ওয়ান্ডারল্যান্ড

লুতফুন নাহার লতা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৯, ২০১৯

`ওয়ান্ডারল্যান্ড` শব্দটি আমার খুব প্রিয়, এই শব্দের কাছে নীল প্রজাপতি হয়ে উড়তে থাকি। আর `স্নো ওয়ান্ডারল্যান্ড` যদি পাই, তবে তো আমি সেই তুষার সাদা পরির ডানা দুটোই পেয়ে যাই হাতে।

স্বপ্নে পরির দেশে গেছি অনেকবার। মায়ের কাছে আমপারা হাতে নিয়ে বসে, আল্লাহ ও নবির গল্প শুনেছি অনেক। বেহেস্ত নামের ফুলের বাগানে থরে থরে ফুটে আছে ফুল আর তার মধ্যে নানান কিসিমের পুতুল টাইপের ডানাওয়ালা পরিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। তারা কেবল আঙ্গুর আর আনার খায়। (এই দুটি ফল আমার বিশেষ প্রিয়) বেহেস্তের গল্প বলার সময় মা কেন ডালিমকে আনার বলত, তা বুঝতে পারতাম না। অজানা অচেনা সেই সব গল্প বলার সময় আমার মা কেমন কুয়াশায় ঢেকে যেতেন, কেমন অচেনা আর আবছায়া হয়ে উঠতেন। কেন! সে এক বিস্ময়! আমিও বুঝতে পারতাম, যে গল্প মা বলছে, তা নিজেও সে কোনোদিন চোখে দেখেনি। সত্যি কি মিথ্যে তা সে জানে না, তবু কী অদ্ভুত ভালোবাসায়, অন্ধ আবেগে মার চোখ ভরে আসত জলে। বিশ্বাস এমন এক অন্ধ আফিম, মানুষ তার তল খুঁজে পায় না, খুঁজতে চায়ও না।

তো সেই ওয়ান্ডারল্যান্ড আমার জীবনে আর আসেনি। আমরা বড় হয়েছি খুব অল্প পেয়ে। খেলার পুতুল, জামা, জুতো, চুড়ি, ফিতে, ব্যাগ, ইচ্ছে মতন পড়ার বই, খাতা পেন্সিল সবই ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আবার পরিবারে ছেলেদের যদিও বা কিছুটা ইচ্ছে পূরণ হতো, মেয়েদের তাও নয়। বাড়ির ছেলেটিকে খেলার ব্যাডমিন্টন, বল বা বাইক কিনে দিলেও মেয়েটিকে কিন্তু অত পয়সা খরচ করে একটি দামি পুতুল বা ছেলেদের মতো একটি বাইক কিনে দেয়া হতো না। তো সেই আমার অল্প পাওয়া বেড়ে ওঠা মেয়েবেলায় একটি স্বপ্ন আমাকে নিয়ে যেত সেই ওয়ান্ডারল্যান্ডে। মনে হতো, একদিন খুব নিশুতি রাতে হিমালয়ের সবচেয়ে উপরে দাঁড়িয়ে যদি দেখতে পেতাম পৃথিবীটাকে তবে সেই হতো আমার ওয়ান্ডারল্যান্ড! মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে এক নিশি কুহক ডেকে গেছে আমায় চিরদিন! সে ডাকে আমি আজো জেগে উঠি এক আকুল শূন্যতা নিয়ে। ইচ্ছে হয়, সুন্দরবনের অরণ্যে গভীর রাতে গাছের উপর একা বসে থেকে যদি দেখতে পেতাম সুন্দরবনের সেই রূপ! কিম্বা নর্থপোলে যখন তুষারাবৃত সাগর আর পাহাড়ের গা বেয়ে লাখে লাখে মা পেংগুইন হেঁটে যায় ডিম দেবার পরে কিছুদিনের জন্যে স্বাস্থ্য উদ্ধারে, বাবার বুকের তলায় ডিম রেখে যায় আর বাবারা বুকের উষ্ণতায় ফুটিয়ে তোলে তার আগামী সন্তানের জীবন, যদি কাছ থেকে দেখতে পেতাম, সেই হত আমার সত্যিকারের ওয়ান্ডারল্যান্ড। এমনি করে কত ইচ্ছে, কত স্বপ্ন মনের ভেতরে জেগে জেগে চোখ মেলে আছে অনির্বাণ, আমি ঘুমুতে পারি না।

১৯৯৫-৯৬ এর দিকে একটি নাটকের শুটিংয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে গিয়েছিলাম। সেই রাতে আকাশ থেকে যেন জ্যোৎস্নার প্লাবন নেমেছিল। কাছাকাছি ছেঁড়া দ্বীপে সারাদিন কাজের পরে সেন্টমার্টিনে ফিরে এসেছি। ভরা পূর্ণিমার ডাকে, সমুদ্রের বুকভাঙা উত্তাল তরঙ্গ পেরিয়ে সে রাতে আমরা পড়ে গেলাম এক সমুদ্রঝড়ে। টেকনাফে ফেরা হলো না আমাদের। মধ্য সমুদ্রে এসে আবার সেন্টমার্টিনে ফিরে গেল নাটকের পুরো ইউনিট। চায়ের জল ফুটছে দোকানের কেতলিতে আমরা বসে আছি স্থানীয় একমাত্র প্রাথমিক স্কুলের হেডমাস্টারের বাড়ির উঠোনের বাতাবিলেবু গাছের নিচে। রাস্তার ধারে চালা ঘরের ভাতের দোকানে আমাদের জন্যে মুরগির ঝোল রান্না হচ্ছে, সেই ঝোলের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাবিলেবু গাছের তলায়, নারকেল গাছের ছায়ায় ছায়ায়, বাড়ির সামনে জাল মেলে দেয়া উঠোনের চারদিকে।

টিমটিমে হারিকেন আর কুপি বাতির আলো-আঁধারির গা ছমছমে অবস্থাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চাঁদের আলো। আমরা বেশ কয়েকজন হেঁটে হেঁটে লেখক হুমায়ুন আহমেদের বাড়ির সামনের প্রবাল দ্বীপে এসে বসেছি। জলে স্থলে আকাশে মাটিতে মাখামখি আলো। ঝিনুকের মতো ঝিকিমিকি অসামান্য এক রাত। শংকর সাঁওজালদা গান ধরেছেন, আনন্দলোকে মঙ্গল আলোকে বিরাজো সত্য সুন্দর...

সেই যে প্রাণ উজাড় করা জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা, তা আমাদের আমূল ভাসিয়ে নিয়েছিল আকাশ আর সাগরের মিলিত মোহনায়। সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্য, সেই মুগ্ধ বিস্ময়, সেই মোহময় ক্ষণে জলের উপর পা ভাসিয়ে পৃথিবীর বুকের উপর সাগরের আছড়ে পড়া দেখেছিলাম, সেই তো আমার ওয়ান্ডারল্যান্ড।

আমার মায়ের এক কাজিন এসেছিলেন আমেরিকায় ১৯৬৫ সালের দিকে পড়াশুনা করতে, জন্মের পরে তাকে একরকম দেখিইনি বলা যায়। আমেরিকার কালো মানুষের ইতিহাসে ১৯৬০ এর দিকটা একটি উল্লেখযোগ্য সময়। এসময়ে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গরা কালো মানুষগুলোকে মানুষের মর্যাদা দিতে শুরু করেছে। কালোদের পক্ষে আইন প্রণয়ন হচ্ছে। স্কুলগুলোতে ডিসেগ্রিগেশান শুরু হয়েছে। রুবি ব্রীজেস নামে বছর ছ`য়েকের এক কালো মেয়েকে সবার সাথে একই স্কুলে যেতে অনুমতি দিয়েছে কোর্ট। সাদা রেসিস্টদের বাধার মুখে রাষ্ট্র তাকে পুলিশ প্রোটেকশানে স্কুলে আনা নেয়া করতো। আস্তে আস্তে কালো ছেলেমেয়েরা পুলিশ প্রোটেকশন ছাড়াই সাদাদের সাথে ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে যেতে শুরু করেছে। নিউইয়র্কের হার্লেম রেনেসাঁসের পর কালোদের অধিকার আদায়ের শপথ দাবানল হয়ে জ্বলছে। তৈরি হচ্ছে রাস্তাঘাট, হাইওয়ে, হাইরাইজ বিল্ডিং, আমেরিকাতে সে এক অসাধারণ পজেটিভ পরিবর্তনের সময়। এক মহা কর্মযজ্ঞের সময়। এই সময়কালটি ছিল এক আঁধার পেরিয়ে আলো জয়ের উৎসব। তো সেই সময় আমেরিকা এক ওয়ান্ডারল্যান্ড আমার কাছে।

এরই ভিতরে আমার সেই মামা পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফেরার সময়ে উপহার হিসেবে আমার বাবার জন্যে নিয়েছিলেন একটি রূপোর সিগারেট ছাইদানি। তার গায়ে খোদাই করা একশো তলা অ্যাম্পায়ার এস্টেট বিল্ডিং! তখন তো আর হাতের কাছে গুগল ছিল না, কারো কাছে গল্পের মতো করে ইনফরমেশানগুলো শুনতাম, আর যা শুনতাম তা মনের ভেতর ছবি এঁকে দিত। অ্যাম্পায়ার এস্টেট বিল্ডিং! কত তলা, মামা সেখানে উঠেছ কিনা, দেখতে কেমন, উপরে উঠে ভয় করে না! আর স্নো! সে কেমন দেখতে! চারদিকে সাদা হয়ে যায়! ঘরবাড়ি সব ঢাকা পড়ে যায়! বলো কি! তোমরা ফ্রিজের ভেতরে থাকো! কত যে প্রশ্ন। মামা ফিরে এলেন কিন্তু সেই স্নো দেখার স্বপ্ন আমার দু`চোখে আঁকা হয়ে রইলো।

কত কত দিন যে আমার মা গোলাম আলী মামার দেয়া সেই রুপোর ছাইদানি তার শোকেসে সাজিয়ে রেখেছিল! খুঁজলে আজো হয়তো মায়ের আলমারিতে তা পাব। মামার কাছে শুনেছিলাম স্নো কি জিনিস! আকাশ থেকে ঝিরিঝিরি সাদা স্নোর পাউডার পড়তে থাকে, আবার কখনো তা বেশ হালকা চালে কাগজের টুকরোর মতো হাওয়ায় ভেসে ভেসে নামে। তারপর চারদিক সাদা, গাছপালা ঘরবাড়ি সব ঢাকা পড়ে থাকে সাদা বরফের তলায়। কী অসামান্য সেই শুভ্রতা!

বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু সতীর্থ বাবলু যখন তখন কাগজের ঠোঙায় ছবি এঁকে দিত, ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী বন্ধু লিপির কোঁকড়া চুল সে এঁকে ফেলত দ্রুত কলমের টানে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সব আম গাছ জানে বাবলু যখন লিপির কোঁকড়া চুলের উপর ঝিকঝিকে বরফের কুচি এঁকে দিত, আমি তখন ঝালমুড়ির ঠোঙা এগিয়ে দিয়ে বলতাম, আমার স্ট্রেইট চুলে যদি বরফের কুচি আঁকতে পারিস তবেই তুই রিয়েল চিত্রশিল্পী! বন্ধুরা ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে একসাথে বসে সেই অকারণ হাসি, অকারণ আনন্দে মেতে থাকার সময়েও মনে হতো, সত্যিই তো স্নো পড়া যদি দেখতে পারতাম!

যখন আমেরিকায় আসি বেমালুম ভুলে রইলাম, যে দেশে যাচ্ছি সেখানে তুষারপাত হয়, ঘন তুষারপাতে কখনো কখনো জীবনহানিও ঘটে। এসেছিলাম সামারে, কিন্তু অক্টোবরের শুরুতে যখন শীত এলো হাড় কাঁপিয়ে, তখনি বুঝতে পারলাম শীত কাকে বলে! ডিসেম্বরে যখন শুরু হল স্নো! ওহ সেকি আনন্দ, সেকি মুগ্ধ বিস্ময়!

সেই থেকে স্নো পড়লেই জানালা দখল করে বসি। সারাদিন সারারাত অনায়াসে চেয়ে চেয়ে দেখতে পারি পেজা তুলোর মতো ঝরছে স্নো! আর যখন চারদিক ঢেকে যায় ফেরেশতাদের পাতানো দুধ সাদা চাদরে, পাতাঝরা বৃক্ষেরা শূন্য ডালে বরফের ফুল ফুটিয়ে দেয়, আমি আনন্দে উচ্ছ্বাসে বেরিয়ে পড়ি গাড়ি নিয়ে। ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়াই যতদূর চোখ যায়! বিস্ময়ের ঘোরের ভিতর মায়ের সুরেলা কণ্ঠের কোরআন তেলাওয়াত শুনতে পাই যেন! সারা পৃথিবী কেমন নরম সাদা মোমের মতো গলে গলে ঝরে! মনে মনে বলি এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আজ আমার একান্ত স্নো ওয়ানডারল্যান্ড!