আল মাহমুদ

আল মাহমুদ

কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

পর্ব ২৫

প্রকাশিত : জুলাই ২৯, ২০২৫

আম্মা যত চেষ্টাই করুন, আব্বার পক্ষে ভালো ভালো কথা বলুন, আমি কিন্তু মনে মনে আব্বাকে অভিশাপ দিতাম। আমাদের সংসারের যাবতীয় কষ্টের জন্য আব্বা একাই দায়ী, এইরকম একটি ধারণা আমার হয়েছিল। এর একটি বড় কারণ হলো, আমার নানা ও মামারা আব্বার দুই হাতে টাকা ব্যয় করার বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না, তারা সবসময় আব্বাকে বকাঝকা করতেন। তাদের এইসব বকাঝকা শুনে শুনে আব্বার প্রতি আমার নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল।

বাড়ি বিক্রি করা এবং একের পর এক পাওনাদার এসে বাসায় হাজির হওয়া, এইসব কারণে আমি খুব ভেঙে পড়ছিলাম, মনে হচ্ছিল আমাদের সংসারটা মূলোৎপাটিত জলে ভাসা খড়কুটো হয়ে ভেসে চলেছে, ভাসতে ভাসতে কোথায় গিয়ে যে ঠেকবে কে জানে। চোখের সামনে অনিশ্চয়তার এক অকূল সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেতাম না। এবং আমি মনে করতাম এর সকল দায় আব্বার একার, আর কারো নয়।

আব্বা কখনোই মামাদের কোনো উপদেশ ও পরামর্শ শুনতেন না। যে কারণে আমাদের দুর্দিনে রাগ কিংবা অভিমান করে মামারা কেউ এগিয়ে আসেননি। আম্মা আমার নানাকে, বড় মামাকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে বলেছেন, তারা যেন আমাদের বাড়িটা ফেরত এনে দেন, যেন নানার নামেই রেজিস্ট্রি করেন, কিন্তু তারা আম্মার কথায় কর্ণপাত করেন নাই।

এখন মনে হয় প্রকৃতির একটা নিজস্ব পরিকল্পনা আছে, সে প্রতিটি প্রাণীর জন্য একটি জীবন-প্রণালী ঠিক করে রাখে। আমাকে তৈরি করেছে লেখক হবার জন্য। একজন লেখক যদি জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে না যায়, দুঃখ-কষ্টের অনুভূতি উপলব্ধি না করে, তাহলে পূর্ণাঙ্গ লেখক হবে কী করে? ধার করা অনুভূতি দিয়ে কী আর ভালো সাহিত্য হয়?

২০০৩ সালের মে-জুন মাসে কবি আল মাহমুদ প্রথম আমার বাড়িতে আসেন। নিকেতনে আমার নিজের কেনা ফ্লাট, গোছানো, আধুনিক এবং শিল্পসম্মত সাজ-সজ্জায় সজ্জিত। সেই সময়ে চেনা-জানাদের অনেকেই আমাদের ফ্লাট দেখতে আসতেন। কেউ কেউ নাটকের শ্যুটিং করতেও এসেছেন। মাহমুদ ভাইও মুগ্ধ হয়ে দেখেন। এরপরে তিনি বহুবার এসেছেন। একদিন কথায় কথায় বলেন, কবিদের সব ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। তোমার একটা অভিজ্ঞতার অভাব আছে।

আমি বলি, কী সেটা?
দারিদ্র। দারিদ্রের ভেতর দিয়ে যাওয়ার যে অভিজ্ঞতা সেটা একজন লেখকের থাকা খুব দরকার।

এরপর তিনি নিজের জীবনের অর্থকষ্টের দিনগুলোর কথা বলেন। গোলাপফুল আঁকা টিনের বাকসো বগলে নিয়ে ১৯৫৫ সালে এক জোড়া রাবারের স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে এসে নামা ১৯ বছরের তরুণ মীর আব্দুস শুকুর কীভাবে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে কবি আল মাহমুদ হয়ে উঠল, কী পরিমান অপমান ও লাঞ্ছনা তাকে সহ্য করতে হয় এই ঢাকা শহরে টিকে থাকার জন্য, সেইসব গল্প বলেন।

আমি বলি, মাহমুদ ভাই, আমার জীবনেও এরকম গল্প আছে। আজ আপনি যে জহিরকে দেখছেন সেই জহির একদিনে তৈরি হয়নি। আমাকেও অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখানে আসতে হয়েছে।

রাখো মিয়া তোমার গল্প। তুমি আর কী দারিদ্র দেখেছ?
মাহমুদ ভাই কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন না। তার সামনে বসে থাকা পঁয়ত্রিশ বছরের এই সুদর্শন, সুশিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত যুবক কখন আবার দারিদ্র্য কবলিত হলো?

আমিও তাকে আমার জীবনের গল্প বলিনি। কেন বলিনি তারও একটি ঘটনা আছে। আমি কিন্তু কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেই তাকে আমার জীবনের করুণ কাহিনি শোনাতাম। একদিন আমার এক জ্যেষ্ঠ বন্ধু, ব্রাকের মোজাম্মেল হক, যিনি এখন ডালাসে থাকেন, আমাকে বলেন, তোমাকে একটা কথা বলি, কমবেশি সবার জীবনেই কিছু কষ্টের ঘটনা আছে। তুমি নিজের কষ্টের গল্প কাউকে বলবে না। এতে তোমার কোনো উপকার হবে না, বরং মানুষ তোমার দুর্বলতাগুলো জেনে যাবে এবং সুযোগমতো এই অস্ত্র দিয়েই তোমাকে ঘায়েল করবে।

মোজাম্মেল ভাইয়ের এই উপদেশ আমি শুনেছি। বলা যায়, এরপর থেকে নিজের দুঃখ-কষ্ট আর কাউকে বলি না। কিন্তু আজ যখন আত্মজীবনী লিখতে বসেছি, কোথাও একটুও ফাঁকি দিতে চাই না, ভালো-মন্দ, সফলতা-ব্যর্থতা সবই বলতে চাই, যাতে আমাকে যারা চিনতে চান তারা যেন পুরোপুরিই চিনতে পারেন।

নভেম্বরের এক বিকেল। সূর্য হেলে পড়েছে। প্রতিদিনের রুটিন মত গিয়ে হাজির হই আমিনুল হক আনওয়ারের বাসায়। তিনি আমার শার্টের কলার টেনেটুনে দেখেন। অন্য দিনের চেয়ে একটু ভালো করে আমার জামা-কাপড়ের দিকে তাকান। আমি বলি, বিষয় কী?

তিনি বলেন, বিষয় খুবই গুরুতর। আজ তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। ধনী মানুষের বাড়ি। তাই একটু ভালো করে দেখে নিচ্ছি পোশাক-আশাক ঠিক আছে কিনা।

কোথায় যাব? কার বাসায়?
সেটা তো এখন বলা যাবে না। আগে বলো পকেটে বিশটা টাকা আছে কিনা?
না, নেই।
কত আছে?
দশ টাকা।
হবে। শেয়ারে রিকশা নেব।
আমরাই তো দুজন, আবার শেয়ারে রিকশা নেব কার সঙ্গে?
ডাক্তার জিয়াও যাবেন।
নিজেরা নিজেরা শেয়ার?
হ্যাঁ, তুমি আর ডাক্তার জিয়া রিকশা ভাড়া শেয়ার করবা, আমি ফ্রি।

আমি হাসি।
এক রিকশায় তিনজন চড়ে বনানী যাই। কবি খোশনূর আলমগীরের বাসায়। খোশনূর আপা অমায়িক একজন মানুষ। তিনি আমাদের সঙ্গে এত আন্তরিকভাবে আড্ডা দেন, গল্প করেন, তাদের সঙ্গে আমাদের, গুলশান লেইকের এপার-ওপারের মানুষের মধ্যে যে একটা বিরাট শ্রেণি-বিভাজন আছে তা এক মুহূর্তের জন্যও টের পাইনি। এক ফাঁকে, একটু সময়ের জন্য, রূপালী পর্দার মানুষটিকেও দেখে ফেলি। দোতলা থেকে নেমে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। আলমগীর বের হবার সময় খোশনূর আপার মধ্যে কিছুটা চাঞ্চল্য দেখি, তিনি দরোজার কাছে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বলেন, ড্রাইভার, গাড়ি বের করো, সাহেব বেরুচ্ছেন।

ব্যাস, এরপরে ফিরে এসে আমাদের সঙ্গে আবার আড্ডা। একটু নতুন সাহিত্য সংগঠন গড়ে তোলা হচ্ছে, সেই বিষয়েই আলাপ-আলোচনা। সংগঠনটির নাম অনুপ্রাস। নামটি প্রস্তাব করেন কবি জাহাঙ্গীর হাবীব উল্লাহ। খোশনূর আপার ডাক নাম অনু, যেহেতু অনু দিয়ে সংগঠনের নাম অনুপ্রাস, সবাই তা সানন্দে গ্রহণ করেন। আসলে অনু আপাকে ঘিরেই তারা কিছু একটা করতে চাইছিলেন। সংগঠনের সভাপতি হন খোশনূর আলমগীর, মহাসচিব কাজী সালাহউদ্দিন, সহ-সভাপতি হন জাহাঙ্গীর হাবীব উল্লাহ। পরে এই সংগঠনটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, প্রচুর শাখা-প্রশাখা হয়।

প্রথম দিনই অনু আপার সঙ্গে বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। তিনি ফোন নাম্বার দিয়ে বলেন, যে কোনো সময় ফোন করে চলে আসবে। এরপরে সপ্তাহে অন্তত একদিন তো বনানীর এই বাড়িটিতে যেতামই।

অনেক দিন আমার খালাতো ভাই কনকের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। কনক ছিল নায়ক আলমগীরের ভীষণ ভক্ত। একদিন আমাদের বাসায় এলে ওকে আমি অনু আপার কথা বলি। কনক রীতিমতো পাগল হয়ে যায় ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য। আলমগীরকে তার কাছে থেকে দেখতেই হবে।

কনককে কবি জসীম উদদীন পরিষদের সঙ্গে যুক্ত করি। ও খুব ভালো সংগঠক ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই ও জসীম উদদীন পরিষদের ডেমরা শাখা করে ফেলে। ওরা থাকত মাদারটেকের পেছনে দক্ষিণ গাও এলাকায়। যেটি ডেমরা থানাধীন ছিল। নির্মল রায় নামের এক ছোটখাটো গড়নের মানুষ, কবিতা লিখতেন, তাকে সভাপতি করে একটি কমিটি বানিয়ে নিয়ে আসে। সেই কমিটির সবাই, প্রায় ১৫/১৬ জন, বাড্ডায় আমাদের সাহিত্য সভায় চলে আসত। কেন্দ্রীয় কমিটির সবাই খুব খুশি হত। জসীম উদদীন পরিষদের সভাগুলো ক্রমশ আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠছিল ওদের উপস্থিতিতে। চলবে