কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর আজ জন্মদিন

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৪, ২০২০

কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর আজ জন্মদিন। ব্রিটিশ-শাসিত অবিভক্ত ভারতের ঢাকায় ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের বঞ্চনা ও শোষণের বাস্তব চিত্র তিনি তুলে ধরেন তার লেখায়।

সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় হয়ে ওঠার সূত্রেই তার লেখালেখির জগতে আসা। বাবা কল্লোল যুগের কবি ও সাহিত্যিক মণীশ ঘটক। মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন লেখক ও সমাজসেবী। মহাশ্বেতা দেবীর ছোট কাকা প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক।

একটা সময় মহাশ্বেতা ঢাকার ইডেন স্কুলের মন্টেসরিতে পড়াশোনা শুরু করেন। পরে চলে যান পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে মেদিনীপুরে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে তিনি পড়াশোনা করতে শান্তিনিকেতন যান। এ সময় মাত্র দুবছর শান্তিনিকেতনে কাটালেও তা ছিল তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়। তখনই তাঁর লেখালেখির শুরু। ১৯৩৯ সালে তিনি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন, তখন খগেন্দ্রনাথ সেন সম্পাদিত ‘রংমশাল’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর রবীন্দ্রনাথ-সম্পর্কিত রচনা ‘ছেলেবেলা’।

১৯৩৯ সালে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ১৯৪২ সালে আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৩-এ পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় মহাশ্বেতা দেবী প্রথম বর্ষে পড়েন এবং কম্যুনিস্ট পার্টির ছাত্রী সংগঠন এবং দুর্ভিক্ষ ত্রাণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির মিটিংয়ে যোগ দিতেন। পার্টির মুখপত্র , ‘জনযুদ্ধ’ বিক্রি করতেন। তবে পার্টির মেম্বার না হয়ে এভাবেই কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মূলত তখন থেকেই তাঁর কর্মীসত্তার বিকাশ, যা পরবর্তীকালে তাঁর জীবনে আরো প্রকট হয়ে ওঠে।

১৯৪৪ সালে বিএ পড়তে মহাশ্বেতা ফিরে যান শান্তিনিকেতনে। ১৯৪৬ সালে আবার কলকাতায় ফিরে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমএ ভর্তি হন। কিন্তু তখন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পড়াশোনা ব্যাহত হয়। ১৯৪৭ সালে তিনি গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য বিজয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৪৮ সালে তাঁর একমাত্র পুত্র নবারুণের জন্ম হয়।

মহাশ্বেতা দেবীর সংসার জীবন মাত্র ১৫ বছরের। একসময় তিনি সুমিত্রা দেবী ছদ্মনামে ‘সচিত্র ভারত’ পত্রিকায় ফিচার এবং গল্প লেখা শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি প্রাইভেটে ইংরেজিতে এমএ পাস করেন এবং ১৯৬৪ সালে বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে ইংরেজি অধ্যাপনায় প্রবেশ করেন। এরই মধ্যে তাঁর প্রথম বই ঝাঁসীর রানী (১৯৫৬) প্রকাশ পায়। পরবর্তীকালে তিনি লেখাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ইতিহাস তাঁর সাহিত্যজীবনে সবসময়ই গুরুত্ব পেয়ে এসেছে।

‘আমি চিরকালই প্রতিবাদী লেখক। লেখা ও কাজের মাধ্যমেই প্রতিবাদ করে এসেছি আমি।... জনমানুষের সাথে কাজ করেছি।’ নিজের সম্পর্কে মহাশ্বেতা দেবী বরাবরই এভাবে কথা বলেন। ‘হাজার চুরাশির মা’ হল র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী রচিত একটি বাংলা উপন্যাস। এই উপন্যাসটি ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৭০-এর দশকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই উপন্যাসটি রচিত হয়।

বাংলা সাহিত্যে বিষয়ের বহুমাত্রিকতা ও দেশজ আখ্যানের অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মহাশ্বেতা দেবীর। তিনি ইতিহাস, রাজনীতি থেকে যে সাহিত্য রচনা শুরু করেন, তা হয়ে ওঠে বিপ্লবের তেজদীপ্ত অস্ত্র।

সেখানে লোধা ও শবর উপজাতি, নারী ও দলিতদের লড়াই এবং অসহায়তার কথাই তার লেখায় উঠে এসেছে। বহুবার ভারতের উপজাতি মানুষদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন ভারতীয় এই কথাসাহিত্যিক। তাঁদের অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছেন তিনি। তাঁর লেখা আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক অনেক উপন্যাস ও গল্প রচনা করেছেন।

সব মিলিয়ে মহাশ্বেতা দেবী ১০০টিরও বেশি উপন্যাস এবং ২০টি অধিক ছোটগল্প সংকলন রচনা করেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘হাজার চুরাশির মা’, ‘অগ্নিগর্ভ’ প্রভৃতি। ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৯-এ সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান মহাশ্বেতা দেবী। পরে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারসহ একাধিক সাহিত্য পুরস্কার এবং ভারতের চতুর্থ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান যথাক্রমে পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ পেয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করেছিল।

ফুসফুসের সংক্রমণে দীর্ঘ দিন অসুস্থতার পর ভারতের প্রধানতম এই কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী নব্বই বছর বয়সে ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।