কলকাতার কত রঙ্গ এবং বাবু সংস্কৃতি

পর্ব ১৩

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুলাই ০৭, ২০২১

যদিও উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত পাঠশালা শিক্ষার ব্যাপকতা না থাকতো, স্বভাবতই এই বিপুল সংখ্যক পাঠকদের একই সাথে রচয়িতাদেরও পাওয়া যেত না। বিদ্যাসাগরের মতো সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলায় বটতলার সাহিত্য রচিত হতো না, সহজ বোধগম্য ভাষায় লেখা হতো। চলতি কথোপকথনে ব্যবহৃত শব্দ, কথা প্রবচনগুলির গুরুত্ব ছিল বটতলার রচনায়, বানান লেখা হতো উচ্চারণ অনুযায়ী। বটতলার লেখকরা যখন কবিতা লিখতেন, প্রায়শ পয়ার ছন্দ ব্যবহার করতেন। পয়ার ছন্দে কবিতা শুনতে অভ্যস্ত সাধারণ মানুষ বটতলার চটি বইগুলিকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাতো। বটতলার সাহিত্য সাধারণ নিম্নবর্গের মানুষের পড়বার আকাঙ্ক্ষাকে মেটাতো। রবীন্দ্রনাথ বা তার পরিবারের লোকরা বটতলার সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শিশু বয়সে পড়া বা শোনা সেসব সাহিত্যের প্রশংসাও করেছেন।

ইংরেজ শাসনে শুরুতে পাঠশালা ধ্বংস হতে বসলেও তখনও একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। বাংলার দুই-তৃতীয়াংশ গ্রামে যে পাঠশালা ছিলো বা এ্যাডাম যে পাঠশালা দেখেছিলেন তা মিথ্যা নয়। যদি এই সত্যটি মাথায় রাখা যায় তাহলেই বোঝা যাবে বটতলা সাহিত্য রচিত হবার পর প্রকাশিত পুস্তিকাগুলির ব্যাপক পাঠক কোথা থেকে এলো। যারা একদা তালপাতায় লিখতেন এবং তালপাতার পুথি পড়তে অভ্যস্ত ছিলেন তারা এবার দৃষ্টি ফেরালেন কাগজের ছাপা হরফের দিকে। যারা পাঠশালায় কিছুটা পড়তে শিখেছিলেন ‘বটতলা’র সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে তারা পুরানো বিদ্যাকে ঝালিয়ে নিলেন বা নিজেকে আরো শিক্ষিত করে তুললেন। ভদ্রলোকরা যদিও বটতলা সাহিত্য নিয়ে উন্নাসিকতা দেখিয়েছেন, নাক সিটকিয়েছেন—এমনকি সরকার বা প্রশাসনের প্রচেষ্টায় তা বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন—কিন্তু এটা প্রমাণিত বাংলার দরিদ্র মানুষরা সবাই নিরক্ষর ছিলেন না। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় প্রশ্নটি এসে যায়, এই সাক্ষরতা কোথায় লাভ করলেন তারা? সহজ উত্তর, বাংলার পাঠশালায়।

রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতিতে দেখা যায়, চাকরদের মহলে যে-সকল বই প্রচলিত ছিল তা দিয়েই তার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত। তার মধ্যে চাণক্যশ্লোকের বাংলা অনুবাদ এবং কৃত্তিবাস রামায়ণই প্রধান। এই রামায়ণ ছিল বটতলায় ছাপা। রবীন্দ্রনাথ মায়ের ঘরের বারান্দার এক কোণে গিয়ে দিনের ফুরানো আলোয় প্রায় অন্ধকারে বসে এইসব বই পড়তেন। বটতলার সাহিত্য পড়ার ব্যপারটা উত্তরকালে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করেননি। নিম্নবর্গকে যতোই খাটো চোখে দেখা যাক না কেন, চাকরবাকর মহলের বইপত্র হিসেবে বটতলার অস্তিত্বকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এর ভিন্ন অর্থ দাঁড়ায় চাকর বাকরদের মধ্যেও বই পড়ার মতো লোক ছিল রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায়। এই পড়াশুনা তাঁরা কোথায় শিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, যে-চাকরটি সর্দার তার নাম ব্রজেস্বর। গ্রামের পাঠশালায় সে কিছুদিন গুরুগিরিও করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আরো জানাচ্ছেন, ব্রজেশ্বরেরর কাছে সন্ধেবেলায় দিনের পর দিন ধরে শুনেছিলেন কৃত্তিবাসের সাতকা- রামায়ণটা। সমস্ত রামায়ণের পাঁচালি ছিলো সুর সমেত ব্রজেশ্বরের মুখস্থ। রবীন্দ্রনাথ বটতলা সাহিত্যের একজন পাঠক এবং শ্রোতাও ছিলেন।

নিম্নবর্গের পাঠকদের কাছে বটতলা সাহিত্য মূল্যবান হলেও, ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোকরা বটতলার চটি পুস্তিকাগুলিকে সুনজরে দেখেননি। প্রথমত বটতলার সাহিত্যে কথ্য বাংলার ব্যবহার এবং দেশজ আরবি ইত্যাদি শব্দের আধিক্য, সংস্কৃতভাষা অনুরাগীদের ক্ষোভের কারণ হয়েছিল। দ্বিতীয় কারণ ছিল, বটতলার সাহিত্যের কবিরা হিন্দু দেবদেবীদের পুতপবিত্র না রেখে রক্তমাংসের মানুষের স্তরে নামিয়ে এনেছিল। ভদ্রলোকদের ক্ষোভের সবচেয়ে বড় কারণটি ছিল, বটতলায় ছাপা প্রহসনে নতুন গজিয়ে ওঠা বাঙালী ভদ্রলোকদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হতো। লম্পট মদ্যপ বাবু, ঘুষখোর কমকর্তা, বাবুদের মোসাহেব ও ভ-ধার্মিকদের নানা বজ্জাতি বটতলার প্রহসনে স্থান পেত। বটতলার সাহিত্যে ‘কোকশাস্ত্র’ ‘রসমঞ্জরী’ জাতীয় গ্রন্থ থেকে শুরু করে প্রহসনে বেশ্যা নায়িকা, লম্পট বাবু, ভণ্ড পুরোহিত চরিত্রের ছড়াছড়ি থাকায় ভদ্রসমাজে তা সম্পূর্ণ ‘অশ্লীল বলে বিবেচনা করলেও বাঙালী নিম্নবর্গ বা গ্রামীণ জনসাধারণের কাছে তা খুবই মামুলী ক্রিয়কিলাপ বলে গণ্য ছিল।

সন্দেহ নেই, নানা ধরনের ভ্রষ্টাচার ও ব্যাভিচারের বর্ণনায় বটতলার কতিপয় লেখক পাঠকদের যৌন সুড়সুড় দিয়ে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করতো। কিন্তু কী করে অস্বীকার করা যাবে, লিখতে পড়তে না জানলে নিম্নবর্গের লোকদেন পক্ষে ঐসব গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব ছিল। সমস্ত অশ্লীলতা ছাপিয়ে বটতলার সাহিত্যে ধর্মের নামে নারী ধর্ষণ, টাকার প্রলোভন দেখিয়ে পরস্ত্রী ফুসলানো এবং সরকারি কর্মকর্তা-পুলিশ মোক্তারদের অত্যাচারের কাহিনি বিবৃত হতো। বটতলার রচনায় ভ্রষ্টাচার ও ব্যাভিচারের প্রহসন সে যুগের বাস্তবতারই প্রতিফলন। সেটাকে ভদ্রলোকরা অশ্লীল বলে উড়িয়ে দিলেও পাঠশালার শিক্ষা ব্যবস্থাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বাংলার নব্য বাবু বা ‘ইংয় বেঙ্গল’দের কটাক্ষ করে লেখা ‘ইয়ং বেঙ্গল ক্ষুদ্র নবাব’ চমৎকার একটি রচনা। এছাড়াও মহেশচন্দ্র দাস দে রচিত ‘নেশাখুরি কি ঝকমারি’, ‘চোরের উপর বাটপারি’, মুন্সী নামদার রচিত ‘কলির বউ ঘর ভাঙ্গানী’, রামকৃষ্ণ সেন রচিত ‘বৃদ্ধা-বেশ্যা তপস্বিনী, নন্দলাল দত্ত রচিত ‘লুক্য়ে পিরীত্ কি লাঞ্ছনা’, প্যারিমোহন সেন রচিত ‘রাঁড় ভাঁড় মিথ্যা কথা তিন লয়ে কলিকাতা’, মুন্সী আজিমদ্দীন রচিত ‘কি মজার কলের গাড়ি’, চন্দ্রকান্ত শিকদার রচিত ‘কি মজার শনিবার’, শ্যামাচরণ সান্যাল রচিত ‘হদ্দ মজা রবিবার’, মাদারদ্রুম ন্যায়পঞ্চানন রচিত ‘লম্পট দমন’, প্রিয়শঙ্কর ঘোষ রচিত ‘সুরাপান কি ভয়ঙ্কর’, জগচ্চন্দ্র গুহ রচিত ‘রাড়ের বিয়ে ডিস্মিস্’, যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ রচিত ‘মোহন্তের এই কি দশা’, অখিলচন্দ্র দত্ত রচিত ‘সোণাগাজির খুন’, কালীকুমার মুখোপাধ্যায় রচিত ‘বাপ্রে-কলি’; এরকম শতশত বইয়ের নাম করা যাবে যা বাবুদের সংস্কৃতিকে কটাক্ষ করে লেখা হয়েছিল।

বটতলায় প্রকাশিত বইগুলির দাম ছিল খুব কম। এক আনা ছয় পয়সা থেকে বড় জোর এক টাকা দু টাকার মধ্যে। বইগুলি শুধু কলকাতা শহরে নয়, কলকাতার বাইরে বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে বিক্রি হতো। বটতলার গ্রন্থকে কেন্দ্র করেই প্রথম বই ফেরি করে বিক্রি শুরু হয়। বটতলার বইয়ের ফেরিওয়ালারা পুস্তিকাসমূহ মাথায় চাপিয়ে, কেউ বা কাঁধের ঝুলিতে ভরে কলকাতার পথে-বিপথে বিক্রি করতো। কলকাতায় বিক্রি করা শেষ হলে পর শহরের আশেপাশে, তারপর গ্রামে-পাড়াগাঁয়ে বিক্রি করতে চলে যেতো। সাধারণত শীতের সময় বই ফেরি করতেন তাঁরা, বর্ষাকালে আবার চাষাবাদে লেগে যেতেন। বটতলা থেকে শুধু সস্তা রঙ্গ-প্রহসনের বই বের হতো না, ছোট ছেলেমেয়েদের বাংলা বানান ও ব্যকরণ বা অঙ্ক শোখানোর কিংবা নীতিবিদ্যা শেখানোর বইও বটতলায় প্রকাশিত হতো। খনার বচন থেকে শুরু করে সংসার ও সামাজিক জীবনে মানুষের করণীয় এবং জমিজমা, দলিল-দস্তবেজ সম্পকিত মূল্যবান গ্রন্থও প্রকাশিত হতো। ফলে বটতলার রচিয়তাদের সবাইকে খুব অশিক্ষিত ভাবারও সুযোগ নেই। চলবে