করোনা-পরবর্তী দুনিয়া কেমন হবে

অনুবাদ: তুহিন খান

প্রকাশিত : মার্চ ২২, ২০২০

পোস্ট-করোনা দুনিয়া কেমন হবে? সব কি আগের মতোই থাকবে? রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্র, সরকার— এসব কি আগের নিয়মেই চলতে থাকবে? করোনা কবে থামবে, এ ব্যাপারে কোনও গ্যারান্টি না থাকলেও, দুনিয়ার প্রায় সব চিন্তাবিদই এ ব্যাপারে একমত হওয়া শুরু করছেন যে, পোস্ট করোনা দুনিয়ার রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক হিশাব নিকাশ, বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা একই রকম থাকবে না। বার্লিন দেয়ালের পতনের আগের আর পরের দুনিয়া যেমন এক নয়, করোনা ভাইরাসের আগের আর পরের দুনিয়াও এক হবে না।

তাইলে কেমন হইতে পারে পোস্ট করোনা সময়ের দুনিয়া? এই নিয়া ১২ জন বিখ্যাত চিন্তাবিদের প্রেডিকশন ছাপাইছে ফরেন পলিসি। যদিও তাদের প্রেডিকশনে নিওলিবারাল দীর্ঘশ্বাসের ছাপ পষ্ট, তবু প্রেডিকশনগুলা গুরুতর। ফরেন পলিসির আর্টিকেলটার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ এইখানে দেয়া হইল।

১. স্টিফেন ওয়াল্টের (হার্ভার্ডের আইআরের প্রফেসর) প্রেডিকশন হইল: পোস্ট-করোনা দুনিয়ায় `গ্লোবালাইজেশন` বিপদের মুখে পড়বে। এই দুনিয়া হবে তুলনামূলক কম উন্মুক্ত, স্বল্প উন্নত এবং অল্প স্বাধীন দুনিয়া। মহামারির কারণে `রাষ্ট্র` আরো শক্তিশালী হবে, জাতিবাদ নয়া মাত্রা পাবে। সরকারগুলা এই ভাইরাস মোকাবেলার জন্য নানারকম কাজ করতে বাধ্য হবে, এবং এসব কাজের ভিতর দিয়া তারা আরো শক্তিশালী হবে। এবং করোনা-পরবর্তী দুনিয়ায় এই নতুন পাওয়ার তারা ছাড়তে চাইবে না।

পশ্চিমের থিকা পুব বেশি শক্তিশালী আর গুরুতর হইয়া উঠবে। করোনা মোকাবেলায় দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর আর চায়নার সাফল্য এবং ইউরোপ-আমেরিকার ব্যর্থতার কারণেই এইটা হবে। তবে বিশ্ব পরাশক্তিগুলার মধ্যে মারামারি থামবে না। অতীতেও থামে নাই, এবারও থামবে না। একটা `হাইপারগ্লোবাল` পরিস্থিতি তৈয়ার হবে, যা আসলে নতুন এবং দুশ্চিন্তাজনক।

২. রবিন নিবলেটের (চাথাম হাউজের ডিরেক্টর ও চিফ এক্সিকিউটিভ) প্রেডিকশন এমন: গ্লোবালাইজেশনের দিন শেষ হবে এই মহামারির পরে। আমরা সবাই জানি এইটা। উটের কুঁজের মতো উঁচা অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ভিত ভাইঙা পড়বে। চায়নার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বাড়বে। অলরেডি তারা নিজেদের আলাদা শক্তি হিশাবে তৈয়ার ও উপস্থাপন করার পথে অনেক দূর আগায়ে গেছে। করোনা-পরবর্তী দুনিয়ায় অর্থনীতি হবে `কোয়ারেন্টাইন্ড` অর্থনীতি। নিজেদের আলাদা রাখার অর্থনীতি। যার মাঠ তৈরি হইতেছে গত এক দশক যাবত।

অর্থনীতির গ্লোবাল সিস্টেমে ধস নামার কারণে, অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা আরো বাড়বে। যেসব সরকার সফলভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবে, তাদের রাজনৈতিক শক্তি আরো বাড়বে। কিন্তু যারা ফেল করবে, তাদের জন্য দুর্দিন অপেক্ষা করতেছে।

৩. কিশোর মাহবুবানির (এনইউএস-র ফেলো, `হ্যাজ চায়না ওন` বইয়ের লেখক) প্রেডিকশন এমন: নয়া বিশ্বায়ন হবে চায়না-কেন্দ্রিক বিশ্বায়ন। ইকোনমিক গ্লোবালাইজেশনে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না। যেটা হবে, গ্লোবালাইজেশন আমেরিকা থেকে সইরা চায়নামুখী হবে। এর কারণ, আমেরিকার লোকেরা যখন গ্লোবালাইজেশনে বিশ্বাস হারাইতেছে, চায়না তখন গ্লোবালাইজেশনরে নতুন নতুন দিশা দিতেছে। এই শিক্ষা তারা তাদের নিজেদের ইতিহাস থিকাই নিছে। ১৮৪২-১৯৪৯ পর্যন্ত চায়নার যিল্লতি ছিল দুনিয়া থেকে আলাদা থাকতে চাওয়ার ফল। এইটা এখন তারা বোঝে।

আমেরিকার সামনে দুইটা রাস্তা খোলা, যদি তারা দুনিয়ার মাতব্বরি ধইরা রাখতে চায়, তাইলে চায়নার সাথে লাভ-লস-হীন একটা কনটেস্ট তাদের চালাইয়া যাইতে হবে। আর যদি তারা আমেরিকার মানুষের ভালো চায়, তাইলে চায়নার সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাড়াইতে হবে।

৪. জি জন ইকেনবেরির (প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির পলিটিক্স ও আইআরের প্রফেসর) প্রেডিকশন হইল: গণতান্ত্রিক দেশগুলা তাদের খোলস খুইলা বাইরে আসবে। এর মানে কী? এই ক্রাইসিসের ফলে পশ্চিমা ওয়ার্ল্ড স্ট্রাটেজির বিরোধী শিবিরগুলা খুব শক্তিশালী হবে। জাতিবাদী, বিশ্বায়ন-বিরোধী, চাইনিজ শিবির, এমনকি আন্তর্জাতিকতাবাদী লিবারেলরাও যার যার মতাদর্শের নতুন নতুন জরুরত আছে বইলা ভাবতে থাকবে। জাতিবাদ, বড় বড় দেশগুলার মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশল হিশাবে বিচ্ছিন্নতারে গ্রহণ কইরা নেয়া— এইসব হবে।

তবে ১৯৩০-৪০ সালে যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধ চলাকালে, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং ইওরোপের অন্যান্য নেতারা যে এক ধরনের শক্ত আন্তর্জাতিকতাবাদের জন্ম দিছিলেন, বিপরীত দিকে সেরকম কিছুও মাথাচাড়া দিয়া উঠতে পারে। ১৯৩০ সালে বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পতনে এইটা পষ্ট হইছিল যে, আধুনিক দুনিয়া আসলে পরস্পরের উপরে নির্ভরশীল, এবং যেকোনো টাইপের ছোঁয়াচের সামনে সব দেশের মানুষই অসহায়। ফলে রুজভেল্ট আর অন্যান্যরা একটা ওপেন সিস্টেম খাঁড়া করতে চাইছিলেন, যার ফলে পারস্পরিক নির্ভরশীলতাও নিশ্চিত হবে, আবার প্রতিরক্ষার নয়া মডেলও দাঁড়াবে।

তো আমেরিকা এবং পশ্চিমা গণতন্ত্র নানারকম চাপের মুখে পইড়া আবারও সেই একইরকম কিছু একটা করতে পারে। শুরুতে ব্যাপারটা একটু বেশিই জাতিবাদী টাইপের হবে, কিন্তু শেষমেশ গণতান্ত্রিক দেশগুলা তাদের খোলস খুইলা বাইরে আসবে এবং নতুন এক ধরনের বাস্তববাদী ও প্রতিরক্ষামূলক আন্তর্জাতিকতাবাদের জন্ম দেবে।

৫. শ্যানন কে ও`নেইলের (কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের লাতিন আমেরিকা বিষয়ক সিনিয়র ফেলো) প্রেডিকশন এমন: করোনার কারণে নয়া দুনিয়ার অর্থনীতিটা হবে এমন: কম মুনাফা, কিন্তু বেশি টেকসই। করোনার কারণে বিশ্বের উৎপাদন ব্যবস্থার অনেক মৌলিক নীতিতে চেঞ্জ আসবে। কোম্পানিগুলা এখন আন্তঃদেশীয় সাপ্লাই চেইন নিয়া ভাববে, এইটারে কমায়ে আনবে। মোটকথা বর্তমানের প্রতাপশালী যে `ইকোনমিক গ্লোবালাইজেশন`, তাতে চেঞ্জ আসবে। অর্থনৈতিক (চায়নায় লেবার কস্ট বাড়া, ট্রাম্পের `ট্রেড ওয়র`, রোবোটিক্স, অটোমেশন ইত্যাদি) ও রাজনৈতিক (বেকার বৃদ্ধি) নানা কারণে, এই গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন করোনার আগেই ঝুঁকির মুখে ছিল।

করোনা আসার পরে যেটা হইছে, এইসব জিনিশের সংযোগ ভাইঙা পড়ছে। যেমন: আক্রান্ত এলাকায় যেসব কোম্পানিগুলা বন্ধ হইতেছে, ব্যাংক, ফার্মেসি ইত্যাদি বন্ধ হইতেছে, এদের জন্য অন্য ম্যানুফ্যাকচারারদেরও নতুন প্রোডাকশন কইমা আসতেছে। অন্যদিকে, করোনার পরে কোম্পানিগুলা তাদের সাপ্লাইয়ের উৎস নিয়া আরো ভাববে, কাঁচামালের ব্যাপারে আরো চৌকান্না হবে। সরকারি হস্তক্ষেপও বাড়বে। ফলে মুনাফা কমবে, কিন্তু একটা টেকসই সাপ্লাই চেইন তৈয়ার হবে।

৬. শিবশঙ্কর মেননের (ব্রুকিংস ইন্ডিয়ার ফেলো এবং মনমোহন সিংয়ের ন্যাশনাল সিক্যুরিটি অ্যাডভাইজার) প্রেডিকশন হইল, এই মহামারি অনেক ফলদায়কও হইতে পারে। মহামারি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, তবে তিনটা ঘটনা ঘটবে, এইটা মোটামুটি নিশ্চিত। এক. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চেঞ্জ আসবে। সরকারের কর্মকাণ্ড সোসাইটিতে নানান চেঞ্জ আনছে অলরেডি। তো, এই মহামারি প্রতিরোধে সরকারের নানা পদক্ষেপ এবং সেসবের অর্থনৈতিক প্রভাবে সিক্যুরিটি ইস্যু এবং সমাজে বর্তমানে যে মেরুকরণ, এইটা ঝুঁকিতে পড়বে অথবা শেষ হয়ে যাবে। যেকোনো অবস্থায়ই, সরকারের পিঠটান দিতে হবে। অভিজ্ঞতায় দেখা যাইতেছে যে, অথরিটারিয়ান বা পপুলিস্ট সরকারগুলা এই মহামারি প্রতিরোধে তেমন কিছু করতে পারতেছে না। কোরিয়া ও তাইওয়ানের মতো যেসব দেশ সাফল্য পাইছে, সেগুলা গণতান্ত্রিক।

দুই. পারস্পরিক সম্পর্কের যে বর্তমান দুনিয়া, এখনই তার শেষ, এইটা মনে হয় না। তবে সব দেশেই অলরেডি, নিজেদের দিকে ফেরার, স্বশাসন ও নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার একটা মনোভাব তৈয়ার হইছে। ফলে বলা যায়, আমরা একটা ছোট ও সংকীর্ণ দুনিয়ায় ঢুইকা পড়তেছি। তিন. আশা জাগানোর মতো কিছু ভালো ঘটনাও আছে। করোনা মোকাবেলায় একটা আঞ্চলিক ঐক্য তৈয়ারের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সব নেতাদের সাথে নিয়া একটা ভিডিও কনফারেন্সের উদ্যোগ নিছে ইন্ডিয়া। করোনার ঠেলায় পইড়া আমরা যদি বুঝতে পারি যে, বড় বড় গ্লোবাল ইস্যুতে একসাথে কাজ করলেই আমাদের সত্যিকারের লাভ, তাইলে এই বুঝটা পরে অনেক কাজে দেবে।

৭. জোসেফ এস নাই জুনিয়র (হার্ভার্ডের ডিস্টিংগুইশ সার্ভিস প্রফেসর এবং Do Moral Matters? Presidents And foreign policy from FDR To Trump-বইয়ের লেখক)-র প্রেডিকশন হইল, আমেরিকার নতুন স্ট্রাটেজি বানাইতে হবে। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটা নতুন ন্যাশনাল সিক্যুরিটি স্ট্রাটেজি ঘোষণা করছিলেন যার মূল ফোকাস ছিল বড় পরাশক্তিগুলার ভিতরে প্রতিযোগিতা। করোনা প্রমাণ করছে, এই কৌশল যথেষ্ট না। পরাশক্তি হইলেও, আমেরিকা একা নিজের সিক্যুরিটি নিশ্চিত করতে পারবে না। রিচার্ড ড্যানজিগ ২০১৮ সালে এই সমস্যাটারে ব্যাখ্যা করছিলেন এইভাবে: `একুশ শতকের টেকনোলজি শুধু সাপ্লাই আর ডিস্ট্রিবিউশনের দিক দিয়াই বৈশ্বিক না, এর ফলাফলও বৈশ্বিক। প্যাথোজেন, এআই সিস্টেম, কম্পিউটার ভাইরাস বা রেডিয়েশনের কারণে কোন দেশ আক্রান্ত হইলে এইটা কেবল তাদের সমস্যা না, এইটা আমাদেরও সমস্যা, সমানভাবে।`

করোনা বা ক্লাইমেট চেঞ্জের মত এই আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলা অন্যান্য দেশের উপর আমেরিকার পাওয়ার বোঝার জন্য যথেষ্ট না। অন্যান্য দেশের সাথে পাওয়ার শেয়ারের ব্যাপারটাও শেখা লাগবে, এইটাই কি টু সাক্সেস। সব দেশই নিজেদের জাতীয় স্বার্থটা আগে দেখবে, গুরুতর ব্যাপার হইল: তারা কতটা ব্যাপক বা সংকীর্ণ অর্থে নিজেদের জাতীয় স্বার্থরে ব্যাখ্যা করে। করোনা আইসা বুঝায়ে দিল যে, নয়া দুনিয়ার সাথে আমাদের কৌশলগুলারে খাপ খাওয়াইতে আপাতত ব্যর্থ আমরা।

৮. জন অ্যালেনের (ন্যাটোর সিক্যুরিটি এসিস্টেন্স ফোর্সের সাবেক কমান্ডার, আফগানিস্তানে ইউএস ফোর্সের সাবেক কমান্ডার, ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের প্রেসিডেন্ট) প্রেডিকশন, পোস্ট করোনার ইতিহাস লেখবে বিজয়ীরাই। বরাবরের মতোই, করোনায় বিজয়ীরাই এর ইতিহাসটা লেখবে। প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেকটা মানুষ এই ভাইরাসের সামাজিক ধকল পোহাইতেছে। যেসব দেশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পাবলিক হেলথের জায়গাগুলাতে অটল থাকতে পারবে, তারাই বিজয়ী হবে। কারো মতে এই পরিস্থিতি গণতন্ত্র, বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থা ও গ্লোবাল হেলথ কেয়ারের চূড়ান্ত বিজয়, কারো কারো মতে এইটা অথরিটারিয়ানদের জন্য সর্বোচ্চ `সুযোগ`।

যেটাই হোক, এই করোনা দুনিয়ার রাজনৈতিক হিশাব নিকাশ পাল্টায়ে দেবে, যেটা আমরা কেবল ভাবা শুরু করছি। অর্থনীতিতে টেনশন বাড়বে, টেনশন বাড়বে বিভিন্ন দেশের মধ্যে। লং টার্মে এইটা বিশ্বের অর্থনৈতিক উৎপাদনে ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করবে, স্পেশালি যদি ব্যবসাপাতি বন্ধ হইয়া যায় এবং মানুষ কাজ করা বন্ধ কইরা দেয়। উন্নয়নশীল দেশ এবং যেসব দেশে অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিতে এমন বিশাল সংখ্যক শ্রমশক্তি আছে, তাদের জন্য রিস্ক সবচাইতে বেশি। এর ফলে আন্তর্জাতিক সিস্টেমও বিরাট চাপে পড়বে, যার ফলে অস্থিরতা এবং দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে এবং অনেক দেশের ভিতরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হবে।

৯. লরাঁ গ্যারেটের (কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের গ্লোবাল হেলথ বিষয়ক ফেলো এবং পুলিৎজার জয়ী বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক) প্রেডিকশন হইল, বৈশ্বিক পুঁজিবাদ একটা নতুন নাটকীয় যুগের মুখোমুখি হবে। বৈশ্বিক বানিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য পয়লা বেদনাদায়ক সত্য হইল, এইটা মানা লাগবে যে, গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন এবং ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক ভাইঙা পড়ার ঝুঁকিতে আছে। ফলে, করোনা ভাইরাস যে শুধু একটা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক ক্ষতি করবে তা না, এই ভাইরাস কিছু মৌলিক চেঞ্জ নিয়া আসবে। গ্লোবালাইজেশনের ফলে কোম্পানিগুলা সারাবিশ্বে অন্যের শ্রমে পণ্য উৎপাদন করতে পারছে এবং গুদামের খরচ ছাড়াই জাস্ট-ইন-টাইম সিস্টেমে সেগুলা বিলি বণ্টন করতে পারছে। নির্বিঘ্নে সুন্দরভাবে সাপ্লাই সিস্টেম চালাইতে পারছে। করোনা আইসা বুঝায়ে দিল যে, প্যাথোজেন খালি মানুশরেই আক্রান্ত করে না, সে পুরা জাস্ট-ইন-টাইম সিস্টেমটারেই শেষ কইরা ফেলে।

গত ফেব্রুয়ারি থিকাই গ্লোবাল মার্কেটগুলায় যে ধ্বস নামছে, তার মাত্রা হিশাবে নিলে, কোম্পানিগুলা এই মহামারির প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য অবশ্যই জাস্ট-ইন-টাইম সিস্টেম এবং দুনিয়াব্যাপী অবাধ উৎপাদনের ব্যাপারে মাথায় গুলি ধইরা চিন্তা-ভাবনা করতে বসবে। ফলে বৈশ্বিক পুঁজিবাদ একটা নতুন জামানায় ঢুইকা পড়বে, যেখানে সাপ্লাই চেইন নিজ দেশের আশেপাশেই থাকবে, এবং অনেক কিছু কমায়ে আনা হবে, যাতে ভবিষ্যতে এইরকম বিপদের মুখে না পড়া লাগে। তাতে কোম্পানিগুলার মুনাফা কমবে, কিন্তু স্থায়িত্ব বাড়বে।

১০. রিচার্ড এন হ্যাসের (কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের প্রেসিডেন্ট এবং World in Disarray বইয়ের লেখক) প্রেডিকশন হইল: ব্যর্থ রাষ্ট্র বাড়বে। `পার্মানেন্ট শব্দটা বলব না, কোনোকিছুই তো আসলে পার্মানেন্ট না। কিন্তু করোনার পরে অন্তত বড় একটা সময় বিভিন্ন দেশের সরকার অন্তর্মুখী হইতে থাকবে, বর্ডারের বাইরে নজর না দিয়া বর্ডারের ভিতরে নজর চোখা করা লাগবে। আমার মনে হয়, একটা বড়সড় সিলেক্টিভ আত্মনির্ভরতার এবং বিচ্ছিন্নতার জোয়ার শুরু হবে, ব্যাপকভাবে অভিবাসনের বিরুদ্ধে মতামত আরো বাড়বে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমস্যা একসাথে সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা বা কমিটমেন্ট কমবে। আমার ধারণা, বেশিরভাগ দেশ এই মহামারি মোকাবেলায় ব্যর্থ হবে এবং ব্যর্থ রাষ্ট্র নয়া দুনিয়ার একটা কমন ফিচার হবে। আমেরিকা-চীনের সম্পর্কের আরো অবনতি হবে, ইউরোপের ঐক্য দুর্বল হইতে থাকবে। বিপরীতে ভাল দিক বলতে, হয়ত অসাধারণ শক্তিশালী কিছু বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিষয়ক উদ্যোগ দেখা যাইতে পারে। তবে এই সমস্যার গোড়া গ্লোবালাইজেশন, ফলে এইটা দুনিয়ারে দুর্বলই করবে।

১১. কোরি শেকের (ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল, ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক স্টাডি) প্রেডিকশন হইল— আমেরিকা নেতৃত্বের পরীক্ষায় ফেইল করছে। নিজেদের অযোগ্যতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতার কারণেই, আমেরিকারে আর দুনিয়ার নেতা হিশাবে দেখা যাবে না। বৈশ্বিক সংস্থাগুলা যদি সময়মত ঠিকঠাক তথ্য দিতে পারত, তাইলে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রস্তুতি নেওয়ার আগাম সুযোগ পাইত। এই কাজটা আমেরিকা অর্গানাইজ করতে পারত, বুঝাইতে পারত যে, তারা খালি নিজেদের নিয়াই ভাবে না। ওয়াশিংটন নেতৃত্বের পরীক্ষায় ব্যর্থ।

১২. নিকোলাস বার্নসের (হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের প্রফেসর এবং আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের পলিটিকাল অ্যাফেয়ার্সের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি) প্রেডিকশন এমন: সব দেশেই, মানুষের প্রাণশক্তির নমুনা দেখব আমরা। করোনা এই শতকের সবচাইতে ভয়াবহ ঘটনা। দুনিয়ার ৭.৮ বিলিয়ন মানুষই ঝুঁকিতে আছে। এই ঘটনার অর্থনৈতিক প্রভাব ২০০৭-০৮ এর চাইতেও বেশি হইতে পারে। দুনিয়ার যাবতীয় সিস্টেম ও শক্তির ভারসাম্য পার্মানেন্টলি চেঞ্জ হইতে পারে। আন্তর্জাতিক ঐক্য এখনও শোচনীয় পর্যায়ে আছে। যদি আমেরিকা আর চায়না তাদের মারামারি এক সাইডে রাইখা একসাথে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় পথ দেখাইতে না পারে, তাইলে এই দুই দেশের গ্রহণযোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ইউরোপিয় ইউনিয়ন যদি ঠিকঠাক সাহায্য করতে না পারে, তাইলে ওইসব দেশের সরকার ভবিষ্যতে ব্রাসেলসের চাইতে বেশি পাওয়ারফুল হবে। যদিও দেশে দেশে আমরা মানুশের বিপুল প্রাণশক্তি দেখতেছি: ডাক্তার, নার্স, রাজনৈতিক নেতা আর সাধারণ মানুষ— সবাই একসাথে কাজ করতেছে, নেতৃত্ব দিতেছে। ফলে আশা জাগে যে, দুনিয়ার সব মানুষ মিলা এই দুর্যোগের মোকাবেলায় আরো শক্ত হবে।