এহসান হাবীবের গদ্য ‘আত্মজৈবনিক’
প্রকাশিত : অক্টোবর ২৬, ২০২০
কই যেন যাইতে ইচ্ছা করছিল। কয়দিন ধরেই। আমার এরকম হয়, ঘুম থেকে উঠে কোনো একদিকে চলে যেতে ইচ্ছা করে। পরিচিত বান্ধবদের নক করছিলাম, তারা বিশেষ সাড়া দেয় নাই। উৎসব নিয়া হয়তো তারা বিশেষ ব্যাস্ত।
তো আজকেও ঘুম থেকে উঠে মনে হলো, যাইগা। কই যাই? ভাবলাম, কেশরগঞ্জ যাই। আহা! কেশরগঞ্জ। জীবনের কত কত সময় আমি কেশরগঞ্জকে দিয়া দিছি। পৃথিবীর খুব ছোট্ট বাজার কেশরগঞ্জ। অনাড়ম্বর। জৌলুসহীন একটা জনপদ কেশরগঞ্জ। কিন্তু আমি খুব যাইতাম। রাখির বাড়ি ছিল ওখানে। রাখি যখন বাড়ি যাইতো আমি নিয়া যাইতাম। আবার যখন আসতো আমি আগেভাগে কেশরগঞ্জ চলে যাইতাম। গিয়া নিয়া আসতাম। পাশাপাশি, গায়ে গা ঘেঁষে আমরা রিকশায় বসে থাকতাম।
তারপর চল্লিশ কিলো রাস্তা আমরা পাড়ি দিয়া আসতাম। সেইসব কথা গল্প তো বাঘে খেয়ে ফেলছে। আজ আবার মন চাইলো কেশরগঞ্জ যাই। ওখানে কবি সুজাদ্দৌলাহ আছে। ভাবলাম পুরনো কেশরগঞ্জের বাজারে বসে সুজাউদ্দৌলার সাথে আমরা পুরনো পৃথিবীর গল্প করবো। সিএনজিতে বসে কবি বিল্লাল মেহদীকে ফোন দিলাম। সুজাদৌল্লাহর নাম্বার দেন। সুজারে ফোন দেই সে আর ধরে না। বিল্লাল অন্য আরেকজনের সাথে কথা বলায়া দিলো। আমি কেশরগঞ্জ বাজারে নেমে তারে ফোন দিলাম। তিনি মোয়াজ্জেম ভাই।
মোয়াজ্জেম ভাই বললেন, আপনি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ান। আমি আপনারে নিয়া আসবো। আমি দাঁড়ায়া আছি। বাজার তো আর পুরনো নাই। বাজার রীতিমতো হাটবার হয়ে আছে। আমি আমার পুরনো কেশরগঞ্জকে খুব মিস করলাম। এইরকম দুপুরে আমি যখন কেশরগঞ্জ বাজারে নামতাম, বাজারটা তখন খা খা করতো। কেশরগঞ্জে খুব গরম থাকতো। আমি সেই গরমের মধ্যে কেশরগঞ্জ বাজারের নিঃসঙ্গতা টের পাইতাম। দূর থেকে কীরকম একটা হাহাকার ভেসে আসতো।
আজকে কেশরগঞ্জে নেমে এই শূন্যতা আর হাহাকারটাকে খুব করে মনে পড়লো। খুব মিস করলাম। একটা বিষণ্ণ দুপুরের হাহাকার ভরা পরাবাস্তববাদী বাজারের এই জমজমাট রূপ আমাকে বিষণ্ণ করে তুললো। আমার মন খারাপ হয়ে এলো। আমি একা একা কিছুক্ষণ বাজারের ভেতর হাঁটলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি একটা মোড়ের সামনে এসে দাঁড়ায়া পড়লাম। মোড় থেকে বামে যে রাস্তাটি গেছে তার কিছুই আর আগের মতো নেই। এক যুগেরও বেশি সময় পর এই রাস্তার চারপাশের খোলনলচে সবই পাল্টে গেছে। তবু আমার বুঝতে এতটুকুও কষ্ট হয়নি যে, আমি এই রাস্তায় জীবনে বহুবার হেঁটেছি। এই রাস্তার সম্ভবত প্রতিটি ইঞ্চিতে আমার পায়ের ছাপ লেগে আছে।
আমি হঠাৎ বিপন্ন বোধ করি। এবার আমি মোয়াজ্জেম ভাইকে আবার ফোন দিই। মোয়াজ্জেম ভাই বাইকে চড়ে এলেন। আমাকে বাইকে চড়ার আহ্বান করলেন। কিন্তু এই দুপুরের রোদে আমার খুব হাঁটতে ইচ্ছা করছিল। আমি বললাম, একটু হাঁটবো। আপনার যদি কষ্ট হয় তাহলে আপনি বরং এখানেই অপেক্ষা করেন। আমি হেঁটে আবার ফিরে আসবো। মোয়াজ্জেম ভাই আমাকে সঙ্গ দিলেন। আমরা রাস্তা ধরে হাঁটছি। কিছু আমার স্মৃতি আর কিছু মোয়াজ্জেম ভাইয়ের ধারাভাষ্য সব মিলিয়ে জায়গাটা আবার আমার কাছে জীবন্ত হয়ে উঠছে।
হঠাৎ রাখিদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমি মোয়াজ্জেম ভাইকে বললাম, এইটা দাম বাড়ি। এই বাড়ির ছোটমেয়ে রাখিদামকে আমি খুব ভালোবাসতাম। তার ভালোবাসার টানেই আমি জীবনে অনেকবার এইখানে এসেছি।
মোয়াজ্জেম ভাই কতক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাবেন বাড়ির ভেতরে?
আমি না বলে উড়িয়ে দিলাম। তারপর ভাবলাম, একটু দুষ্টুমি করি বউয়ের সাথে। বউকে ফোন দিলাম, এনু আমি তো কেশরগঞ্জ আসছিলাম। রাখির বাড়ির সামনে দাঁড়ায়া আছি। কি করি? তখন সে উল্টা আমারে প্রস্তাব দিয়া বসলো, রাস্তায় দাঁড়ায়া কি লাভ? বাড়ির ভেতরে যাও। আমি বললাম, বাড়ির ভেতরে গিয়া লাভ কি? রাখি তো আর নাই। এনি বললো, রাখি নাই তাতে কি? তার আম্মা তো আছে। তার সাথে দেখা করবা। রাখির ফোন নাম্বার নিয়া আসবা।
ফোন নাম্বার পাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নাই। কিন্তু বাড়ির ভেতরে যাওয়ার খুব লোভ হচ্ছিল। হাসান জামিলরে জিগাইলাম। জামিল কইলো, মিতু ভাই আপনের মাথা ডিস্টার্ব দেখা দিছে। আপনি চইলা আসেন। আমি কইলাম, তোমার ভাবি যে কইছে বাড়ির ভেতরে যাইতে। জামিল বললো, তাহলে যান। এইবার আমি মোয়াজ্জেম ভাইরে জিগাই, আপনি নিয়া যাইতে পারবেন? সে খুব আত্মবিশ্বাসী উত্তর দিলো, হ্যাঁ, অবশ্যই পারবো। বললাম, মাইর টাইর খাওয়ার কোন চান্স নাই তো?
আরে নাহ, কী যে বলেন! মোয়াজ্জেম ভাইয়ের এইরূপ কনফিডেন্স দেখে আমি বললাম, আল্লাহ ভরসা চলেন। বাড়িতে গেলাম। রাখির মা। এই মুহূর্তে আমার সামনে রাখির প্রতিবিম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে নমস্কার বলি। উনি জবাব দিলেন। বললাম, কাকিমা আমাকে চিনতে পারছেন? মাথা নেড়ে বললেন যে চিনতে পারেননি। আমি উনাকে কিছুটা সময় দিলাম যাতে আমাকে ভালো করে দেখে নিতে পারেন। তারপর বললাম, কাকিমা আমি মিতু। ভদ্রমহিলা বোধহয় কিছুক্ষণের জন্য বোবা হয়ে গেলেন। নিজের মেয়ের প্রাক্তন প্রেমিক তেরো বছর পর তার সামনে এসে দাঁড়াবে। এটা বোধহয় ভাবেননি।
যাই হোক, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ভারটা আমিই নিলাম। তারপর বড় মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম। তারপর ছেলের কথা। ভদ্রমহিলা এখনো যথেষ্ট স্মার্ট। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন। অনেকটা সময় পরে আমি তার ছোট মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম। একটু কি বিষণ্ণ হয়ে উঠলো তার মুখ? তার গলাও কি একটু ভারী? যেন দূর থেকে বলছেন তার ছোটমেয়ের কথা। আমার কানে ঠিক স্পষ্ট পৌঁছাচ্ছে না। এই অস্পষ্ট কথামালার মাঝে বললাম, কাকিমা আজ তাহলে যাই।
তিনি বললেন, আবার এসো। আবার বললেন, তুমি আসবা কিন্তু। আমি বললাম, কাকিমা আসবো। বলে বের হয়ে আসি। রোদের ভেতর আমি আর মোয়াজ্জেম ভাই হাঁটি। আমার খুব আস্তে হাঁটার স্বভাব। তবু রোদের ভেতর হাঁটছি তো। ঘামছে শরীর। ঘামতে ঘামতে ভাবছি, কত কত জায়গায় আমি ফেরার কথা দিয়ে রেখেছি। যাব বলে কত ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি কিন্তু আর কোথাও কি যাওয়া হয়েছে আমার? কোথাও কি ফিরতে পেরেছি?
লেখক: কবি
























