কাজী মোতাহার হোসেনের প্রবন্ধ ‘ভুলের মূল্য’

প্রকাশিত : জুলাই ৩০, ২০২১

শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেনের আজ জন্মদিন। ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে মামাবাড়িতে তার জন্ম। পৈত্রিক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার গোয়ালন্দ মহকুমাধীন পাংশা থানার বাগমারা গ্রামে। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা প্রবন্ধ ‘ভুলের মূল্য’ প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

চিন্তা-ভাবনা এবং কার্যকলাপে ভুল করা মানুষের পক্ষে শুধু যে স্বাভাবিক তাই নয়, অপরিহার্যও বটে। স্বাভাবিক এই জন্যে যে, মানুষ বড় দুর্বল। সর্বদা নানা ঘটনা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে সংগ্রামে জয়ী হতে পারে না। অপরিহার্য এইজন্য যে, তার জ্ঞান অতি সংকীর্ণ। কোনটি ভুল, কোনটি নির্ভুল তা নির্ধারণ করাই অনেক সময় কঠিন, এমনকি অসম্ভব হয়ে পড়ে। এখানে কেবল যে দুর্বলচেতা ও স্বল্পজ্ঞান মানুষের কথা বলছি, তা নয়। এ মন্তব্য সবল-দুর্বল এবং অজ্ঞ-বিজ্ঞ নির্বিশেষে সকলের পক্ষেই খাটে।

প্রতারক, দস্যু, মাতাল, ঘোড়দৌড়ের খেলোয়ার প্রত্যেকেই জানে যে, তার কাজ ঠিক হচ্ছে না। সে ভুল পথে চলছে। কিন্তু সে পথ হতে ফিরবার ক্ষমতা তার কোথায়? তার বিবেক হয়ত দংশন করছে, কিন্তু প্রবৃত্তি বশ মানছে না। এইরূপে ক্রমে ক্রমে বিবেক-বুদ্ধিই শিথিল অথবা শক্তিহীন হয়ে যাচ্ছে। অন্য কথায়, সে নিজের কাজের সমর্থক যুক্তি বের করে বিবেকের উগ্রতাকে প্রশমিত করে নিচ্ছে। প্রবৃত্তির হাতে বিবেকের এই নিগ্রহই মানুষের দুর্বলতার প্রধান পরিচয়। তাছাড়া মানুষ এমন সব ঘটনার ঘূর্ণিপাকে পড়ে যায় যে, তাকে বাধ্য হয়ে খেলার পুতুলের মতো নিরুপায়ভাবে একটার পর আর একটা ভুল করে যেতে হয়। একটা ভুল ঢাকতে গিয়ে আরো দশটার আশ্রয় নিতে হয়।

মানুষ বড় জটিল জীব। তাকে দশ দিক বজায় রেখে কাজ করতে হয়। আবার পৃথিবীও এমন ঠাঁই যে, অনেক সময় এক কূল বজায় রাখতে গেলে আর-এক কূলে ভাঙন লাগে। জীবনে এইগুলোই সবচেয়ে বড় সমস্যা, এইখানেই ভুল হয় বেশি। আবার এইখানেই মানুষের বিশেষত্বও ওটে উঠে অপূর্বভাবে। এইরূপ নানা বিচিত্র ঘটনাবর্তের ভেতর দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা দিতে দিতে যেতে হয় বলেই তার শ্রেষ্ঠত্ব, আর এই আত্ম-বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলবার মধ্যেই তার সৌন্দর্যের বিকাশ এবং যোগ্যতার পরিচয়।

পূর্বেই বলেছি, মানুষের জ্ঞান অতি সংকীর্ণ। ক্রমান্বয়ে নতুন নতুন জ্ঞানভাণ্ডার খুলে যাচ্ছে আর পুরনো জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা চোখে পড়ছে। ইতিহাস, বিজ্ঞান, কাব্য, দর্শন, রাজনীতি, ধর্মনীতি, ব্যবহারিক জ্ঞান, কলাবিদ্যা প্রভৃতি সমুদয় ক্ষেত্রেই এর এত অধিক দৃষ্টান্ত বিদ্যমান যে, তার উদাহরণ দেয়া বাহুল্য মাত্র। এর থেকে বোঝা যায়, আজ যেটি সত্য এবং নির্ভুল মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে সেটি হয়ত মিথ্যা অথবা আংশিক সত্য বলে প্রমাণিত হতে পারে। এজন্য আমরা আজকাল যে আদর্শ ধরে চলছি তা নিয়ে অতিরিক্ত উল্লাসের সাথে আস্ফালন করতে পারিনে, যেহেতু আমাদের আজকার উদ্ধত অহংকার কালকার দীন বা লজ্জায় পরিণত হতে পারে।

মানুষের প্রকৃত যে জ্ঞান তা ইন্দ্রিয়ের দ্বার দিয়ে অর্থাৎ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই আসে। শিশুকে আগুনের শিখা, ছুরির ধার, মরিচের ঝাল, এসব থেকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। যদি তা পারা যেত  তবে বোধ হয় সে চিরকাল শিশুই থাকত। শিশুর পক্ষে যা পরিণত মানুষের পক্ষেও কতকটা তাই সত্য। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের যেখানে অভাব সেখানে সমস্ত জ্ঞানই অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। যে কোনদিন পথ ভোলার কষ্ট ভোগ করে নাই, সে কখনো ঠিক পথে চলার আনন্দ উপভোগ করতে পারে না; যে কোন দিন পানিতে পড়ে হাবুডুবু না খেয়েছে, সে কখনো নিরাপদে নৌকা চড়ারসুখ ভাল করে বুঝতে পারে না।

মানুষ ভুল করে শেখে, পরে সে ভুল সংশোধন করেই সত্যের সন্ধান পায়। সাধারণের ধারণা `ঠেকে শেখার চেয়ে দেখে শেখাই` বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু `অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি` বলেও একটা কথা আছে। নিরুদ্বেগ আপদহীনতার ভেতরেই অনেক সময় বিপদের বীজ প্রচ্ছন্ন থাকে। আসল কথা , জীবনের অভিজ্ঞতা ও গভীর অনুভূতিলব্ধ যে জ্ঞান ও শিক্ষা, বাস্তবিকই তার তুলনা নাই। স্বল্প পরিসর টবের ভেতর জীবন ধারণ করার চেয়ে বাইরের বিস্তৃতির ভেতরে আনন্দে বিকশিত হওয়া অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। তবে অন্যের দুর্দশা দেখেও অবশ্যই শিক্ষা লাভ করতে হবে। কারণ একজনের পক্ষে সকল রকম অভিজ্ঞতা লাভ করা অসম্ভব। আমাদের এই বর্তমান কোটি কোটি অভিজ্ঞতারই ফল। সুতরাং জীবন-যাত্রায় অন্যের অভিজ্ঞতারও যে প্রয়োজন আছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। অন্যের নিকট থেকে পাওয়া অসম্পূর্ণ বা অপরীক্ষিত জ্ঞানকে নিজের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচাই করে নিজস্ব করে নিতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিপুষ্ট জীবনের এই-ই ধারা।

মানুষ এইরকম ভুলের ওপর চরণ ফেলে ফেলে সত্যকে খুঁজে পাচ্ছে এবং এভাবেই ক্রমশ অগ্রসর হয়ে চলছে। ভুল না করলে যেন সত্যের প্রকৃত রূপ ধরা পড়ে না। এ যেন আলো-আধাঁরের লুকোচুরি খেলা। যেমন একটি ফুলকে নানাভাবে চারদিক থেকে দেখলে তার নতুন নতুন সৌন্দর্য চোখে পড়ে। এইরূপ সত্যকেও নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে নানাভাবে পরখ করে দেখতে হয়। তবেই তার সমগ্র রূপ ধরা পড়ে। কোন বৃহৎ সত্যই এ পর্যন্ত সমগ্রভাবে আমাদের কাছে ধরা পড়েছে কিনা সন্দেহ। তবে যে সত্যের যতবেশি ব্যাতিক্রম আমাদের চোখে ধরা পড়েছে, তা আমরা ততই ভাল করে বুঝতে পেরেছি।

দুঃখ যত প্রবলভাবে মানুষের মনে আঘাত করে, সুখ ততটা করে না। সুখকে কোন কোন লোকে যত নিস্পৃহভাবে গ্রহণ করতে পারে, চেষ্টা করলেও দুঃখকে তত সহজে মনের গোপনে লুকিয়ে রাখতে পারে না। এজন্য জীবনে দুঃখের মূল্য বড় বেশি। আগে দুঃখ পেতে হবে, তবেই সমস্ত অনুভূতি সজাগ ও তীক্ষ্ম হবে। ভুল করে যে দুঃখ পায়, তাহার ভুল করা সার্থক। আর ভুল করলেও যে নির্বিকার, আত্মবিচার যার নাই, তার কাছে সত্য-মিথ্যা, পাপ-পুন্য, অর্থশূন্য শব্দ ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যাক্তিগত জীবনে ভুলের সবচেয়ে বড় সার্থকতা এখানে যে, ভুল মানুষকে দুঃখ ও অনুশোচনার আগুনে পুড়িয়ে তাকে শুদ্ধ করে তোলে এবং মনুষ্যত্ব-সাধনের দিকে অনেক দূর অগ্রসর করে দেয়।

এ কথা শুনতে অদ্ভুত লাগে বটে, কিন্তু এটি সত্য। ভুলের মত একটা সাধারণ ব্যাপার, যা অহরহ ঘটছে তাই আবার মানুষের এতখানি কাজে লাগে, এটি বিশ্বের পক্ষে সামান্য সৌভাগ্যের বিষয় নহে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সত্যোদঘাটনের প্রচেষ্টার চেয়েও বোধ হয় ভুলের এই কার্যকারিতা বেশি কল্যাণপ্রসু হয়েছে। বাস্তবিক ভুল আছে বলেই পৃথিবীটা এত সুন্দর। ভুল না থাকলে পৃথিবীর দয়া মায়া ক্ষমা ভালবাসা প্রভৃতি কোমল গুণগুলির এত অবকাশ ও বিকাশ হত কিনা সন্দেহ। তাছাড়া ভুল না থাকলে এত দিন মানুষের সমস্ত প্রচেষ্টা এবং অগ্রগতি কবে রুদ্ধ হয়ে সমস্ত অসাড় হয়ে যেত। এখানেই ভুলের মূল্য।