তানের লাহোরে গল্পের পাগলটি শক্তিশালী প্রতিবাদ রূপে হাজির হয় জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে। কাহিনিতে, পাকিস্তানের লাহোর থেকে কিছু হিন্দু ও শিখ পাগলকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। তাদেরকে ট্রাকে উঠতে বাধ্য করা হচ্ছে। কিন্তু তারা ট্রাকে উঠবে না, তবুও তাদেরকে জোর করে তোলা হচ্ছে। এতে তাদের মধ্যে থাকা এক শিখ পাগল খুব রেগে গিয়ে পাকিস্তান ও ভারতকে বিভক্তকারী সীমানার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সীমাহীন আক্রোশে। দেখা যায়, দেশভাগের রাজনীতির অসারতা এই পাগলরাই ভালো উপলব্ধি করেছে।

তারিক বলেন, “জগৎবিচ্ছিন্ন থাকার পরেও তারা তা দ্রুত উপলব্ধিতে নিয়ে এসেছে। যা সেই সময়ের রাজনীতিবিদরা উপলব্ধিতে আনতে পারেনি। ধর্মের নামে বিভাজিত এক সময়ের সমাজের রাজনীতির স্বেচ্ছাচারিতার নাম হচ্ছে দেশভাগ।”

থিয়েটার পরিচালক সালিম আরিফ ১৭ বছর বয়সে মান্টোর নাংনি আওয়াজিন গল্প পাঠ করেন। এরপর থেকে সালিমের জীবনে এ গল্পের ছাপ থেকে গেছে। একজন লেখকের জন্য লেখাটি দিশারী হতে পারে। যা কিছু্র নিয়ন্ত্রণের বাইরে ও অনাবিষ্কৃত, তাকেও নিয়ত উৎসাহ যুগিয়ে যায় মান্টোর গল্পগুলো।

সালিম মনে করেন, মুম্বাইয়ে মান্টোর লেখাগুলো আরো মনোযোগের দাবি রাখে। এ শহরের কথা, সমাজের কথা তার মতো করে কেউ বলেনি। সম্ভবত তার মতো করে এ শহরকে আর কোনো লেখক দেখতে পারেনি। নগপদা, বাইকলার ভিড়ে মুম্বাইয়ের পুরোনো গলির মধ্যে হাঁটলে এখনো মান্টোর অক্ষরগুলোকে জীবন্ত দেখতে পাওয়া যাবে। নাঙ্গনি আওয়াজিন মুম্বাই শহরটির এখনও সর্বজনীন গল্প। একজন অবিবাহিত ভাগ্য অন্মেষক যুবক ও আর তার বড় ভাইয়ের গল্প এটি। আরো অনেক অনেক মানুষের মতো দুই ভাইয়ের ঠাঁই হয় গরিবদের জন্য তৈরি একটি আবাসনে, যেখানে আরো অনেক নিম্ন আয়ের পরিবার বসবাস করে একসাথে।

টিনের কার্টুনের তৈরি খোপগুলোয় একেকটা পরিবারের বাস। আড়ালের ওপারে দম্পতিদের প্রেমময় মুহূর্তের আওয়াজ শুনে আড়ালের ফাঁক দিয়ে দৃশ্যগুলো দেখার কৌতুহল প্রতিরাতে তাড়িত করে যুবককে। আর নিজের জন্য এরকম মূহূর্ত তৈরির স্বপ্ন বুনে যায় সে। কিন্তু যখন সে আসলেই একটা বিয়ে করল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। পারানয়ায় আক্রান্ত থাকায় সুখের মূহূর্ত তৈরি করা দুরূহ হয়ে যায় তার জন্য। সালিমের মতে, সময়ের ঘটনা প্রবাহের সাথে মান্টোর চিন্তার দূরত্ব তৈরি হওয়ায় মান্টো অসহায় ও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন। তিনি কখনো কোনো অনুভূতির সাথে হার স্বীকার না করে স্পষ্ট ও পরিষ্কার ভাষায় লিখে গেছেন।

খোল দো গল্পটিতে মান্টো দেখাচ্ছেন, ঘটনাটি শেষ হওয়ার আগে আমরা কোনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতে পারি না। কারণ ঘটনা যখন ঘটছে তা যে কোনোদিকে মোড় নিতে পারে। গল্পের শেষ চার লাইনে, পিতা-কন্যার মধ্যকার আন্তরিক অনুভূতির অপ্রতিরোদ্ধ আদান-প্রদানের শেষ পরিণতি টানছে দেশভাগ। যা পুরো গল্পকেই প্রভাবিত করেছে। এটা একটা এন্টি-ক্লাইম্যাক্সের মতো গল্পটিকে আরো ধারালো করেছে। আর ওদিকে তুবা টেক সিং দেশভাগের বর্ণিত চিরন্তন গল্প হয়ে উঠেছে, উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের মনে লুকায়িত কষ্টের অনুভূতিগুলোর প্রকাশই যেন গল্পটির হাড়ে-মজ্জায়।