কলকাতার কত রঙ্গ এবং বাবু সংস্কৃতি

পর্ব ১০

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুলাই ০৩, ২০২১

কলকাতা শহরে তখন কবিগানের আসর জাঁকিয়ে বসেছিল। নানা জাতের কবিদের মধ্যে পর্তূগিজ এক কবিয়ালকে পাওয়া যাচ্ছে যার নাম হেনসম্যান অ্যন্টনি যিনি ফিরিঙ্গি আন্টুনি নামে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। দয়ামণি, গোলকমণি, রত্নমণি নামে তিনি মহিলা ‘নেড়ে কবি’, মানে বৈষ্ণবী গায়িকার কথা জানা যায়। কলকাতার কবিগানের অনুষ্ঠানে এঁরা নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। প্রধানত কৃষ্ণলীলাকে কেন্দ্র করে নর-নারীর প্রেমের ব্যাখ্যানই কবিগানের আসল উপজীব্য। এই গানের বিষয়বস্তুতে সচরাচর তিনটি বিভাগ লক্ষ্য করা যায়: ভবানী বিষয়, সখী সংবাদ ও খেউড়। কবিগানের আবার নানা রূপভেদ ছিল। হাফ-আখরাই-এর সঙ্গেও কবিগানের নিকট সম্পর্ক ছিল। হাফ আখড়াই তৈরি হয় অতীতের ‘আখড়াই’ গীতিশৈল থেকে। কুলুচন্দ্র সেনের উদ্যোগে ‘আখড়াই’ তখনকার কলকাতার বাঙালী অভিজাত সমাজে ‘বৈঠকি গান’ রূপে সমাদৃত ছিল।

কুলুই বাবুর ভাগ্নে টপ্পা পারদর্শী নিধুবাবু আখড়াইয়ে আরো উচ্চাঙ্গের সুর, তাল, লয় প্রবর্তন করেন। আখড়াই ছিল দুই দলের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গায়কী ঢংয়ের প্রতিযোগিতা। হাফ আখড়াইতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সুরাশ্রয়ী গায়কী ঢংয়ের প্রতিযোগিতার পরিবর্তে কথানির্ভরশীল গানের প্রত্যক্ষ আদান-প্রদানই বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। কলকাতার বাঙালী হঠাৎ রাজারা, মানে ধনী লোকরা এইসব স্বভাব কবির আখড়াই ও কবিগানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সাধারণ মানুষদের রুচির সঙ্গে প্রথম যুগের ধনী হওয়া মানুষের রুচির তেমন পার্থক্য ছিল না।

বঙ্কিমচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে পরবর্তীকালে শিক্ষিত বাবুরা অনেকেই তাদের গান বা বিভিন্ন কবিয়াল চিন্তার উপস্থাপনাকে বিকৃতরুচির বলে অভিযোগ তুলেছিলেন। বিকৃত রুচির যাঁরা বলেছেন, কখনোই এসবের উৎপত্তির ধারাবাহিকতার দিকে নজর দেননি। ধামালী, ঝুমুর, খেউড়, ইত্যাদির উপস্থাপন বা নৃত্যে যৌনাত্বক ব্যঞ্জনা শ্রোতা-দর্শকদের কাছে খুব স্বাভাবিকভাবেই অনুমোদিত ছিল এবং তার সারমর্ম গ্রহণে তাঁরা বেশ দক্ষ ছিলেন। শিল্পী ও দর্শক শ্রোতাদের অধিকাংশ নিম্নশ্রেণীভুক্ত ছিলেন এবং তাঁদের সামাজিক আমোদানুষ্ঠানে খোলামেলা আদিরসাত্মক নাচ-গান ও ঠাট্টা-রসিকতার প্রথা ছিল। যাকে বিকৃত ভাবা হচ্ছে, সেই সব উপস্থাপনে কখনো কখনো শাসকদের শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটা দিকও ছিল। বিবেকানন্দের ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন, ‘সে সব অতি অশ্লীল ও অশ্রাব্য গান। বাড়ির মেয়েদের সম্মুখেও সেই সব গাওয়া হইত এবং পাছে ভুল হয় এজন্য হাতে লেখা খাতা রেখে দিয়েছে, ইহাকে অপর কথায় খেউড় গান বলিত। তখনকার দিনে এ সবের প্রচলন ছিল এবং লোকে বিশেষ আপত্তি করিত না বরং আনন্দ অনুভব করিত। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা ও কেশব সেন মহাশয়ের অভ্যুদয় হইতে ধীরে ধীরে এ সব উড়িয়া যায়।’

মহেন্দ্র জানাচ্ছেন, সেসব অশ্লীল হলেও তা সর্বসাধারণে প্রচলিত ছিল আর বাড়ির মেয়েদের সামনেই তা উপস্থাপিত হতো। ব্যাপারটা মোটেই দোষণীয় ছিল না ইংরেজি শিক্ষার আগে পর্যন্ত। খুব স্পষ্ট যে, স্বাভাবিকভাবেই এরকম অশ্লীল বিষয় গ্রহণ করবার সহজ মানসিকতা তখন সমাজে ছিল। কলকাতার কবিয়ালদের গানে খেউর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। শহরের নিম্নশ্রেণীর মানুষরা খেউরের ভক্ত ছিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত মন্তব্য করেছেন, ‘বিশিষ্টজনেরা ভদ্রগানে এবং ইতরজনেরা খেউর গানে তুষ্ট হতো’। সংস্কৃতি আসলে কখনো সব পক্ষের হয় না, সেখানেও শ্রেণীর প্রশ্ন থাকে। সব শিল্প-সাহিত্যের বেলায় একথাটা সত্য। ফলে ভদ্রলোকদের সঙ্গে ইতরজনের মিলবে কেন? বিশেষ করে খেউর গানে যখন হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সাহেব আর বাবুদের নিয়ে ব্যঙ্গ করা হতো। কবিগানের সংগ্রাহক ঈশ্বর গুপ্ত তথ্য দিচ্ছেন যে, কলকাতার ঠনঠনে নিবাসী লক্ষীকান্ত বিশ্বাস, যিনি সাধারণের কাছে ‘লোকে কানা’ কবিয়াল বলে খ্যাত ছিলেন, ধনিকবর্গের কাছে ভয়ের পাত্র ছিলেন। খুবই ভয় পেয়ে ধনীরা সর্বদা তাঁকে অর্থ দিয়ে মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করতেন, কি জানি কখন কি বলে বসে। শহরের বড়লোকদের হঠাৎ জাতে ওঠার দৌড়ে কারুর এগিয়ে যাওয়া, কারুর পিছিয়ে পড়া, উচ্চবর্ণের পদবী পাবার জন্য হাপিত্যেশ; এসব নিয়ে শহরের নিম্নবর্গের কবিয়ালরা অনেক ছড়া লিখেছিলেন। ধরা যাক নিচের দুটি:
দুলাল হলো সরকার, ওক্কুর হলো দত্ত
আমি কিনা থাকব যে কৈবত্ত, সেই কৈবত্ত।
বা
হাল বয়, তাল খায়, গিধনায় বাস
তার বেটা কায়েত হল, বিশ্বাস খাস।

শহরের কবিয়ালরা এই যে একদল মানুষের হঠাৎ বিত্তশালী হওয়া আর ফুটানি দেখানো, তা মানতে পারেনি। নানাভাবে তার প্রমাণ মেলে। প্রমথনাথ মল্লিকের রচনা থেকে জানা যাচ্ছে, কলকাতার কোনো এক জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে কবিয়াল ভোলা ময়না নিমন্ত্রণ কর্তার কিপটে স্বভাবকে ব্যঙ্গ করে তাঁর মুখের উপরেই ছড়া কেটে শুনিয়ে দিয়েছিলেন:
পিঁপড়ে টিপে গুড় খায়, মুকতের মধু অলি।
মাপ কর গো রায় বাবু, দুটো সত্য কথা বলি।

কবিয়ালরা মহাভারতের কৃষ্ণকে পর্যন্ত নানাভাবে ব্যঙ্গ করে নীচে নামিয়ে আনতো তাদের কৃষ্ণলীলায়। কারণ কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। কবিয়ালদের রামলীলার কৃষ্ণের সঙ্গে মহাভারতের কৃষ্ণের মিল খুঁজতে যাওয়া ভুল হবে। কৃষ্ণকে তাঁরা ছেড়ে কথা কইতেন না। কারণ কৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরাতে গিয়ে রাজা হয়ে অতীতকে ভুলে গেছে, রাধাকে এখন আর স্মরণ হয় না। কবিয়ালদের নানা গান পাওয়া যাবে এ বিষয় নিয়ে। কৃষ্ণের সে চরিত্রের সঙ্গে হঠাৎ-বাবুদের যথেষ্ট মিল। দুজনেই ক্ষমতা বা অর্থ পেয়ে পুরানো অতীতকে ভুলে গেছে। রাধাকে পর্যন্ত ভুলে গেছে কৃষ্ণ। ঠিক একইভাবে কলকাতার বাবুরা ঘরের বউকে কাঁদিয়ে বেশ্যা নিয়ে ফূর্তি করছেন। ফলে এমন রামলীলা বাবুদের কেন আর পছন্দ হবে? বাবুরা বিরুদ্ধে চলে গেলেন। যাত্রা আর খেমটা নাচ প্রথম ভদ্রলোকদের খুব প্রিয় ছিল। মহেন্দ্র দত্ত ছেলেবেলায় যাত্রা দেখেছিলেন। তিনি জানাচ্ছেন যার উদ্যোক্তা ছিলেন পাড়ার বস্তির গোয়ালারা। নিম্নশ্রেণীর মানুষ নানারকম শিল্প-সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন আর তার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নিম্নশ্রেণীর জনসাধারণ। কিন্তু ইংরেজ সাহেবদের নাটক আসার পর যাত্রা বিতারিত হলো ভদ্রলোকদের বাড়ি থেকে। ইতরজনের নাচ গান বা রঙ ঢংয়ে বাবুদেরতখন পোষাচ্ছে না। ফলে খেমটা নাচ বাতিল হয়ে স্থান করে নেয় বাঈ নাচ। বাঈ নাচের বিরাট দর্শক তখন কলকাতার ইংরেজরা।   

সরস্বতীর ইতর সন্তানদের পক্ষে কলম ধরার তখনো মানুষ ছিল। রবীন্দ্রনাথ মাঝে মধ্যেই ধরতেন। কলকাতার ‘বাল্মিকী যন্ত্রে’ ছাপা ১৮৭৫ সালে প্রকাশিত ‘সুরলোকে বঙ্গের পরিচয়’ বইটিতে মজার একটি গল্প পাওয়া যায়। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর দেবলোকে অবস্থানকালে একদিন স্বরসতী দেবীর আশ্রমে হাজির হয়ে দেখলেন, অসংখ্য নীচ বিকলাঙ্গ বঙ্গভাষার শব্দবৃন্দ, কৃতাঞ্জলী হইয়া শ্রীবন্ধনপূর্বক দণ্ডায়মান আছে এবং সকলে কহিতেছে, ‘মাতঃ! সাধু কিম্বা নীচ ভাষার শব্দ সকলই আপনা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। আমরা সকলেই আপনার সন্তান, সকলই সমান স্নেহাস্পদ, সকলের সমান অধিকার হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদিগের তপস্যার কি বিড়ম্বনা! যেহেতু অনাদিকাল হইতেই আমরা নীচ জাতির আশ্রয়ে দিনপাত করিতেছি, ভদ্রসমাজে আমাদিগের কোন স্বাধিকার নাই, সেই দুঃখে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া অদ্য মাতৃসদনে আসিয়াছি, এবার সাধু সমাজে অধিকার না দেওয়াইলে আমরা আপনার শ্রীচরণ প্রান্তে অনাহারে প্রাণ ত্যাগ করিব।’  

বঙ্গভাষার এই নীচ বিকলাঙ্গ শব্দবৃন্দের প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে স্বরসতী দেবী তাদের আদেশ করলেন বঙ্গদেশে গিয়ে ভদ্রসমাজে তাদের অধিকার দাবি করতে। স্বরসতীর নির্দেশে প্রথমে তারা বিদ্যাসাগর মশাই-র কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো। কিন্তু বিদ্যাসাগর তাদের ভাগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘তোমরা স্বরসতীর বংশোদ্ভব বটে, কিন্তু তাঁহার সংস্কৃত নামক পুত্রের সন্তান নহ, সংস্কৃত হইতে যে সকল সাধু শব্দ উৎপন্ন হইয়াছে, তাহারা সংস্কৃতের ঔরসপুত্র; তাহারাই আমার পুস্তকে স্থান পায়।’ কথিত ইতর শব্দরা তখন কলকাতার বাঘা বাঘা লোক যেমন: ভট্টাচার্য, বিদ্যারত্ন, তর্কলঙ্কারদের দোরে দোরে গিয়ে ধর্না দিল, কিন্তু প্রত্যেকেই চোখ রাঙিয়ে, দারোয়ান ডেকে তাদের তাড়িয়ে দিলেন। মর্ত্যালোকে ইতর শব্দদের এইরকম অপমানের কথা শুনে এবার স্বরসতী দেবী নতুন ফতোয়া জারি করলেন। নাটক-রচয়তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পুস্তক লেখক, সরকারের অনুবাদক, জেলা আদালতের উকিল ও আমলাদের হুকুম দিলেন, ‘আমি বিকলাঙ্গ ইতর শব্দগণকে তোমাদিগের সন্নিধানে প্রেরণ করিব, ইহাদিগকে হতাদর না করিয়া তোমাদিগের বর্ণনাতে সাদরে স্থান দান করিবে।’ স্বরসতী দেবীর এই প্রত্যাদেশে সবচেয়ে প্রথম সাড়া দিলেন কালী প্রসন্ন সিংহ যিনি ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’ লিখে ইতর শব্দের যথেষ্ট সমাদর করলেন। পরে অবশ্য নাট্য-রচয়িতারা অনেকে ইতর শব্দকে নাটকে প্রয়োগ করেছিলেন। মধুসূদন তাঁর দুটি নাটকে সাধারণ মানুষের অনেক ভাষা ব্যবহার করেন। দীনবন্ধু তাঁর নীলদর্পণ নাটকে অনেক ক্ষেত্রেই তাই করেছেন।

‘ইতর’ বাংলা আর ‘সাধু’ বাংলার মধ্যে যে বরাবর টানাপোড়েন ছিল, বক্ষ্যমান গল্পে সেটা খুব সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। মুসলিম শাসনে বাংলা ভাষা যখন সৃষ্টি হয়, তখন দেশজ ও তৎভব শব্দের সঙ্গে এসে জুটেছিল আরবি-ফারসি শব্দ। বিদ্যাসাগর তাঁর সময়ে বাংলা ভাষার ভিতর থেকে সে সব শব্দ বাতিল করে সংস্কৃত শব্দ বসিয়ে দিয়ে সংস্কৃতঘেঁষা বাংলা রচনা করেন। বহুজন তখন প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষার সন্তান। বহুকাল এ বিশ্বাসটি দৃঢ় ছিল। বহু পরে এই বিশ্বাস নস্যাৎ হয়। নবজাগরণের কালে বাংলার হিন্দু ভদ্রলোকরা কখনো বৈদিক ধর্মের দিকে তাকিয়ে, কখনো বা ইংরেজদের দিকে ঝুঁকে নিজেদের নতুন পরিচয় দিতে চেষ্টা করেছিলেন। বাংলার নিম্নবর্গের হিন্দু-মুসলমানদের সংস্কৃতি আর ভাষাকে তাঁরা মনে করতেন তা ইতর জনের ভাষা বা সংস্কৃতি। বর্ণহিন্দুদের একটি বিরাট অংশ যে শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধি বা দালাল হিসেবে তৎকালে শুধু বাঙালী মুসলমানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন তা নয়, বিচ্ছিন্ন ছিলেন তাঁরা নিম্নশ্রেণীর হিন্দুর সঙ্গেও। বরং নিম্নশ্রেণীর হিন্দুর সঙ্গে নিম্নশ্রেণীর মুসলমানের বন্ধনটি ছিল অটুট। সাম্প্রদায়িকতার যে প্রশ্নটি বারবার তোলা হয় বিশ শতকের শুরু থেকে, সেটা বর্ণহিন্দুদের বিভ্রান্তিকর প্রচার বা বিচারের লক্ষণ। নিম্নবর্ণের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নটি আদৌ ছিল না তখন।

বাঙালী বাবুরা তখন নিম্নবর্ণের ভাইদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইংরেজ সাহেবদের বন্ধু হবার চেষ্টা করেন। ইংরেজদের পদলেহন করতে গিয়ে নিজ ভাইদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ান। নিজ ভাইদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ইংরেজ শাসকদের তোষণ আরম্ভ করেন। বাবুদের কাছে ব্যাপারটা এমন যে, ইংরেজ তাঁর ভাই হতে পারে কিন্তু নীচু জাতের হিন্দু নয়; মুসলমানও নয়। নিম্নবর্গের বা কৃষক বাঙালী হিন্দু-মুসলমান, দুপক্ষেরই বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিলেন ভদ্রলোকরা। ফলে প্রথমে ভয়াবহ সখ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ হন ইংরেজদের সঙ্গে। দূর্গাপূজায় কলকাতায় বাবুদের বাড়িতে বাঈনাচ অতি অবশ্যই হতে হবে। নিম্নবর্ণের হিন্দুর স্পর্শে বা মুসলমানের স্পর্শে জাত গেলেও, ইংরেজদের ছোঁয়ায় জাত যেতো না ভদ্রলোকদের। ভিন্ন দিকে বাঈরা ছিলেন অনেকেই মুসলিম, কিন্তু তাঁদের আবার বাদ দিয়ে চলতে পারেননি বাবুরা। বাঈনাচ ছাড়া দুর্গাপূজা হয় কেউ তখন কল্পনাই করতে পারতো না। কারণ সাহেবরা আসবেন আমন্ত্রিত হয়ে। তাদের সম্মানে সেখানে বাঈনাচ থাকতেই হবে। ইতর বাঙালীর খেমটা নাচের জায়গা সেখানে নেই। বাবুরা যেন বাঙালী হয়েও ভিন্ন জাত। কবিয়ালগান, খেউড়, হাফ আখড়াই, খেমটা নাচওয়ালাদের চেয়ে ইংরেজরা অনেক সভ্য জাতি তাঁদের চোখে। কারণ ইংরেজরা তখন শাসকদের জাত। কিছুদিন আগে যাঁরা মুঘল শাসকদের সংস্কৃতকে সমীহ করতো, এখন তাঁরাই নতুন শাসকদের পদলেহনে ব্যস্ত হলো।

বাবুদের বাড়ি বাঈনাচের আসরের পাশে চণ্ডীমণ্ডপে দেবী দুর্গার পূজা হচ্ছে আর অন্যদিকে উঠোনের সামিয়ানার তলায় লম্বা খাবার টেবিলে টার্কি, শুয়োরের মাংস, দেশি বিদেশি কতো সব খাবার আর দামি মদ সাজানো। পর্তূগিজ আর মুসলমান বাবুর্চিরা সেখানে দারুণ ব্যস্ত। মুসলমানরা বাবুর্চিরা আবার এখানে বাবুদের জাত নষ্ট করছে না, কারণ মুসলমান বাবুর্চি ছাড়া সাহেবদের উপযোগী মুঘল খানা রান্না করবে কে? বড় বড় ইংরেজ রাজপুরুষরা এলে ‘গড সেভ দি কিং’ বাজনা বাজানো হচ্ছে। বছরে এই তো একটাই দিন সাহেব ভজনার। কিন্তু বাবুদের জীবনে শীঘ্রই দুঃখ নেমে এলো। দেশীয়দের সঙ্গে ইংরেজ রাজপুরুষদের মেলামেশা সরকার অনেকদিন ধরেই পছন্দ করছিল না। তাই ১৯৪০ সালে দশ নম্বরী আইন জারি হলো। এ আইনে বলা হলো, ইংরেজরা যেন দেশীয়দের পূজা, বাঈনাচ এসবে আর যোগ না দেন। বাবুদের বাড়িতে যেসব সাহেবরা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসতেন  তাঁরা মুষরে পড়লেন এবং বাবুদের সাহেব ভজনার এক অধ্যায় এভাবেই শেষ হলো। ফলে ঝাড়লণ্ঠনের রোশনি, ঘুংঘুরের আওয়াজ, ওস্তাদি-গানের সুরের মুর্ছনা, মদের বন্যা, ক্যাওড়ার সুবাস আর চিকের আড়ালে বেনারসীর খসখসানি চুড়ির আওয়াজ, বড় বড় ইংরেজ রাজপুরুষদের আনাগোনা ক্রমে বিদায় নিল। চলবে