এলিজা খাতুনের ৬ কবিতা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৬, ২০২০

বিম্বিত ক্ষণে
 
আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই ওপার থেকে
সে বললো, তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে!

গাঢ় সংকটে, অনটনে
সম্মুখে নৃত্য করবে বিবমিষা তলোয়ার,
সুদীর্ঘ রাত ফুরোতে চাইবে না
পিঠের উপর পড়তে থাকবে আঁধারের চাবুক
তবু তোমাকে দাঁড়াতেই হবে সহ্যের পাললিক তীরে

চোখের নালা কেটে
কিছুক্ষণ ঝরিয়ে নিতে পারো অশান্ত প্লাবন
কিংবা হৃদয়ের গভীরে খুঁড়ে খুঁড়ে
জমিয়ে নিতে পারো স্বপ্নময় অপেক্ষা
যেভাবেই কালক্ষেপণ করো না কেন
হাঁটুর ভাঁজে ভিড়তে দিওনা ভঙ্গুরতা

তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে
দু`পায়ে ভরের সাথে দৃঢ়তা যোগ করে করে

সোনালি গন্তব্য শুধু পায়ের ছাপ পেয়েই খুশি থাকে না
সিদ্ধান্তের কাঁথায় অটল-সুতোর বুনন চায়
আয়নার ভেতর থেকে পুনঃ পুনঃ শুনছি,
তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে

ফেরা

মাটি-মায়ের দুধ ছেড়ে যেদিন চলে এসেছি,
সেদিন থেকেই আকাঙ্ক্ষা পুষে রেখেছি ভেতরে
ফিরে যাব আবার আমার পুরোনো মায়ের কোলে

যেখানে মেঠোপথে ধুলোর আদরে
মার্বেলের সাথে লুটোপুটি খেতো বাড়ন্ত স্বপ্নরা
যেখানে চাতাল-রোদে
কুলোর বাতাসে ধান থেকে সরে যেত চিটে-কুটো
আমি ফিরবো সেখানে

যেখানে
রাত্রের অবিরাম ঘুঘুডাক নিঃস্বার্থ সঙ্গি হয় অন্ধকারে
যেখানে ভরা মাঘে
সর্বাঙ্গ কাঁপলে নিজস্ব অসুখে অনুগত থাকে প্রিয় কাঁথা
যেখানে কাঁথার ফোঁড়ে সেঁটে থাকে আঁতুড় ঘরের ঘ্রাণ
আমি ফিরবো সেখানে
নিজের কাছে ফিরে নিজেকে জানিয়েছি এ কথা

যেখানে সবুজ আদরে
পাতায় পাতায় টপকে বেড়ায় ছুটন্ত উচ্ছ্বাস
যেখানে প্রান্তিক স্মৃতি জমা আছে সময়ের সিন্দুকে
ফিরবো সেখানে, এ আমার সাধ ও সাধনা

মাটি দাও, সবুজের মজুর হবো

কর্তব্যের গিরোয় বাঁধা স্বপ্নের পুঁটলি
কাঁধে ঝুলেছে সেই বুঝতে পারা বয়স থেকে
তখন থেকে জল-মাটি ঘেঁটে ঘেঁটে
কাদা ছেনি, কাদা তুলি
বেড়ার গায়ে খাবল ভরে কাদার মণ্ড ছুঁড়ি
কঞ্চির হাড়-পাঁজর ঢাকি, দেয়াল তুলি
উঠোনের সমতা আনতে
চাক চাক মাটি ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করি
দুরমুশের ভীষণ ঘা`য়ে
বহুকাল ধরে ক্ষত-বিক্ষত মজুর আমি
দু`খানা হাত পেলবতাহীন কড়কড়ে সেই কবে থেকে!
আজ কোথায় সে ঘর! কোথায় উঠোন?
মাঠ বিল ক্ষেত কোনখানে আর অবশিষ্ট আছে
ঝমঝম বৃষ্টি পড়ার এতটুকু মাটি!
আর কতটুকু আছে!
শস্যের স্বর্ণালি থোকায় বাতাসের হাসিখেলা দোল!
আমার লাঙলখানা জলে জং ধরা
ঘাসের কাঙাল-হাড় জেগে ওঠা বলদ জোড়ার
কান্না-কাজল চোখ, গোলপাতা-চাল ক্ষয়ে ডাঁটা ডাঁটা
আমার সবটুকু নীল মেঘের আড়ালে
সব সোনা মাটি নোনা সমাধিতে
বৈদ্যুতিক তার-জালের দখলে প্রিয় আকাশ
স্বপ্নগোঁজা সমূহ চারা
প্রগাঢ় সবুজ বৃক্ষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষাতে
ইট-পাথরের শরীর ফুঁড়ে তবু সে ঊর্ধ্বগামী!
সবুজ বোধে ক্ষীণ আশায় এখনও কিছু মাটি খুঁজি  
যদি বিস্তার হতে চায় আগামী শেকড়!
আমি মজুর থাকবো ষোলআনা

সত্য তুমি

তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে
আমাকে আঘাত করা হলো
ফেলে আসা হলো অসত্যের ভাগাড়ে
চৈত্রের রোদ খরা খেয়ে
শ্রাবণের জল পান করে
বেঁচে ফিরি একাকিত্বের উঠোনে
তবু তোমাকে ভুলিনি
তখন থেকে মধ্যরাতের নৈঃশব্দ্য সাক্ষি
ক্ষতের দোয়াতে অনুভূতির কলম চুবিয়ে
লিখি শুধু তোমার নাম, ‘তুমি’
তুমি আমার একান্ত সত্য
আমাকে সত্যে থাকতে দাও

সৌভাগ্যের গল্প

দিনের প্রথম সোনালি রোদ দেখেছি
বাবার চিবুকের মিহি ঘামে চিকচিক
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জল দেখেছি
মায়ের ভেজা মুখে ওযুর পানির ছিটেফোঁটা
কত কত রাত অনটনে পোড়া স্মৃতি
প্রতিদিন ভোরে এখনও ভীষণ তাজা
সাবধানিরা বেড়াল পায়ে
পাশ কেটে যায় সুখের মুখোশ এঁটে
আমরা এখনও পয়সা জমাই
শিঁকেয় ঝোলানো সৌভাগ্যের ঘটে

এই হাত রাখো

মহাকালের ব্যবধানে
গুহা থেকে ইমারত অব্দি গেঁথে আছে যাদের
ক্ষুধা চিৎকার, ঘামের নকশা, রক্তের কারুকাজ
সেইসব নিঃস্ব প্রাণ অনটনের স্থায়ী নাগরিক
পথে পথে ছুটে চলে অবিরাম
ওদিকে মজুতদারের ঘেরাটোপে
সমূহ বাজার অসহায়
তছনছ করে ফেলছে ওরা ছুটন্ত জীবনের পাকস্থলি
ওরা ক্যামেরা সম্মুখে
সুদৃশ্য মোড়কে অনাচার ভরে নিয়ে
সুড়সুড় করে ফিরে যায় নিজস্ব গুদামে
নুন পেঁয়াজের সঙ্গে অন্ধকারে গুদামজাত হয়
ওদের কালো কালো পাপ
আমাদের সাদা নুনে কালো দাগ পড়তে দিই কী করে!
বরং এসো
আমাদের সাথে সাথে এই হাত রাখো;
গুদামঘরের বস্তা ছিঁড়ে
যে হাতে খুব লুট করা যাবে মুঠো মুঠো সাদা নুন