কওমি অঙ্গনের বিপর্যয়ে নির্জনতাই নিরাপদ

তারেকুজ্জামান তারেক

প্রকাশিত : জুলাই ১৪, ২০২০

অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে, শত ঝড় ও প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে, সাধ্যের চেয়েও অনেক বেশি অর্থ খরচ করে নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলাম আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান `মারকাজুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া। যেমনটি ভেবেছিলাম, ঠিক সেভাবেই ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলাম। কিন্তু পাঁচ-ছয় বছর ধরে যে সন্দেহ আর সংশয় অন্তরে দানা বাঁধছিল, তা কেন যেন এ বছরই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগল। আর অবশেষে ব্যাপারটি যখন অন্তরে স্থির হলো, সকল তথ্য-উপাত্ত আমার সন্দেহকে সত্যি বলে প্রমাণ করল, তখন আর অপেক্ষা করা মুনাসিব মনে করলাম না। এ দেশে থেকে আকাবিরদের বিরাগভাজন হয়ে আমার সদ্যপ্রতিষ্ঠিত মারকাজ ও চলমান পদ্ধতি যে আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না, সে ব্যাপারে যেদিন ইসতিখারা করে মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, সেদিনই মারকাজের সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দিলাম। ছাত্রদের নিসাবের সবক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, বাকি প্রবন্ধ তৈরির কাজ দ্রুত সম্পন্ন করিয়ে বছর শেষ হওয়ার মাসখানেক আগেই সবাইকে চলে যেতে বললাম। অঝোরে কান্না করতে করতে নিজের হাতে গড়া স্বপ্নের মারকাজ ভেঙে দিলাম। মারকাজের প্রতিটি জিনিস নিজ হাতে অনেক যত্নে সাজিয়েছিলাম; তাই ভাঙার সময় যখনই কোনো কিতাব বা জিনিস উঠিয়েছে, কান্নায় ভেঙে পড়েছি। রক্তক্ষরণ অনেক বেশিই হচ্ছিল, কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না। প্রস্তাব ছিল অনৈতিকতার সাথে আপোষ করে চলার। অথচ তারা ভালো করেই জানে যে, অনৈতিকতার সাথে না পূর্বে কখনো আপোষ করেছি, আর না ভবিষ্যতে করার ইচ্ছে আছে। উম্মাহর বিপরীতে জীবনে কখনো ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিইনি, তাই পরের বছর বিভিন্ন দিক থেকে অনেক সুবিধা পাওয়ার আশ্বাস থাকলেও সবকিছু অগ্রাহ্য করে আপন লক্ষ্যে অবিচল থাকার চেষ্টা করেছি এবং আল-হামদুলিল্লাহ তাঁর অপার দয়ায় অবশেষে সফলও হতে পেরেছি।

কওমি অঙ্গনে দীর্ঘ ষোলো বছর পড়াশোনা আর পাঁচ বছর পড়ানোর মধ্যে দিয়ে জীবন কেটেছে। এই পৌনে দুই যুগে অনেক কিছু পেয়েছি, আবার অনেক কিছু হারিয়েছি। বস্তুত এ শিক্ষা ও শিক্ষকতার জীবনে যতটুকু প্রত্যাশা ছিল, তার সিকিভাগও পূরণ হয়নি। আর আমার ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণে এর মূল ও প্রধান কারণ ছিল, মাদরাসাগুলোতে আখলাক ও নীতি-নৈতিকতার চরম অভাব; যেটা ছিল আমাদের পূর্বসূরিদের প্রধান ও প্রথম লক্ষ্য। পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতায় ক্ষুদ্র পরিসর, সীমাবদ্ধ চিন্তা ও ব্যাকডেটেড প্ল্যান-পরিকল্পনায় আমরা যে বিশ্বের সেরা জাতি হিসেবে পরিগনিত হব, এতে আমার বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই। জাতি হিসেবে (ব্যক্তি হিসেবে নয়) চিন্তা-চেতনায় আমাদের চেয়ে উগান্ডার মতো জাতিও অনেক এগিয়ে আছে। হলফ করে বললেও ইনশাআল্লাহ হানিস (কসম ভঙ্গকারী) হব না যে, কাসিমি কানুনে আজ কাসিমি চিন্তার ছিঁটেফোঁটাও পাওয়া যায় না। কোথাও কালেভদ্রে পাওয়া গেলে সেটা একেবারেই ব্যতিক্রম। আমাদের অঙ্গনের এমন অনেক চাপা সত্য জানা আছে, যা প্রকাশ করলে প্রজ্জ্বলিত আগুনে কেবল ঘি-ই ঢালা হবে, কাজের কাজ তেমন কিছু হবে না; তাই যেমনটি আমার নীতি, অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে আমি আগ্রহী হতে ইচ্ছুক নই। উম্মাহর এই দুঃসময়ে অবশ্যই আমি চিন্তিত, ব্যথিত ও মর্মাহত। দেড় হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনায় আমার বেশ ভালো করেই ধারণা ছিল যে, এমনটি ঘটবে; তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, উম্মাহর এ থেকে উত্তরণের স্বাভাবিক পথ নজরে পড়ছে না। অবশ্য আমি আশাবাদী যে, শীঘ্রই হয়তো উম্মাহর জন্য উত্তম ও কল্যাণকর কোনো পথ খুলে যাবে।

কওমি অঙ্গনের এ বিপর্যয় অননুমেয় ছিল না। যারা ইতিহাস পড়েন, যারা বাস্তবতা বোঝেন, সর্বোপরি যারা বিশুদ্ধভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারেন, তাদের কাছে বেশ স্পষ্টই ছিল এ সময়ের চিত্র ও দৃশ্যপট। পার্থক্য হলো, এদের কেউ জাতিকে সতর্ক করেছেন, সেজন্যে গালি খেয়েছেন আর আল্লাহর জন্য সবকিছুর ওপর সবর করেছেন; বিপরীতে অন্যরা নীরব থেকেছেন, সযত্নে নিজেকে সকল সমালোচনা থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং মানুষের কাছে নিজেদের সম্মান ও মর্যাদার জায়গা ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। যাই হোক, সময় অনেক গড়িয়েছে, অনেক সত্য স্পষ্ট হয়েছে এবং হচ্ছে, মানুষের চিন্তা-চেতনায়ও আমূল পরিবর্তন এসেছে। অবশ্যই এটা এক আশাজাগানিয়া দিক, যা কিছু দায়ির কুরবানির ফসল বলা যায়। তবে এ তিক্ত সত্যও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভবিষ্যতের কাণ্ডারি তরুণ আলিমদের আমল-আখলাক ও আদবেরও ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। পড়া ও পড়ানোকালীন এ ব্যাপারটি বেশ কাছ থেকেই অবলোকনের সুযোগ হয়েছে। তাই এ বাস্তবতার সত্যতা নিয়ে অন্যদের মতামত শোনা বা জানার কিছু নেই। পাশাপাশি মতানৈক্য ও বিরোধিতার উসুল বা আদব সম্পর্কে এদের বেশিরভাগেরই ন্যূনতম ধারণাটুকুও নেই। অনেকে মতানৈক্যের ক্ষেত্রেও বিরোধিতার মতো কঠিন কঠিন শব্দ প্রয়োগ করে, প্রতিপক্ষকে অপমান-অপদস্ত করার চেষ্টা করে, আবার বিপরীতে কেউ কেউ বিরোধিতার জায়গায় মতানৈক্যের মতো আদবের সবক শেখায় এবং ঐক্যের গান গায়।

দীর্ঘ জীবনে অনেক কিছুরই দেখা হলো। দল-মত-আদর্শ নিয়ে নানাজনের নানা কথা শোনা হলো। এবার পালা নিজের সংশোধনের, এবার সময় নিজেকে নিয়ে ভাবার। দেশে অবস্থান করে প্রচলিত পদ্ধতিতে ইলমি খিদমত করা সম্ভবপর মনে না হওয়ায় করে চলে এসেছি ইলমের শহরখ্যাত কায়রোতে। আমি বলছি না যে, এটা সবার জন্যই অসম্ভব, বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার কারণে কথাটি শুধু আমার নিজের ক্ষেত্রেই বলছি। আমি যেভাবে ভেবেছি, যেভাবে চেয়েছি, আপোষহীন মনোভাব ঠিক রেখে তথাকথিত হজরতদের বিরাগভাজন হয়ে সেভাবে সব কাজ করা সত্যিই সম্ভব ছিল না। প্রতিবন্ধকতা ছিল আমাদেরই আকাবির নামের কিছু আসাগিরের কূটচাল। এদের অন্তর অনেক বেশিই নোংরা। আল্লাহ তাদের হিদায়াত দিন, নয়তো ধ্বংস করুন। তবে স্বপ্নকে গলা টিপে মেরে ফেলিনি। সযত্নে এখনো তাকে লালন করি বুকের গহীনে। সময় হলে হয়তো স্বপ্নগুলো আবারও পাখা মেলবে এবং ভাবনাগুলো একদিন সব বাস্তবতায় রূপ নেবে। সে সাধ ও স্পৃহা অন্তরে নিয়েই চলে এসেছি হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান `জামিয়া আজহার`-এ। এখানে এসে দেখা পেয়েছি নতুন এক জগতের। ইলমি কানুনের অজানা সব শাখা-প্রশাখায় উড়ে বেড়ানোর এ জান্নাতি স্বাদ দেশে বসে থেকে কখনো পাওয়া সম্ভব ছিল না। এখন শাইখদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ইলম অন্বেষণ, বাসায় এসে নিবিড় অধ্যায়ন ও অবসর সময়ে লেখালেখিই আমার নিত্যসঙ্গী।

ফিতানের একটি বই নিয়ে কাজ করছি, আর নিজের জীবনকে বর্তমান বাস্তবতার সাথে মেলানোর চেষ্টা করছি। যত এগুচ্ছি, ততই অবাক হচ্ছি চলমান বাস্তবতার সাথে হাদিসের মিল দেখে। কখনো এটা মনে হয়, আবার কখনো সেটা মনে হয়। কখনো মনে চায়, একেবারে নীরব হয়ে যাই, অধ্যায়ন, ইবাদাহ আর ইসলাহ নিয়েই পড়ে থাকি। আবার কখনো হৃদয়টা হাহাকার করে ওঠে। উম্মাহর করুণ দশা দেখে চিন্তা লাগে, হায়! যদি মাঝ সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া এ জাতির জন্য নৌকার হালটা ধরতে পারতাম! কিন্তু কী করব, নিজেই তো ভালো করে জানি না, নৌকার হাল কীভাবে ধরতে হয়! জানি না, কীভাবে এমন গুরুদায়িত্ব নিয়ে নরম-কোমল বিছানায় ঘুমানো যায়! তবে যখন দেখি, কিছু মানুষ হাল ধরতে পারার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দুনিয়ার সামান্য লোভে পড়ে পুরো জাতির সাথে গাদ্দারি করে, তখন নিজে অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ হওয়ার পরও মনে চায়, ডুবার আশঙ্কা থাকলে থাকুক, তবুও সান্ত্বনার জন্য হলেও এগিয়ে আসি। মরলে কমপক্ষে এতটুকু সান্ত্বনা থাকবে যে, গাদ্দারদের সাথে নয়, অযোগ্য হলেও কিছু মুখলিস বান্দাদের সাথেই ঘটেছে সলিলসমাধি। এভাবে চিন্তাগুলো বারবার বিক্ষিপ্ত হয়ে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকে, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। জানি না, সামনে কী হতে যাচ্ছে। আল্লাহ এ এতিম উম্মাহর জন্য যোগ্য, মুখলিস ও অভিজ্ঞ কোনো রাহবার দান করুন।

সর্বশেষ হঠাৎ একটি হাদিসের কথা মনে পড়ছে। সবার উপকারের কথা চিন্তা করে হাদিসটি উল্লেখ করছি। আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, শীঘ্রই ফিতনারাশি আসতে থাকবে। ওই সময় উপবিষ্ট ব্যক্তি দণ্ডায়মান ব্যক্তির চেয়ে উত্তম (নিরাপদ), দণ্ডায়মান ব্যক্তি ভ্রাম্যমান ব্যক্তির চেয়ে উত্তম, আর ভ্রাম্যমান ব্যক্তি ধাবমান ব্যক্তির চেয়ে উত্তম হবে। যে ফিতনার দিকে চোখ তুলে তাকাবে, ফিতনা তাকে গ্রাস করে নেবে। তখন যদি কোনো ব্যক্তি তার দ্বীন রক্ষার জন্য কোনো ঠিকানা বা নিরাপদ আশ্রয় পায়, তবে সে যেন সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করে। (সহিহুল বুখারি: ৩৬০১; সহিহু মুসলিম : ২৮৮৬)

নানা দিক চিন্তা-ভাবনা করে আপাতত আমার নিজের জন্য নির্জনতাই বেছে নিয়েছি। পার্থিব নানা ঝামেলা ও দায়-দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছি। ইলম অন্বেষণ, ব্যাপক অধ্যায়ন ও ইবাদাহ-ইসলাহের মধ্যেই এখন নিজেকে নিরাপদ দেখছি। এভাবে চলতে থাকব, যতদিন না কোনো কাজের উত্তম ও সঠিক পথ বের হবে কিংবা উনার আগমন ঘটবে। নির্জনতাই এখন আমার সঙ্গী, নীরবতাই এখন আমার প্রিয়। সব বিষয়ে মতামত পেশ করা বা নিজেকে সবজান্তা মনে করা ঠিক নয়। এখন সকল কিছুর জন্য নিয়তকে পুনরায় যাচাই করছি, বিশুদ্ধতার ফিল্টারে সব ভালোভাবে চেক করে দেখছি, অজানা সব বিষয় অধ্যায়ন করছি, আর নিয়মিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি। জানি না, ভবিষ্যতে আমার কী হবে, আর উম্মাহর ভাগ্যই বা কোনদিকে যাবে। পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে যে, কিছুই ভালো করে বলতে পারছি না। হয়তোবা সুবহে কাজিবের সময় চলছে এখন। হতে পারে কিছুক্ষণ পরেই পুবাকাশে সুবহে সাদিকের প্রসারিত রেখা ভেসে ওঠবে। আলোকিত সে মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়...।

হে আল্লাহ, আপনি আমাদের সরল-সঠিক পথ প্রদর্শন করুন, সর্বদা সত্য ও হকের পথে অবিচল রাখুন, আপনার দ্বীন জিন্দা করার মিছিলে আমাদের শামিল হওয়ার তাওফিক দান করুন এবং সবিশেষ আমাদের সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠ মৃত্যু দান করুন।