আইয়ুব বাচ্চুর ছেলে ও মেয়ে

আইয়ুব বাচ্চুর ছেলে ও মেয়ে

এলআরবি তুমি কার

শামীমা জামান

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৬, ২০১৯

৫ এপ্রিল ছিল এলআরবির জন্মদিন। আর ১৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে এলআরবিতে বালামের অভিষেক ও এলআরবির নামবদল নিয়ে আলোচনা বিতর্ক চলছে ক’দিন ধরে। এ বিষয়ে কথা বলার আগে চলুন দেখে আসি আইয়ুব বাচ্চুর ভক্ত বলে দাবি করা কিছু মানুষের অমর বাণী। মূলত এই বাণীগুলো দেখে না লিখে থাকতে পারলাম না।

‘বাচ্চু ভাইয়ের পরিবার যদি ব্যান্ডের নামই রাখতে না দিবে তাহলে ব্যান্ডের গানগুলো পরিবেশনের অনুমতি দিল কেন? আর এলআরবির নাম রাখতে না দেয়ার তারা কে?’ তাই তো, তারা কে? কোথা থেকে ভেসে এসেছে তারা? আইয়ুব বাচ্চু তো আপনাদেরই বাপ! ‘আমরা এই আমরা, লাখ লাখ শ্রোতা নিজের বাপের পয়সা দিয়ে এলআরবির গান কিনেছি... সেই টাকা দিয়ে বাচ্চু ভাইয়ের ছেলেমেয়ে আজকে প্রতিষ্ঠিত...’ বাহ! এইতো লাইনে এসেছেন। আপনারা আপনাদের বাপের ঘামঝরা পয়সা দিয়ে বাচ্চু ভাইয়ের গান কিনেছেন আর সেই গান ঘাম ঝরিয়ে গেয়েছেন তাজোয়ার ফাইরুজের বাপ আইয়ুব বাচ্চু। আপনাদের বাপের পয়সার অধিকার আপনারা এত বোঝেন, তাজোয়ার ফাইরুজ বুঝলে সমস্যা?

‘আমার টাকায়, আমার-আপনার বাবার টাকায় আজকের আইয়ুব বাচ্চু, আজকের এলআরবি। আজকের হ্যান আজকের ত্যান। জারজের বাচ্চারা আমাদের আবেগ নিয়ে খেলবে?’ আহা! কী শ্রদ্ধা! কী ভালবাসা ভক্তদের! বলেন আইয়ুব বাচ্চুর গলাটাও আপনাদের। আর চন্দনা ভাবিকে নিয়ে যেসব বাজে মন্তব্য সেসব শুনলে স্বয়ং বাচ্চু ভাইয়ের কী অবস্থা হতো তাই ভাবছি। বেঁচে থাকতে তাকে কোনোদিন দেখেছেন স্ত্রীর নামে বিষোদ্গার করতে? অথচ দায়িত্বে অবহেলা, একা ফেলে দূরে থাকাসহ কেউ কেউতো তাদের ডিভোর্সও দিয়ে দিয়েছেন। মৃত্যুর সময় যে সন্তানেরা পাশে থাকে না বিদেশে থাকে তারা আবার এলআরবির ব্যাপারে বলার কে? এরকমও বলল কেউ কেউ। অথচ তারা কি জানেন না তার সন্তানেরা কেন বিদেশে থাকেন, বাচ্চু ভাই তার সবটুকু অর্জন দিয়ে প্রিয় সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে রেখেছিলেন। যে স্বপ্ন দেখে আপনারাও ইংলিশ মিডিয়ামে বাচ্চা পড়ান। মিডিয়ার যে মানুষগুলো বাচ্চু ভাইকে নিয়ে যে এত আবেগ দেখাচ্ছে, বিশ্বাস করুন এরা বেশিরভাগই বেঁচে থাকতে বাচ্চু ভাইয়ের পিছনে তার বদনাম গাইতো। অন্য লেজেন্ডদের দরবারে বসে বাচ্চু ভাইকে তুলোধুনো করতো। আজ এসব মায়াকান্না দেখলে হাসি পায়।

এলআরবিতে বালামের যোগদান বিষয়টি নিয়ে সকলের প্রবল আপত্তির কারণেই জানতে পারলাম, বালাম এত বাজে সিঙ্গার! মানে বালাম সম্পর্কে এতটাও নিচু ধারণা ছিল না। ওয়ারফেজে তার দীর্ঘ পথচলা, পরবর্তীতে সলো ক্যারিয়ার। তারতো নিজস্ব একটা শ্রোতা বা ফ্যান ফলোয়ার রয়েছে বলেই জানি। আর বালাম তো মনির খান ঘরানার শিল্পী নয় যে, তার গলায় বাচ্চু ভাইয়ের গান মানাবে না। বাচ্চু ভাই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীটারিস্ট, কিন্তু তার গলা নিয়ে তিনি ১০০ পার্সেন্ট সন্তুষ্ট কখনোই ছিলেন না। খালিদের সাথে দেখা হলে তার কিছু কমন ডায়লগ ছিল, ‘খালিদ, আমরা তো ফলস ভয়েসে গান করি। তোমার মতো গলা হলে কি করতাম দেখতে, গানের ব্যাপারে সিরিয়াস হও।’ তবে বালামের দিক থেকে বলতে গেলে বলব এটি ছিল তার বিরাট আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। কারণ বাচ্চু ভাইয়ের মতো শিল্পীদের রিপ্লেসমেন্ট হয় না। এই ঝুঁকি নোবেল নিলেও নিতে পারতো। মূলত বাচ্চু ভাইয়ের পরিবার আর এলআরবির সদস্যদের মধ্যে এলআরবি বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিয়ে যে সব আলাপ বাতাসে ভাসছে তাতে বেশিরভাগই পক্ষপাতদুষ্ট। এলআরবির মতো পুরনো ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ব্যান্ড সদস্যদের রুটি রুজি নির্ভর করেছে এতদিন এলআরবি দিয়েই।

স্বপন ভাইকে যতটুকু জানি তার মতো ডেডিকেটেড পুরনো সদস্যদের একটা অধিকারতো থাকেই সিদ্ধান্ত নেবার। এলআরবি রান করাটা তাদের জন্য খুবই যৌক্তিক দাবি। এলআরবির নতুন সদস্যরাও এমন নয় যে, তারা এলআরবির পাশাপাশি অন্যান্য শিল্পীর সাথে খ্যাপ বাজাতো। তাই এলআরবিকে এগিয়ে নেয়া তাদের জীবিকার তাগিদেই প্রয়োজন। বাচ্চু ভাইকে স্মরণ করতে, বাচ্চু ভাইকে ১০০ বছর বাঁচিয়ে রাখতে এলআরবি র প্রয়োজন, একথা অত্যন্ত হাস্যকর। একজন শিল্পী তার নিজের জীবনে যা করে যান সেই কাজই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। নতুন এলআরবি বরং বাচ্চু ভাইকে আরো মুছে দিয়ে নতুনকেই চেনাবে। কিন্তু এ ক’মাসে বাস্তবতার জল অনেক দূর গড়িয়েছে। বাচ্চু ভাইয়ের মেয়ে ফাইরুজের কথা থেকে জানা যায়, বাচ্চু ভাইয়ের মৃত্যু পরবর্তী বাচ্চু ভাইয়ের পরিবারের সাথে এলআরবির ভূমিকা। এ ক’মাসে নানান শিল্পীকে দিয়ে বাচ্চু ভাইয়ের গান করিয়ে অনেক করপোরেট শো করেছে এলআরবি। চন্দনা ভাবির প্রয়োজনে কোনো সদস্যকে পাওয়া যায়নি এবি কিচেনের ব্যাপারে সাহায্য করতে। যে মানুষটির সৃষ্টি দিয়ে এক সময় অর্থ আসতো পরিবারে সেই মানুষটির সৃষ্টি ও নাম দিয়ে আজ অন্যরা আর্থিক লাভবান হচ্ছে, তারা কেমন আছে তার খোঁজও কেউ নেয়নি।

এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো হজম করতে পরিবারের সময় লাগে। সেই জায়গা থেকে তারা এলআরবি নাম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জানাতেই পারে। আর বাচ্চু ভাই স্বয়ং যেখানে ছেলেমেয়েদের এলআরবির ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, তিনি না থাকলে এলআরবি থাকবে না, এ কথাও বলে গেছেন। সেখানে তো বলার কিছুই থাকে না। ফেসবুকে কিছু ক্রেজি পিপল এ নিয়ে বাচ্চু ভাইয়ের পরিবারকে দেখে নিত টাইপের হুমকিও দিচ্ছে। বাচ্চু ভাই নাকি তাদের সম্পত্তি। পাবলিকের সম্পত্তি। পরিবার কোনো... (অশ্রাব্য)

তারা ঠিক বলেছেন। শিল্পীর সৃষ্টি তার মৃত্যুর পর জনমানুষের সম্পদ হয়ে যায়। তবে তারা এটা জানে না যে, সেটা হয় মৃত্যুর ৫০ বছর পর। তার আগপর্যন্ত পরিবারের কথাই শেষ কথা থাকে। আমাদের দেশের ব্যান্ডগুলো একনায়কতন্ত্রেই চলেছে একমাত্র ভোকাল নির্ভর হয়ে। সেই প্রাণ পুরুষেরা নিভে গেলে ব্যান্ডের আসলে কি আর কিছু থাকে? বাচ্চু ভাইয়ের মৃত্যুর একদিন পরই একটি জাতীয় আবাল দৈনিক ব্যান্ড তারকাদের সাক্ষাৎকার নেয় তারা ইন্তেকাল ফরমালে ব্যান্ডের ভবিষ্যত কান্ডারি কারা হবে তা নিয়ে। কী নির্মম জিজ্ঞাসা! এ বিষয়ে তখন আমার কথা হয় মাকসুদ ভাই, অবসকিওর টিপু ভাইসহ অন্যান্যদের সাথে। সবাই মহাবিরক্ত। খালিদ তো প্রশ্ন শুনে রেগে গেল। এটা আবার কী ধরনের প্রশ্ন? বেশির ভাগই বলেছেন তাদের সন্তানদের কথা। অথচ প্রতিবেদনে সম্পূর্ণ মিথ্যা দিয়ে পৃষ্ঠা সাজানো হলো। সত্যিই অদ্ভুত এইসব কৌতূহলী জনগণ। এরা আবার বাচ্চু ভাইকে ভালোবাসে! তার স্ত্রী সন্তানকে গালি দিয়ে বাচ্চু ভাইকে ভারোবাসে তারা। ভক্ত হওয়া খুব সহজ। আজ আসিফকে ভালবাসলাম তো কাল নোবেলকে মাথায় তুললাম। কিন্তু একজন শিল্পী হওয়া যেমন কঠিন তার চেয়েও কঠিন শিল্পীদের ধারণ করা। আর সেই ধারণ আপনারা গালিবাজ ভক্তরা করেন না, করে তার পরিবার। শিল্পীদের ভালবাসলে তার পরিবারের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। বেগম মুজিবকে সম্মান করেন তো? ইতিহাসের কোনো ঘটনায় তার কি অবদান আছে? কিছুই না। কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করেছেন। জেনে রাখুন, প্রতিটি বিখ্যাত মানুষের ঘরের নারী এক একজন বেগম মুজিব। পরিবারের কষ্টের চেয়ে ভক্তের কষ্ট কোনোদিন বেশি হয় না।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক