কলকাতার কত রঙ্গ এবং বাবু সংস্কৃতি

পর্ব ৬

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ২৭, ২০২১

বিদ্যৎজনের চিন্তাভাবনা, সমাজসংস্কার ও নব্যধনীদের সৌখিনতা, সেই সাথে বাবু সংস্কৃতির পাশাপাশি ভিন্ন একটি সংস্কৃতিও সে সময়ের কলকাতায় বহমান ছিল। এটা ছিল কলকাতার নিজস্ব ধাঁচে গড়ে ওঠা লোক সংস্কৃতি। রাস্তা ঘাটে, হাটে বাজারে খেটে খাওয়া মানুষদের দৈনন্দিন পেশা ও বৃত্তির পর নিজেদের বিনোদনের জন্য সৃষ্ট ব্যঙ্গ-কৌতুক, নাচ-গান, সঙসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠান শহরে বেড়ে উঠছিল। বিশেষ করে উনিশ শতকে কলকাতার শ্রমজীবী ও কারিগররা গ্রাম থেকে সদ্য আগত ছিলেন, তাঁদের অবসর বিনোদনের শিল্পকলা তাঁরা কলকাতায় বহন করে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তা আর কলকাতায় এসে নিজ বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারলো না। কলকাতার নাগরিক পরিবেশে গ্রাম্য কবিগান, পাঁচালী, যাত্রা, কীর্তন কিছুটা রূপান্তরিত হয়ে নতুন মাত্রা পেয়েছিল। জনগণের মুখে মুখে প্রচলিত ছড়া ও প্রবাদ ছাড়াও শহরে ঐ সময়ে শোনা যেতো নানা ধরনের গান; কীর্তন, রাস্তার ভিখারির গান, ফেরিওয়ালার গান, ঝুমুর গান, খেমটা নাচ, কাসারিদের সঙ, চড়ক ইত্যাদি।

স্মরণ রাখতে হবে, এগুলো লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারাবাহী তবে এর গুরুত্ব অন্যভাবে বিচার্য। প্রথমে এতে কলকাতার নাগরিক সমাজ জীবনের আচার-আচরণ ও ভাবনা চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। বাবুদের নিয়ে নানাধরনের ব্যঙ্গচিত্র পাওয়া যায় নিম্নবর্গের ঐ সকল শিল্প সংস্কৃতিতে। বাবুদের কাণ্ডকারখানা, চালচলন প্রায়শই নিচুতলার মানুষের প্রবাদবচন বা গান বাজনায় স্থান পেয়েছে। ভদ্রসমাজে অবহেলিত তথাকথিত ছোটলোকদের এই সব প্রবচন ও গান ধার করেই কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’ রচনা করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। কলকাতার বাবুদের সম্পর্কে দেখতে পাওয়া যায়, বাবুরা সব সাহেব হয়ে গিয়েছিল বা সাহেবদের অনুকরণে ব্যস্ত ছিল। কথাটার আবার ভিন্ন সত্য রয়েছে। ইংরেজ সাহেবরা প্রথম এদেশের বহু কিছু নকল করার চেষ্টা করেছেন। সাহেবরা, প্রধানত এদেশী মেয়েদের পাল্লাতে পড়েই পান খাওয়া শিখেছেন, আলবোলা গড়গড়া হুঁকো ফুকেছেন, উৎসব-পার্বণে যোগ দিয়েছেন, হোলী খেলেছেন, মল্লযুদ্ধ করেছেন, পালকিতে চড়েছেন।

কালীঘাটে কালীপূজো তো অনেকেই করতেনই, কোনো কোনো সাহেব বাড়িতে শালগ্রামশিলা পর্যন্ত রাখতেন এবং ব্রাহ্মণ দিয়ে তার পূজোও করাতেন। বাঙালি দেওয়ান মুন্সী আমলাদের বাড়িতে সাহেবরা মধ্যে মধ্যে কুশল খোঁজখবর করতে যেতেন এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদের হাঁটুর উপর বসিয়ে আদর করতেন। বাঙালী গিন্নিরা চন্দ্রপুলি, নাড়কেলের নাড়ু দিয়ে সাহেবদের জলযোগ করাতেন, পাখার বাতাশ করতেন, পান সেজে দিতেন। শেষে একটু তামাক খেয়ে সাহেবরা বাড়ি ফিরতেন। এইভাবেই প্রথমে সাহেবদের বাঙালীকরণের পর্ব হয়েছিল। যদিও মৌজ করে ওয়ারেন হেস্টিংসের মতন আলবোলায় তামাক টানতে খুব কম সাহেবই পারতেন। ভারতীয় রাজা মহারাজাদের মতন ইংরেজ বড়-সাহেবদের আভিজাত্যের প্রধান লক্ষণ ছিল, সোনাবাঁধানো রূপোর গড়গড়া ও আলবোলা এবং তার সঙ্গে দশগজী এক নল ও অন্তত প্রত্যেকের চারজন করে হুঁকোমবরদার। হুঁকোমবরদাররা যে বাড়িতেই থাকত তা নয়, সাহেবদের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত তামাকের সরঞ্জাম নিয়ে তাদের বাইরে যেতে হতো।

গবর্নমেন্ট হাউসে তখন যে ডিনার পার্টি হতো সেখানে পর্যন্ত নিমন্ত্রিত সাহেবদের সঙ্গে হুঁকোবরদাররা যেতো। পরে ইংরেজ মহিলারাও সুগন্ধি তামাকের লোভ সামলাতে পারলেন না, হুঁকো ফুঁকতে আরম্ভ করলে। প্রাইস লিখেছেন, মেমরাও হুঁকো খান অনেক সাহেব তা পছন্দ করতেন না। কিন্তু মেমসাহেবরা আগে সাহেব খেয়ে যাবার পর লুকিয়ে নল মুখে দিয়ে টানতেন। পরে দেখা গেল, মেমসাহেবরা সভাসমিতিতে আলবোলার নল কোমরে জড়িয়ে বসে তাঁরা ফুঁকছেন। কখনো কখনো নল বাড়িয়ে সাহেবদের অফার করছেন। বাঙালি সংস্কৃতির প্রত্যেকটা উপকরণ নয় শুধু, বাঙালী জীবনধারাটাকেও সাহেবদের ধাতস্থ করতে হয়েছে। সেইজন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের বণিক সাহেবদের ইংরেজ ‘নবাব’ বলা হতো। হিকির মতো একজন এটর্নি সাহেবেরও তেষট্টিজন চাকর ছিল। অবস্থাপন্ন সাহেব বণিকদের অনেকের একশোজনেরও বেশি চাকর  থাকতো। সকালবেলা সাহেবের ঘুম ভাঙাতে চাকর আর ঘুম ভাঙাবার পর নাপিত এসে দাড়ি কামিয়ে, নখ কেটে, কান খুঁটে দিতো।

মধ্যাহ্ন ভোজের পর লম্বা ঘুম। সন্ধ্যার আগে সাহেব ও মেমদের ঘুম ভাঙতো। রাতের বেলা বাঈদের নাচের ব্যবস্থা থাকতো। ধনী সাহেবরা এভাবেই নকল করতো ভারতীয় জমিদার আর রাজা মহারাজাদের জীবন। সেটাই ছিল তাদের কাছে আভিজাত্যের প্রকাশ। সাহেবরা নবাবদের মতো শতাধিক চাকর রাখতো আর সেসব চাকররা চুরিচামারি করলে, ব্রাহ্মণ পুরোহিত ডেকে তাদের চালপড়া খাওয়াতো। সাহেবরা যে শুধু কালীমন্দিরে মানত করতে যেতেন তা নয়, চালগড়া, ঘটিচালা, নলচালা, কবচধারণ পর্যন্ত তাঁরা রপ্ত করে নিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় অনেক সাহেব পালকি চড়ে নবাবদের মতন ঘুরতে বের হতেন। হেস্টিংস আর তার বন্ধুবান্ধবরা কবিতা লিখতেন, সংস্কৃত ফারসী শিখতেন, মহাভারত রামায়ণ পড়তেন।  বাংলাদেশের ধানক্ষেতের উপর দিয়ে পালকি চড়ে যেতে যেতে হেস্টিংস অনেক কবিতা লিখেছেন, মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের স্বর্গারোহনের কথা শুনে নাকি কেঁদেই ফেলেছিলেন।

ক্লাইভ, হেস্টিংস সকলেই ‘রাইটার’ বা কেরানী হয়ে বাংলায় এসেছিলেন, লর্ড বা নবাব হয়ে দেশে ফিরে গেছেন। প্রথম যুগের কলকাতার সংস্কৃতি ছিল প্রধানত এইসব ইংরেজ ফ্যাক্টর ও রাইটারদের কালচার, অর্থাৎ সাধারণ তৃতীয়  শ্রেণীর ইংরেজদের কালচার। বাংলার নব্য কালচার বা বাবু কালচার তখনো জনামলাভ করেনি। ইংরেজদের বাংলা দখলের পর সেটা আরম্ভ হবে। ভারতবর্ষের আভিজাত্য বলতে তখন মুঘল সংস্কৃতি বা মুসলমানদের রীতিনীতিই ছিল প্রধান। ইংরেজরা সেসবকে তখন খুবই সমীহ করতো। চলবে