করোনাকালে প্রবাসীদের নীরব কান্না
মো. ইয়াছিন চৌধুরীপ্রকাশিত : জুন ২৬, ২০২০
করোনা ভাইরাস পাল্টে দিয়েছে প্রবাস জীবনের বাস্তবতা। গাড়িটি রাস্তার পাশে পার্কিং করেছি ফার্মেসি থেকে কিছু ওষুধ নেয়ার জন্য। গাড়ি থেকে নামার আগে দেখি, এক ভদ্রলোক পাশে দাঁড়িয়ে আছে কথা বলার জন্য। দেখে বুঝতে পেরেছি, বাংলাদেশি। খুব অসুস্থ মনে হলো। গাড়ির কাচ নামিয়ে মাথা কিঞ্চিৎ বের করে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই, কি হয়েছে?
দু`চোখ পানিতে টলমল। ঘড়িতে ঠিক বিকেল ৫:৩০ মিনিট। করোনায় সব লকডাউন। নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও ফার্মেসি ছাড়া তেমন কিছু খোলা নেই। এই সময়টায় মানুষের যাতায়াত খুবই কম। কোনো উত্তর না দিয়ে লোকটি অঝর ধারায় চোখের পানি ফেলতে শুরু করল এবং একটা হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। অপর হাতে দেখলাম একটি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন। তখন বুঝে গেলাম, এটি সাহায্যের হাত।
বললাম, ভাই কি হয়েছে?
কান্নায় ভেঙে পড়লো লোকটি। বলল, স্যার, আমি আপনাকে চিনি, আমার নাম বখতিয়ার, বাড়ি চট্টগ্রামে। আপনি আমাকে চিনার কথা না। আমি আল-খোয়াইর রাওয়াসকোর সামনে থাকি। একটি কোম্পানিতে চাকরি করতাম, ভালোই চলছিল। আজ তিন মাস হয়ে গেছে কোম্পানি বন্ধ। আমার কোনো চাকরি নেই। অনেক কষ্টে আছি। তিন মাস আগে যা বেতন পেয়েছি দেশে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। দুই মাস আগে চট্টগ্রাম সমিতি ওমানের পক্ষ থেকে এক পরিচিত বন্ধুর মাধ্যমে এক মাসের ত্রাণসামগ্রী পাই। যা রমজানের শেষের দিকে শেষ হয়ে গিয়েছে। রুমের মধ্যে আটজন থাকি। সবার একই অবস্থা। কারো কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার কোনো উপায় নেই। অনেক কষ্টে বিস্কিট খেয়ে পানি খেয়ে মাঝেমধ্যে একবেলা খেয়ে কোন রকমে বেঁচে আছি।
লোকটি বলতেই লাগল, হঠাৎ গত সপ্তাহ ধরে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। অনেক কষ্ট করে গতকাল সন্ধ্যায় একজন ডাক্তারের কাছ থেকে বিনা ফি’তে একটি প্রেসক্রিপশন নিয়েছি, জ্বর মেপে দেখল ১০২ ডিগ্রি। আমাকে কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছে। আমার পকেটে এক টাকাও নাই ওষুধ কিনার জন্য। অনেক প্রবাসীর কাছে ধরণা দিয়েছি, কেউ একটা টাকাও দিতে পারে নাই। তাদের হাতেও কোনও টাকা নেই। এই এলাকায় আমার মতো অনেক মানুষ না খেয়ে অসুস্থ অবস্থায় রুমে পড়ে আছে। কেউ কাউকে সহযোগিতার কোনও উপায় নেই। তারমধ্যে অনেকেই করোনায় আক্রান্ত। গত সপ্তাহে ফ্রিতে করোনা টেস্ট করিয়েছিলাম। আল্লাহর রহমতে নেগেটিভ এসেছে। আমি জানি, এ দেশে ভিক্ষা করা অপরাধ। কিন্তু জীবন বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে কোনও উপায় না দেখে রাস্তায় আসলাম। জীবনে কোনোদিন ভাবিনি, এমন দিনও আসবে। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আট বছর ধরে ওমানে আছি। কিছু পড়াশোনাও করেছি। এমন একটি কঠিন সময় আমাদেরকে দেখার কেউ নেই।
লোকটি কথাগুলি বলতেছিল আর দুচোখ দিয়ে বইতে লাগল অজস্র কান্না। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। পাশের সিটে বসা ছিল আমার স্ত্রী। তার দিকে চেয়ে দেখলাম, মলিন চেহারা দুচোখে পানি আর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুনতে ছিল আমাদের কথাগুলো। গাড়ির পিছনের সিটে ছিল আমার নয় বছরের অবুঝ সন্তান। তাকিয়ে দেখলাম অবাক চোখে কি যেন বুঝার চেষ্টা করছে। যাক লোকটিকে সাধ্যমত সহযোগিতা করে ফার্মেসি থেকে ওষুধপত্র কিনে দিয়ে নিজের জন্য ওষুধ নিয়ে গাড়িতে বসে। লোকটিকে বিদায় দিয়ে, গাড়ি যখন চালু করে সামনের দিকে যাচ্ছিলাম, আবার হাত দেখালো, আবার চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, আপনার এই ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব না। জানি না জীবনে আর কখনো দেখা হবে কিনা।
আমি জানি, আপনারা প্রবাসীদের জন্য অনেক কাজ করেন, আমার মৃত্যু অতি সন্নিকটে দেশে আমার মা, স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে আমার একটি ছোট্ট সংসার। ওরাও এখন দেশে না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আমি বিদেশ থাকি বলে স্থানীয় মেম্বার চেয়ারম্যান কোন সাহায্য দেয় না, ওরা মনে করে আমি অনেক টাকা ওয়ালা। আমার মত অনেক প্রবাসী আছে যারা মৃত্যুর সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। আপনার কাছে হাতজোড় করে একটি অনুরোধ জানাচ্ছি, জীবনের শেষ ইচ্ছে, যদি পারেন দূতাবাস এবং সরকারকে বলে আমাদেরকে দেশে পাঠিয়ে দেন, আমি আমার মা, প্রিয়তমা স্ত্রী, সন্তানদের সামনে, প্রিয় মাতৃভূমিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে বললাম আপনার মোবাইল নাম্বার দিন, মোবাইল নম্বরটি সেইভ করে গাড়ি সামনের দিকে চলতে শুরু করলো লোকটি সেখানেই অশ্রু ভেজা চোখে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমার নয় বছর বয়সী ছেলের ততক্ষণে অনেক প্রশ্ন: আচ্ছা, উনার বাচ্চারা কোথায়? বাচ্চাদের মা কোথায়? উনি কি এখানে থাকেন? ওনার এত অসুখ কেন? উনার কাছে টাকা নেই কেন? উনি বাংলাদেশে যায় না কেন? আমার কাছে আর স্ত্রীর মুখে কোনো জবাব নেই। মনটা কেমন বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেছে। গাড়ির আয়নায় দেখি, এখনো লোকটি দাঁড়িয়ে আছেন। অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন আমাদের গাড়ির দিকে। স্ত্রী পাশের সিটে বসে টিসু দিয়ে বার বার চোখের পানি মুছতে ছিল।
বাসার সামনে গাড়ি পার্কিং করে বাসায় ঢুকলাম আমার ছেলে স্বাভাবিকত্ব একটু দুষ্ট প্রকৃতির অনেক দুষ্টামি করে কিন্তু দেখলাম একদম চুপচাপ কি জানি ভাবতে ছিল। ছেলে তার রুমে চলে গেল। আমার স্ত্রী সোফায় বসে কি যেন তাকিয়ে আছে। আমি গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম হাজার চেষ্টা করেও দু চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না, গভীর চিন্তায় মগ্ন। হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে মনের ভিতর, ভাবছিলাম আমার মত একজন সাধারণ শ্রমিক হয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় প্রিয়জনকে ছেড়ে এসেছিল স্বপ্নের শহরে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি সফল হয়েছি। কিন্তু হাজারো প্রবাসীর স্বপ্ন ভেঙ্গে যেন চুরমার হয়ে গেল। অথচ এই প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করে দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। আজ তাদের এই বিপদের সময় কেউ পাশে নেই। আমি একজন সামাজিক কর্মী হিসাবে সাধ্যমত চেষ্টা করেছি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বোঝানোর জন্য। কে শুনে কার কথা, বলার কোনো ভাষা নেই। বড় মায়া হচ্ছিল এই অসহায় প্রবাসীদের জন্য। হয়ত অনেক প্রবাসীর জীবন যাবে এই করোনা যুদ্ধে।
ভাবছিলাম আমি, কি করা যায়? ঠিক এমন সময় দুই ঘন্টা পর ছেলে আমার রুমে এসে তার হাতের আঁকা একটা ছবি দিল বলল বাবা এটা দেখো আমি তার দিকে চেয়ে থাকলাম। আর চিন্তা করতেছি একটি অবুঝ শিশুর অন্তরে কি অনুভূতি জাগল একজন অসহায় প্রবাসীর জন্য। এমন অনুভূতি সবার থাকা উচিত। অসহায় প্রবাসীসহ এমন সব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শ্রেষ্ঠ সময় এখন
লেখক: সভাপতি, চট্টগ্রাম সমিতি ওমান ও সাংগঠনিক সম্পাদক, এনআরবি সিআইপি এসোসিয়েশন
























