কলকাতার কত রঙ্গ এবং বাবু সংস্কৃতি

পর্ব ১১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুলাই ০৪, ২০২১

সব সমাজই হলো ইতি আর নেতির সমাহার। সব সমাজ নানা বিপরীত সত্যকে লালন করে এবং নানা বিপরীতের দ্বন্দ্বে কম্পমান থাকে। দ্বান্দ্বিক নিয়মেই অবক্ষয়ী এই বাবু সংস্কৃতির মধ্য থেকে দু-একজন অন্যরকম সংস্কৃতির দিকে পা বাড়িয়েছিলেন, তাহলো মুদ্রণশিল্প। কলকাতার নানা রঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে ইতিবাচক রঙ্গটি হলো প্রকাশনা বা মুদ্রণযন্ত্র। ধানভাঙা ও গমভাঙা কল বা অন্যান্য নানারকমের কল কলকাতা শহরে ও তার উপকণ্ঠে পৌঁছানোর অনেক আগে মুদ্রাযন্ত্র বা বইছাপা কল এদেশে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল।

আঠারশো পঁচিশ-ছাব্বিশ সালে কলকাতা শহরে একাধিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তারমধ্যে শোভাবাজারের বিশ্বনাথ দেবের প্রেস, শাস্ত্রপ্রকাশ প্রেস, শিয়ালদাহর পীতাম্বর সেনের প্রেস, মির্জাপুরের সম্বাদতিমিরনাশক প্রেস, মুন্শী হেদাতুল্লাহর প্রেস, আরপুলির হরচন্দ্র রায়ের প্রেস, এণ্টালির পীয়ার্স সাহেবের প্রেস, শাখারিটোলার বদন পালিতের প্রেস, মহেন্দ্রলাল প্রেস, ধর্মতলার রামমোহন রায়ের ইউনিটোরিয়ান প্রেস, বঙ্গদূত প্রেস, সমাচার চন্দ্রিকা প্রেস, ফেরীস এ- কোম্পানির প্রেস, সংস্কৃত যন্ত্র, হিন্দুস্থানী প্রেস, কলেজ প্রেস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

ধানকল, গমকল, পাটকল, কাপড়ের কলের অনেক আগে হিকি সাহেব, গ্লাডউইন সাহেব, রামমোহন রায়, মির্জাপুরের ব্রাহ্মণ বাবুরাম, বাঙালী ব্রাহ্মণ গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য, চোরবাগানের রামকৃষ্ণ মল্লিক, শাখারিটোলার বদন পালিত ও মহেন্দ্রলাল, বিশ্বনাথ দেব, মুন্শী হেদাতুল্লাহ প্রভৃতির বইছাপা কল বাংলার ও বাঙালীর নবজীবনের কেন্দ্র কলকাতা শহরকে গ্রন্থ নগরীতে পরিণত করেছিল। কলকাতা তার বাবু সংস্কৃতির পাশাপাশি গ্রন্থনগরী হিসেবে গড়ে উঠলো। মনে রাখতে হবে, এক্ষেত্রে ইংরেজ শাসনের দান ছিল বিরাট। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের সবচেয়ে বড় অবদানগুলির একটি হলো ছাপাখানা আর সংবাদপত্র।

কলকাতা মহানগরকে যাঁরা গ্রন্থনগরীরূপে গড়ে তুলেছিলেন ছাপা বই ও পত্রিকা দিয়ে, তাঁদের মধ্যে সবার আগে দুজন বাঙালীর নাম করতে হয়; পঞ্চানন কর্মকার ও গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। কলকাতায় আনুমানিক আঠারশো ছয়-সাত সালে ছাপাখানা স্থাপিত হলেও প্রধানত দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দী ও সংস্কৃত বই সেখান থেকে ছাপা হতো। তার আগে পঞ্চানন কর্মকার অবশ্য উইলকিন্স সাহেবের কাছে কাজ শিখে বাংলা ছাপার হরফ তৈরি করেছেন এবং তাতে বইও ছাপা হয়েছে কিন্তু সাহেবদের প্রেস থেকে। কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপনের পর আঠারশো ছিয়াত্তর সালে বড়লাট হেস্টিংস হ্যালহেডকে দিয়ে প্রথমেই ‘জেণ্টু কোডস’ নামে হিন্দু আইনের একটি বই লিখিয়েছিলেন।

ইংরেজরা কাজটি করেছিলেন নিজেদের জন্য আর তাতে যারপর নাই লাভ হয়েছে গোটা বাংলার মানুষের। এরজন্য দশজন হিন্দু পণ্ডিত মিলে সংস্কৃত ভাষায় হিন্দু-আইনের একটি সংক্ষিপ্তসার তৈরি করেন। কার্যকরভাবে শাসন করতে হলে স্থানীয় ভাষা ভালো করে জানা দরকার। এই প্রয়োজনের কথা মনে রেখেই হেস্টিংস হ্যালহেডকে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ লেখার অনুরোধ করেছিলেন।

বাংলা ব্যাকরণ রচিত হওয়ার পর যখন দেখা গেল সে ব্যাকরণ ছাপানোর মতো কোনো প্রেস তো দূরের কথা, বাংলা ছাপার কোনো হরফই নেই, তখন হেস্টিংস অন্য একজন কর্মচারী চার্লস উইলকিন্সকে দিয়ে বাংলা হরফ তৈরি করান। সেই হরফ দিয়ে আঠারশো আটাত্তর সালে হুগলির একটি ছোট ছাপাখানায় মুদ্রিত হয় বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ। ফলে বর্তমানকালের বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি ইংরেজ শাসনের বড় অবদান এ কথা মন খুলে স্বীকার করতে হবে। বাংলা হরফ তৈরি করার ব্যাপারে চার্লস অবশ্য অসাধারণ সাহায্য পেয়েছিলেন পঞ্চানন কর্মকারের। কী করে হরফ তৈরি করতে হয়, উইলকিন্সের কাছ থেকে সেই কৌশল শেখার পর পঞ্চানন তাঁর পুত্র এবং পৌত্রদের নিয়ে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর বঙ্গদেশে ইংরেজী হরফ তৈরির ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

ইংরেজ শাসনের এই অবদানের কথা কখনো অস্বীকার করা যাবে না। ইংরেজ শাসনের ইতিবাচক দিকের এই ছাপাখানা প্রধান একটি। যা হিন্দু-মুসলমান সকলের জন্যই চিন্তাচেতনা প্রকাশে নানা ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল।

গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যই প্রথম বাংলা বই ছাপা শুরু করেন কলকাতার ফেরীস এ- কোম্পানীর প্রেস থেকে। তার আগে তিনি শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনের ছাপাখানায় অক্ষরবিন্যাসের কাজ করতেন। কলকাতা থেকে তাঁর প্রথম ছাপা বাংলা বই ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল, আঠারশো ষোল সালে প্রকাশিত হয়। গঙ্গাকিশোরের ছাপা এই অন্নদামঙ্গলই প্রথম সচিত্র ছাপা বাংলা বই। কয়েকখানি ধাতুখোদাই ও কাঠখোদাই চিত্র ছিল বইখানির মধ্যে। বইয়ের সংখ্যা ও কাটতি বাড়াতে গঙ্গাকিশোর একটি বইয়ের দোকান খোলেন এবং প্রতিনিধি পাঠিয়ে বই বিক্রির ব্যবস্থা করেন।

তারপর আঠারশো আঠারো সালে গঙ্গাকিশোর নিজেই একটি ছাপাখানা করেন বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস নামে এবং সেখান থেকে ‘বাঙাল গেজেটি’ নামে বাংলা সাময়িকপত্র প্রকাশ করেন। গঙ্গাকিশোরের এই ‘বাঙ্গাল গেজেটি’-ই বাঙালী প্রবর্তিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্র বলে ধারণা করা হয়। গঙ্গাকিশোর যেমন প্রথম বাংলা গ্রন্থ ও পত্রিকার প্রকাশক, ঠিক তেমনি পঞ্চানন কর্মকার বাংলা ছাপার হরফের অন্যতম স্রষ্টা বা ছাপাখানার বাংলা হরফ নির্মাতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এঁরা দুজনের কেউই মুন্শী থেকে মহারাজা হননি, বেনিয়ান বা মচ্ছুদ্দিগিরি করে লক্ষপতি বাবু হননি আবার ইংরেজ সাহেবদের মোসাহেবি করে রাতারাতি হঠাৎ জমিদার বা তালুকদার হননি। সেজন্য দুই ব্যক্তির স্মৃতি উৎসব পালন করাতো দূরের কথা তাঁদের নামও লোকে এখন প্রায় ভুলে গেছে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি মধ্য কলকাতা শহরে যতোগুলি ছাপাখানা স্থাপিত হয় এবং যতোগুলি বই ও পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয় তা প্রধানত বাঙালীদের উদ্যোগে। কলকাতা শহরকে বাঙালীরাই প্রধানত গ্রন্থনগরীতে পরিণত করেন। বিনয় ঘোষ মন্তব্য করছেন, শুধু রামমোহন রায় বা দ্বারকানাথ ঠাকুর নন, পঞ্চানন কর্মকার, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য, বিশ্বনাথ দেব, বদন পালিত, মহেন্দ্রলাল মুন্শী হেদাতুল্লাহ, মহম্মদী যন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ দেরাসতুল্লাহ, সোলেমান প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা কাজী সফিউদ্দিন এবং আরো অনেকে বাঙালীর নবজাগরণের অগ্রদূত। বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা শুধু ইংরেজ শিক্ষাব্রতী ও পাদ্রীদের কথা, রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুরের কথা লিখে গেছেন, কিন্তু এই সব স্রষ্টাদের কথা না লিখলে বাঙালীর ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকবে।

বড় বড় প্রাসাদ নয়, বড় বড় কলকারখানা নয়, ছাপাখানাই তখন কলকাতা শহরের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ এবং আধুনিকতার অন্যতম প্রতীক। ধনী বাসিন্দাদের জন্য নয়, চাকুরিজীবী মধ্যবিত্তদের জন্য নয়; মুদ্রাযন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ছাপাখানার অক্ষরবিন্যাসকারী এবং গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রকাশকদের জন্যই প্রধানত কলকাতা শহরের ঐতিহাসিক শ্রেষ্ঠত্ব তখন নির্ধারিত হচ্ছে। ইট পাথর নয়, তারচেয়েও বেশি মুদ্রিত গ্রন্থ দিয়ে কলকাতার ভিৎ গড়া হয়েছে। কলকাতার কলেজ ষ্ট্রীটের কথা বাদ দিলে আজও কলকাতার বড় পরিচয়টি হারিয়ে যায়। কলেজ ষ্ট্রীটের প্রকাশনা শুরু হয় বটতলা থেকে। চলবে