কলকাতার কত রঙ্গ এবং বাবু সংস্কৃতি

পর্ব ৯

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ৩০, ২০২১

সকল বাবুরাই যে খুব খানদানি ছিলেন, তা নয়। যার একটু ভাগ্য পাল্টেছে, বাবুদের দেখে তার বাবুর হবার সখ জন্মাতো। যদি বাবুদের অনুকরণ করে সমাজে একটু পাত্তা মিলে, তাতে দোষ কী? সব বাবুরা তো আর বেলেল্লাপানা করতেন না। বলতেই হবে তাদের সংখ্যা ছিল খুব কম। বহু বাবু জ্ঞানের চর্চা করতেন। কিন্তু অনুকরণ-প্রিয় বাবুরা যা করতেন তা হলো, মদ্য পান আর মহিলাদের নিয়ে হৈ হুল্লোর। সেটা একটা ভয়াবহ রূপ নেয়। বাবুরা রাতে বাড়ি থাকতেন না, কখনো নিজাগারে কখনো বেশ্যা মন্দিরে মজা করে বেড়াতেন। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবু বিলাস’ গ্রন্থে পাওয়া যাবে, ‘কেহ মজিয়াছে কালোয়াতের গানে, কেহ বেশ্যা মুখ চুম্বনে, কেহ আলিঙ্গনে কেহ স্তন মর্দনে....।’

মাহেশেতে স্নান যাত্রা ছিল এরকম এক ফূর্তির জায়গা। নৌকা নিয়ে বাবুরা ফূর্তি করতে যেতেন। মাহেশের স্নানযাত্রায় বাচ খেলে রাঁঢ় নিয়ে বেহদ্দ আমোদ করতেন বাবুরা। স্নানযাত্রা সেকালে কিবা ধনী কিবা দীন সবার সুখের দিন। কৃষ্ণরাম বসু হুগলি থেকে কলকাতায় এসে নূনের ব্যবসা করে প্রচুর রোজগার করেন। ইংরেজদের নুনের একটি চালান একবার একচেটিয়া রূপে বায়না করার ফলে তিনি চল্লিশ হাজার টাকা লাভ করেন। সেই টাকা থেকে তিনি মাহেশের জগন্নাথের রথ তৈরি করান। তিনি হুগলি জেলায় অনেক জমি কেনেন, হুগলি জেলার কালেক্টারের দেওয়ান হিসেবে। কিছু সম্পত্তি দেবোত্তর দান করেন যাতে মাহেশের রথের সমস্ত খরচ নির্বাহ হয়। সেই মাহেশের স্নানযাত্রায় প্রচুর লোক সমাগত হতো।

ঘটনার বছর চল্লিশ পরে ‘হুতোম প্যাচার নক্শা’য় রাঢ় নিয়ে বাচ খেলে মাহেশের স্নানের বেহদ্দ আমোদের বিবরণ আছে। স্নানযাত্রার পর সারা রাত্রি ধরে খেমটা নাচ ও বাঈয়ের নাচের হাট বসে যেতো। বিরাট সংখ্যক মানুষ বজরা নিয়ে যোগ দিতো সেই স্নানউৎসবে। বাবুদের দেখাদেখি গুরুদাসের মতো খুব সাধারণ লোকরা ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে যোগ দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করলো মাহেশের স্নানযাত্রায়। ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে মাহেশে যাবার আয়োজন শুরু করলো গুরুদাস। গুরুদাসের ইয়ার গোপাল বজরা ভাড়া করে নিয়ে এলো। গুরুদাস নিজে গোলাবি খিলির দোনা, মোমবাতি ও মিঠে কড়া তামাক ইত্যাদি সংগ্রহ করে রাখলো। পরের দিন ভোর না হতেই গুরুদাসের ইয়াররা সেজে গুজে এসে হাজির। সকলেই নিজের মতো করে বাবু সাজার চেষ্টা করলো।

গোপাল পায়ে লাল মোজা, পেতলের বড় বড় বোতাম দেয়া সবুজ রংয়ের ফতুয়া, ঢাকাই উড়নি সবই জোগাড় করলো, জুতো জোড়া কেনা হয়নি বলে খালি পা। সকলে বজরায় উঠলো, নদীতে জোয়ার তখনো আসেনি। মাঝিরা তাই শুটকি মাছ, লঙ্কা ও কড়ায়ের ডাল দিয়ে ভাত খেতে বসেছে। বজরায় উঠেই গুরুদাসের বন্ধু ব্রজ এক ছিলিম গাঁজা তৈরি করতে বসলো। ইয়ার গোপাল হঠাৎ বলে বসলো, দ্যাখ ভাই গুরুদাস, আমাদের আমোদের চুড়ান্ত হয়েছে কিন্তু একটার জন্য ফাঁকা ফাঁকা দেখাচ্ছে; মেয়েমানুষ না হলে তো স্নানে আমোদ হয় না। বন্ধু নারাণ বলে উঠলো, চারদিকে যে নৌকার দিকে তাকাই, সকলি মাল ভরা, কেবল আমরা ব্যাটারাই নিরামিষ। ভাবখানা আমরা যেন বাবার পিণ্ডি দিতে গয়া যাচ্ছি।

গুরুদাসের আত্মসম্মানে লাগল খুব। বললো ঠিক বলেছিস, যা যতো টাকা লাগে মেয়ে মানুষ নিয়ে আয়, এসবে আমি বাবা পেচপা নই। সকলেই মেয়েমানুষের সন্ধানে বেরুলো। কিন্তু শেষ বেলায় আর শহর তন্ন তন্ন করে মেয়ে মানুষ পাওয়া গেল না। মেয়েমানুষ না পেয়ে গুরুদাসের মন ভেঙে পড়লো। গুরুদাস নিজে আবার মেয়েমানুষ জোগারের চেষ্টা করে না পেয়ে হতাশ হলো। সঙ্গে সঙ্গে সে বাড়ি গেল। বাড়ি গিয়ে পিসিরে বললো, পিসি আমাদের একটা কথা রাখতে হবে। পিসি বললেন, গুরুদাস আগে বলো কী কথা। গুরুদাস বললো, পিসি আমাদের একটিও মেয়ে মানুষ জোটে নাই। শুধু নিরামিষ রকমে যেতে মন সচ্চে না। পিসি আমরা আমোদ কত্তে কত্তে যাবো, তুমি কেবল বসে যাবে আমাদের সঙ্গে, কার সাধি তোমাকে কিছু বলে। পিসি এই শুনে গাই গুই করতে লাগল, কিন্তু মনে মনে যাবার ইচ্ছাটাও ছিল। সুতরাং অনুরোধ এড়াতে না পেরে ভাইপোর সঙ্গে স্নানে গেলেন।

সংবাদ ভাস্কর পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে ভদ্রসন্তানরা মাহেশে স্নানযাত্রায় যাবার বা ফেরারা পথে বেলেল্লাপনাই করতেন যা তাদের বংশ মর্যাদা, শিক্ষা দীক্ষার সঙ্গে কোন মতেই মেলার কথা নয়। কয়েকবছর পর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় অক্ষয় কুমার দত্ত লেখেন, ‘ধর্ম্মের নামে ভাগীরথীর  স্রোতে সুচিত্র তরণীকে ভাসমান করিয়া সুবেশী বারাঙ্গনাগণ সঙ্গে মাদক মদে উন্মত্ত হইয়া সুদীর্ঘ চীৎকার সংযুক্ত উল্লাস, কোলাহল দ্বারা জল কল্লোল ধ্বনিকে অতিক্রমণপূর্বক অশেষ প্রকার নির্লজ্জ ব্যবহার’ করে বাবুরা। কেবল মাত্র বাবুরা নয় স্কুলের উঁচু ক্লাশের ছাত্ররাও স্নানযাত্রা এবং দ্বাদশ গোপাল দেখতে যেতো। সঙ্গে তাদেরও অবশ্যই মদ এবং মেয়ে মানুষ থাকতো।  নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, মাহেশের স্নানযাত্রার সময়ে কলিকাতার অনেক বাবু বারাঙ্গনা সমভিব্যাহারে নৌকা করে আমোদ করতে করতে মাহেশে যেতেন। বাবুদের বাঈ নাচ আর খেমটা নাচ প্রীতি নিয়ে নানা কথা লিখেছেন তখনকার লিখিয়ে অনেকেই।

সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, উনিশ শতকের বাংলা দেশে উপরোক্ত দুটি জনপ্রিয় নাচের ঢং তদানীন্তন বাংলা সংস্কৃতির দুটি ভিন্ন ধারার সংঘাতকে এক অর্থে চুম্বকাকারে তুলে ধরে। দুটি নাচের উৎস ভিন্ন, যদিও এ যুগের কিছু বিশেষজ্ঞ বাঈ নাচ ও খেমটা নাচকে অনেক সময়ই একই পংক্তিভুক্ত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র খেমটার নিন্দা করতে গিয়ে লিখেছেন, খেমটা বাংলার নৃত্য, বাইদিগের নৃত্য মহারাষ্ট্রীয়। খেমটা তান্ত্রিক, মহারাষ্ট্র নৃত্য পৌরাণিক। পুরানের ন্যায় এই নৃত্যের গাম্ভীর্য় আছে।’ খেমটার বিরুদ্ধে বিষোদগার ও বাঈ নাচের সমর্থনে সাধারণী পত্রিকায় লেখা হয়, ‘বঙ্গভাষায় নাটক অভিনয়ের আর যে উদ্দেশ্য থাকুক নীচ ভাবোদ্দীপক জঘন্য খ্যামটা নাচ সমাজ হইতে বহিস্কৃত করা একটা প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। বাঈ নাচ থাকিলে ক্ষতি নাই।’ বাঈ নাচ ও খেমটা নাচ সম্বন্ধে ভদ্রলোকদের এই যে বৈষম্যমূলক মনোভাব, এ প্রায় পরম্পরাগত হয়ে আজও মধ্যবিত্ত মানসে সক্রিয়। সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় তাই প্রশ্ন তোলেন, ‘নিরাবেগে, যুক্তি দিয়ে বিচার করতে গেলে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, হালকা, চটুল ভঙ্গি কি বিভিন্ন লোকনৃত্যে প্রায়ই দেখা যায় না?’

সুমন বন্দ্যোপাধ্যায় আসলে পরবর্তীতে বাংলার লোক-সংস্কৃতির পক্ষ নিয়ে কতোগুলি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যাকে বাবুদের অনেকই নীচু চোখে দেখতেন। কলকাতার লোক সংস্কৃতির আদিপর্ব গড়ে উঠেছিল পল্লীর সাধারণ মানুষদের দ্বারা। বহিরাগত মানুষদের বেশির ভাগ ছিলেন নিকটবর্তী গ্রামের শ্রমজীবী; কৈবর্ত চাষী, জেলে, ময়রা, ধোপা, মালি, দরজি, কারিগর, ছোট পণ্যদ্রব্য বিক্রেতা। তাঁরা নতুন শহরে বাসা বেঁধেছিলেন জীবিকার্জনের উদ্দেশ্যে। কলকাতা শহরে প্রথম যে শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির সন্ধান পাওয়া যায় তার মধ্যে সদ্য আগত গ্রামবাসীর পল্লী সংস্কৃতির ছাপ সুস্পষ্ট। যাত্রা, পাঁচালী, তরজা, খেড়ু বা খেউড়, কবিগান ইত্যাদি সব কলকাতার আদি সংস্কৃতি। কবিয়ালদের কবির লড়াইতে খেউড় একটা অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে স্থান পেয়েছিল। খেউড় ছিল ছড়া ও গানের মাধ্যমে আদিরসাত্মক ব্যঙ্গোক্তির আদান-প্রদান। কলকাতার প্রথম পর্বে যেসব কবিয়ালদের নাম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে আছে: গোঁজলা গুঁই, কেষ্টা মুচি, রঘুনাথ দাশ।

সমসাময়িক বিবরণীতে গোঁজলা গুঁই কৈবর্ত বা গোয়ালা সম্প্রদায়ভুক্ত বলে অনুমিত আর রঘুনাথ দাশ তন্তুবায় বা কর্মকার। পরবর্তীকালের জনপ্রিয় কবিয়াল ব্রাহ্মণ হরু ঠাকুর, রঘুনাথ দাশ ছিল গোঁজলা গুঁইয়ের শিষ্য। কায়স্থ রামবসু তাঁর চেয়ে নীচু বংশের কবিয়ালের শিষ্য ছিলেন। সাধারণত জাতপাত নিয়ে এঁরা তেমন মাথা ঘামাতেন না ভদ্রলোকদের মতো। হরু ঠাকুরের শিষ্য আর এক নামকরা কবিয়াল ভোলা ময়রা। নিতাই বৈরাগী আর এক জনপ্রিয় কবিয়াল। দলিলপত্র ঘাটলে এরকম বহু কবিয়ালের নাম পাওয়া যাবে। চলবে