কাজী নাসির মামুনের দীর্ঘকবিতা ‘আব্বা, আব্বা গো’

প্রকাশিত : মে ৩০, ২০২০

মানুষ বেঁচে থাকে শৈশবের স্মৃতি নিয়ে। বলতে কি, শৈশবেই মানুষ প্রকৃত জীবনকে যাপন করে। এরপর সে যখন বড় হয়ে যায়, সমাজ, রাষ্ট্র ও জ্ঞানের নিগঢ়ে সে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে। যাপন করতে বাধ্য হয় এমন এক জীবন যা সে যাপন করতে চায় না। শৈশবে যে মানুষগুলো তাকে স্নেহের লতাপাতায় জড়িয়ে রাখতো, তাদের সঙ্গে মানুষের তৈরি হয় হৃদয়ের ঋণ। জগতে সব ঋণ শোধ করা যায়, হৃদয়ের ঋণ কোনোদিনই শোধ করা যায় না। কবি কাজী নাসির মামুন শৈশব নিঙড়ে তুলে এনেছেন এমনই একটি মানুষকে যিনি তার জনক। এই জনক এখন প্রকৃতির নিয়মে বৃদ্ধ। বসে বসে স্মৃতি রোহমন্থন ছাড়া আর কোনো কাজ তার নেই। উদাস চোখে চেয়ে আছেন জীবন-মৃত্যুর ওপাড়ে। জনকের এই অবস্থা গভীর সহানুভূতির সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন কবি। আর তার ভেতর ছবির মতো ফুটে উঠছে ফেলে আসা দিনের টুকরো টুকরো ছবি। এইসব ছবিই তিনি নিপুণ দ্ক্ষতায় এঁকেছেন ‘আব্বা, আব্বা গো’ কবিতায়। আবু তাহের সরফরাজ

কখনো ফোঁড়ার চারপাশে
আঙুল ঘোরালে সুখ হয়।
ভেতরে প্রবিষ্ট পাখি
গান ফেলে চলে গেলে দহন বেলায়
মানুষ নিজের জন্য
           বিকল্প আমোদ খুঁজে নেয়।
তখন জীবনজুড়ে না-ফেরা পাখির
আপ্লুত সঙ্গীত ছায়া ফেলে।
এই যে আমার চারপাশে
অনেক কথার ঝোপঝাড়
পতঙ্গ-পড়শীদের সঙ্গে নিয়ে

           জেগে আছে গুমোট সবুজ
সবাই আমার সঙ্গ-সুরারোপ।
গ্রন্থের নির্জনে এক গানের আকাশ
লিখবো বলেই বসে আছি।

সুদীর্ঘ সত্যের মতো আমার আব্বাকে
এভাবে বসতে দেখি নিটোল চেয়ারে একা একা।
একটা অসহ্য অবসর তার চারপাশে
           কর্তৃত্ব ফলায় সারাদিন; তবু
বসে থাকা ছাড়া
অন্য কোনো আকুল চাহিদা তাকে
           ডাকে না এখন।
সততার মঞ্চে
সূর্যের ভূমিকা ছিল তার।
ওইটুকু মথিত আলোয়
নিজের ছায়াকে আমি কীভাবে দেখছি?
অন্তিম সময় এলে হারিয়ে যাবার
ছায়া খুব দীর্ঘ হয়, ছায়া
           হ্রস্ব হতে হতে
একদিন নৈঃশব্দ্যে মিলায়।
ঝিনুক-প্রদাহ নিয়ে সুদীর্ঘ মুক্তোর
আলোয় আব্বাও হ্রস্ব হতে চলেছেন।
আমাদের প্রফুল্ল সংসার, মুগ্ধ পরিবারে
উদ্বৃত্ত সম্পদ রাখি যতটা মায়ায়
সেরকম রেখেছি তাকেও।
তবু আব্বা, আব্বা গো, কতটা স্থূল উপাচার
নিজের জীবনে নিয়ে আমরা ভাবছি:
যে-সম্পদ কার্যকর নাই
ব্যবহারে ফলে না নতুন
কেউ এসে নিয়ে যাক তাকে।
কাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর দাবানল
আমরা কখনো চেয়ে আনি।
আব্বা কি পুরনো ছাতা? দূরের কোটরে রেখে
           ভাবা যায় স্মৃতির কাপড়?

একদিন পেয়ারা পাতায়
থর থর জিজ্ঞাসা কম্পন তুলে দিলে
আব্বার জীবনে পাকা ফল হয়ে বসে থাকি।
           নিজেকে দারুণ মিঠা লাগে।
আব্বা,
আপনি কি বিচ্ছিন্ন বিবরে বসে
অন্তিম সময় গিলছেন একা একা?
সূর্যাস্ত আটকে আছে নিজের গলায়?
যখন সমূহ টানে উগরে দেবেন
একটা বিমোহ ভরা পুরনো আকাশ
দিগন্তের নীল অধিপতি
আমার শৈশব ফেলে দেবে?
আমি কি কুড়িয়ে নেব ঘুমন্ত নাটাই?

কখনো গোঁয়ার ঘুড্ডিটাকে
আকাশ ছোঁয়াতে পারি নাই।
মনে হতো সৌর জানালায় উঁকি দিয়ে
আগুন দেখেছে বলে
একটা উড়ন্ত চিল তীব্র ঠোঁটে নেমে
           আসছে মাটিতে।
রক্তময় ধারালো ঠোকর
ভেঙে দেবে সংগোপন স্বপ্নের জগৎ।
আমি চাইতাম আবার উড়ুক।
আর খুব দৌড়াতে দৌড়াতে
প্রবল একটা নিঃস্ব গাছের নাগালে
নিজেকে পেতাম একা; ভর দুপুরের
বিষণ্ণ ভয়ের কলাপাতা
আমার বুকের মধ্যে কাঁপতে থাকতো।
বলতো: ওই যে, দেখ,
ভূতের বিজন মেয়ে তোকেই ডাকছে।
আমি ফের উল্টো পথে দৌড়াতে দৌড়াতে
কত নালা, কত বিল, গাছের খোঁড়ল
পাখির নিভৃতি ছুঁয়ে থাকা
নীরব বাতাস পার হয়ে
লজ্জাবতী পাতার স্পর্শকে
           ডিঙাতে ডিঙাতে
ব্যাঙের উদরে জমা সমস্ত নিঃশ্বাস
নিজের ভিতরে নিয়ে শুধু হাঁপাতাম।
দেখতাম, প্রশস্ত উঠোনে
আমার ঘুড্ডিটা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
কাগুজে শরীর থেকে ছিটকে পড়ছে
ছিন্ন ভিন্ন নীল আসমান।

আব্বা প্রতিদিন
আমাকে একটা ঘুড্ডি বানিয়ে দিতেন।
তাঁর সহ্য-সীমানায় হেঁটে হেঁটে
           আমার কেবলই মনে হতো
দারুণ আরামপ্রদ আমি এক লালিত বাতাস।
এখনো জঠরে আছি; জঠর একটা
দূর্গ; জ্যান্ত জীবনের আশপাশে
আব্বাই পাহারাদার; স্নেহ শাসনের বর্শা হাতে
মানুষ নামের এক মহৎ পৌরুষ।
আমার আকাঙ্ক্ষাগুলো
           জড়িয়ে ধরেই বোঝাতেন,
হৃদয় খোদাই করে কীভাবে একাগ্র হয়
           পিতার জীবন এক শিশুর শৈশবে।

সেই যে, নাটাই হাতে দৌড়াতে দৌড়াতে
অনন্য ঘুড্ডির এক জীবন আমার
আমার জীবনে কেউ
আকাশ এলো না আব্বা ছাড়া।
উন্মুক্ত রোদের ঝিকিমিকি
ঝলসানো পাতারসহস্র ফিসফিস
মর্মের আগুনগুলো ছিটিয়ে ছিটিয়ে
বলছে, ধ্বনিত মৃত্যু সরে যাও!
বলছে: রাব্বির হাম হুমা
           কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা।
আজ এই ধুলো কবলিত
           পথের সত্যকে
আজান ধ্বনিত হলে আমি বুঝে ফেলি।
বুঝে ফেলি, আব্বার বুকটা মসজিদ।
আব্বার দু`হাতে
অতল স্নিগ্ধতা মোনাজাতময়; তসবির
           ঝরঝর বৃষ্টি আমাকে ভেজায়।
জলের অক্ষরে আজ আব্বাকে লিখছি।