প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

ওয়াজ বিতর্ক: মাহফিল সংস্কৃতি বনাম সেক্যুলার বিনোদন সংস্কৃতি

আহমেদ সাব্বির

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২২, ২০২০

বাংলাদেশে ওয়াজিনদের বিতর্কিত কথাবার্তা নিয়ে তুমুল আলাপ চলছে ফেসবুকে। হাস্যকর চাপাবাজি, মূর্খতাপূর্ণ বক্তব্য প্রভৃতির ভিডিওতে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে নিউজফিড। অনেকেই এটা নিয়ে তাদের অস্বস্তির কথা জানাচ্ছে। কেউ কেউ প্রবল সমালোচনা করছে। তবে বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এটা হাজির হচ্ছে বিনোদন হিসেবে। যেটা মূলত ফেসবুক সংস্কৃতির একটা স্বাভাবিক দিক। সব কিছুকে বিনোদনের পণ্য হিসেবে দেখা। তবে যারা সিরিয়াস কমেন্ট করছে, সমালোচনা করছে, তাদের মধ্যেও বিষয়টিকে বৃহত্তর জায়গায় কানেকট করে দেখবার ব্যর্থতা লক্ষণীয়।

মূলত ওয়াজে হাজির হওয়া ভাঁড়ামি চাপাবাজি কিংবা সস্তা বক্তব্যের যে জোয়ার, সেটাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখাটা সমস্যার গোড়ায় যেতে বাধা তৈরি করে। বরং এটার সাথে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় উৎপাদিত বিনোদন সংস্কৃতির কি সম্পর্ক, সেটা পর্যালোচনা করা জরুরি। তবে তারও আগে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই বিনোদন সংস্কৃতির সাথে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মাহফিলসংস্কৃতির সম্পর্ক কি, তার আলাপ করা দরকার।

মাহফিল সঠিক দ্বীন বা ইসলাম প্রচারে কিংবা মানুষের আত্মশুদ্ধিতে কতটা ভূমিকা রাখে, সেটা নিয়ে কথা বলা আমার কাজ নয়। এটা নিয়ে জ্ঞানী আলেমরা কথা বলবেন। আমি শুধু সাংস্কৃতিক দিক নিয়ে কথা বলি। আমরা যদি এদেশের পপুলার ইন্টারটেইনমেন্টের দিকে তাকাই যার মধ্যে সমস্ত মেইনস্টিম কালচারার প্রডাক্ট অন্তর্গত— গান, সিনেমা, নাটক— এটা কিন্তু পুরোপুরি সেক্যুলার ইন্ডাস্ট্রি। সেক্যুলার শব্দটি এখানে ব্যবহার করছি কালচারাল সেন্সে। ধর্মীয় অথরিটি আর বিধি-বিধান দিয়ে পরিচালিত হওয়ার সেন্সে নয়। ধর্মীয় অর্থে গ্লোবাল ইন্টারটেইনমেন্টের সমস্ত ট্রেন্ড স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সেক্যুলার।

কিন্তু বাংলাদেশের ইন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি শুধু ধর্মীয় জায়গায় নয়, বরং সাংস্কৃতিক জায়গায়ও সেক্যুলার। কারণ এখানে ইসলাম, মুসলিম সংক্রান্ত যে কোনও চিহ্নকে খুব সতর্কতার সাথে পরিত্যাগ করা হয়। এটা কিন্তু আপনি বলিউডে পাবেন না। ইভেন হলিউডেও পাবেন না। ইন্ডিয়া তার হিন্দুধর্মের চিহ্ন উপাদান নিজেদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে খুব গর্বের সঙ্গে প্রেজেন্ট করে তাদের সিনেমা গান প্রভৃতিতে। কিন্তু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাছে আধুনিকতা আর সেক্যুলারিজম হাজির হয়েছে কেবল ইসলাম ধর্মের বিধি-বিধান ত্যাগ করার মধ্যে নয়, বরং আরো একধাম অতিক্রম করে এর সমস্ত চিহ্নকে পরিত্যজ্য ঘোষণা করার মধ্যে।

এখানেই মাহফিল আর ওয়াজিনরা তাদের তাৎপর্য নিয়ে হাজির। এখানে উপস্থিত পপুলার আলেমরা ইসলামিক জ্ঞান নিয়ে হাজির থাকুক বা নাই থাকুক, অন্তত ইন্টারটেইনমেন্টের ফর্মে ইসলামের চিহ্ন নিয়ে প্রবলভাবে হাজির। এটা কিন্তু অবহেলা করার বিষয় নয়। তারা কিন্তু এই ফর্মের মধ্য দিয়ে এলিট পপুলার ইন্ডাস্ট্রির বিপরীতে বিশাল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আপনি যদি চিন্তা করেন, একটা মেইনস্ট্রিম গানের কনসার্টে যত-না মানুষ হাজির হয় তার থেকে একটা মাহফিলে অনেক বেশি মানুষ হাজির হয়। এখানে কিন্তু মহিলাদেরও বিশাল অংশগ্রহণ থাকে।

আমরা বামপন্থীদের মুখে গ্রামসির থিওরি অনেক শুনি, কিভাবে হেজিমনিক এলিট কালচারের বিপরীতে সাবঅল্টার্ন কালচার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষের কারণে মাহফিলের মতো একটা পপুলার কালচারকে তারা তাদের তৈরি করা লেন্স দিয়েও দেখতে অক্ষম। তাদের চোখে সাবঅল্টার্ন কেবল তাদের মতোই সমাজ এবং গণমানুষের উপর প্রভাববিহীন বয়াতিরা। এজন্যই এর আগে কোথায় যেন বলেছিলাম, বাংলাদেশ এতই ফকিন্নি একটা দেশ যে, যারা এখানে নিজেদেরকে সাবঅল্টার্ন বলে পরিচয় দেয় তারা মূলত এলিট। আর এটা তাদের জাতে ওঠার বাহন। এই সাব-অল্টার্ন স্টাডিজের লোকেরাই আইডেন্টিটির আলাপ এনে মুখে ফেনা তোলে। কিন্তু আপনি মুসলিম আইডেন্টেটির আলাপ তোলেন, দেখবেন তারা ওয়ার অন টেরর এর সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হবে আর আপনাকে শায়েস্তা করবার জন্য শাহবাগ কায়েম করবে।

এখন ওয়াজ-মাহফিলে সস্তা মার্কেটেবল কন্টেন্ট নিয়ে কথা বলি, সেক্যুলাররা যেটা খুব হাই-লাইট করেছে। কিন্তু এর আগে চলেন তাদেরকে একটু স্মরণ করিয়ে দিই, আপনাদের মেইন স্টিম কালচারাল কন্টেন্টের কি অবস্থা? আপনারা টেলিভিশনে মোশাররফ করিম কিংবা চঞ্চল চৌধুরীর সেসব নাটক দেখান তার কন্টেন্ট আলেমদের বয়ান করা কন্টেন্টের থেকে কতগুণ বেশি ভালগার, সেটা কি বলবেন? আপনারাতো আবার ওয়াজ-মাহফিলে নারী বিদ্বেষ নিয়ে অনেক সোচ্চার, কিন্তু আপনাদের নাটক-সিনেমায় নারীর রিপ্রেজেন্টেশনের কি অবস্থা? আইটেম সংয়ের ব্যাপারে কি বলবেন আপনারা? নারীকে যৌন কমডিটি আকারে প্রতিনিয়ত এভাবেই হাজির করা হচ্ছে না?

এটা কেবল প্রকাশ্য দিক। পর্দার আড়ালের চিত্র কত ভয়াবহ, তা মি টু মুভমেন্টের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়। এখানে নারী শিল্পীদের বেশিরভাগকে মূলত দেহ বিকিয়ে বিকিয়ে উপরে উঠতে হয়। সস্তা কন্টেন্টের ব্যাপারে আরেকটা দিক খেয়াল রাখা দরকার, বাংলাদেশে ডিজিটাল কিংবা প্রিন্ট মিডিয়া মূলত ফেসবুক আর ইউটিউব আসার আগপর্যন্ত সেক্যুলার সংস্কৃতির একচ্ছত্র দখলে ছিল। আর এর মধ্যে দিয়ে বাণিজ্যিক লাভের উদ্দেশ্যে ঘরে ঘরে টেলিভিশন, রেডিওতে দীর্ঘকাল ধরে সমস্ত সস্তা কালচারাল কন্টেন্ট তৈরি করেছে কিন্তু তারাই। মাহফিলে সস্তা বিনোদন খোঁজা এই দর্শক শ্রেণি তৈরিতে কালচারকে কমোডিটি বানানোর এত বছরের তাদের নিরন্তন কর্মের কোনও অবদান নাই বলছেন?

মাহফিলে বানোয়াট আলাপ বন্ধে নিশ্চয়ই আলেমরা সোচ্চার হবেন, এ আশা রাখি। কিন্তু সেক্যুলারদের ক্ষোভ আর হিংসাকে পাত্তা দেবার কিছু নাই। তাদের ক্ষোভ মূলত তাদের পরাজয়ের চিহ্ন বহন করে। রাষ্ট্র তাদের হাতে, এলিট সমস্ত মিডিয়া তাদের হাতে। এসব কিছু সত্ত্বেও ইসলামের সাথে অন্তত কালচারালি কানেক্ট হতে মানুষ মাহফিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এটার অন্তরজ্বালা না বোঝার কারণ নাই। আশা করছি, আলেম-সমাজ আরো বিজ্ঞতার পরিচয় দেবেন। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদ বন্ধ করবেন এবং তাদের আসল শত্রুকে চিনবেন। নিজেদের মধ্যে হেজিমনির লড়াই করে সেই শত্রুকেই শক্তিশালী করা হয়, এটা বোঝার মতো বিচক্ষণতা তাদের আছে বলেই মনে করি।