কান্টের দর্শন, নন্দনতত্ত্ব ও কবিতা

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৬, ২০২১

জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের দর্শনের ভিত্তিমূলে আছে ট্রান্সেন্ডেন্টাল আইডিয়ালিজম। বাংলায় যাকে সজ্ঞালব্ধ (অতীন্দ্রিয়) ভাবাদর্শ বলা যাইতে পারে। এই ভাবাদর্শকে ভিত্তি  করে পরে আরেক জার্মান ভাবাদর্শের হেভিওয়েট দার্শনিক হেগেল তার বিখ্যাত ‘ফেমেনেলজি অব স্পিরিট’ বইতে এইটাকে নতুন মাত্রা দেন। ট্রান্সেন্ডেন্টাল ভাবাদর্শ মন ও বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে একটি তত্ত্ব। তিনটি মৌলিক থিসিস এই তত্ত্বটি তৈরি করে।

প্রথমত. আমাদের চারপাশে বস্তুর হাজির থাকা অবস্থায় আমরা বস্তুটিকে যেমন করে দেখি তেমনি করে বস্তুর নিজেদের মধ্যে বস্তু হিসাবে থাকাটাকে আমরা বুঝতে পারি না। দ্বিতীয়ত. স্থান ও কালের ধারণা আমাদের অভিজ্ঞতায় আগে থেকেই থাকে বলে a priori বস্তুর বাইরে হাজির থাকাটাকেই দেখি, বস্তুর নিজ থেকে হাজির থাকাটাকে জানি না। তৃতীয়ত. আমরা কেবলমাত্র সেই বস্তুগুলিকে অনুভব করতে পারি যেগুলির সম্পর্কে আমরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানতে পারি। অতএব তাদের এসেন্সকে জানতে পারি না।

কান্টের এই ভাবাদর্শ আমাদের দুইটা বোঝাপড়ার মধ্যে পার্থক্যকরণের কথা বলে। এক. আমরা যা অনুভব করতে পারি যেমন প্রাকৃতিক, পর্যবেক্ষণযোগ্য পৃথিবী এবং দুই. আমরা যা অনুভব করতে পারি না যেমন: গড ও আত্মার মতো অতিপ্রাকৃত বস্তুর। কান্ট যুক্তি দেন যে, আমরা কেবলমাত্র সেই জিনিসগুলি জ্ঞানে ধরতে পারি যা আমরা কেবল অনুভব করতে পারি। সেইভাবে যদি প্রশ্ন করা হয়, আমি কী জানতে পারি? কান্ট তার উত্তরে বলবেন, আমরা কেবল প্রাকৃতিক ও পর্যবেক্ষণযোগ্য বিশ্বকে জানতে পারি, কিন্তু বাইরের জগতের (মেটাফিজিক্স) অনেক গভীর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না।

কান্টের নীতিশাস্ত্র ক্যাটাগরিক্যাল ইম্পেরেটিভ categorical imperative কন্সেপ্টের ওপর দাঁড়াইয়া আছে। তো ক্যাটাগরিকাল ইম্পেরেটিভ কী? এইটা একটা সর্বজনীন নৈতিক নীতি। যার আসল কথা হইল, আমাদেরকে সবসময় অন্যদের মধ্যে হাজির থাকা মানবতাবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া লাগবে। প্রত্যেকের জন্য যে নিয়ম থাকতে পারে, আমার জন্য সে একই নীতি বা আইন থাকবে বা আমারও সেই অনুযায়ী কাজ করা উচিত। আমি যেখানেই থাকি না কেন, যে পজিশন হল্ড করি না কেন‌ এই আইনকে আমার মাইনা চলতে হবে।

কান্ট যুক্তি দেন যে, moral law বা নৈতিক আইন আমাদের যুক্তির (রিজন) একটা সত্যরূপ। তাই সমস্ত যুক্তিবাদী মানুষকে একই নৈতিক আইনের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। এইভাবে যদি প্রশ্ন করা হয়, আমার কী করা উচিত? কান্ট উত্তরে বলবেন, আমাদের উচিত সর্বজনীন নৈতিক আইন অনুযায়ী যুক্তিসঙ্গতভাবে কাজ করা। কান্ট আরও যুক্তি দেন, এই নৈতিক তত্ত্বের জন্য আমাদেরকে ফ্রি উইল, God ও soul এর অমরত্বে বিশ্বাস করা প্রয়োজন। যদিও আমরা এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সহজে জ্ঞান অর্জন করতে পারি না, কিন্তু নৈতিক আইনের কথা মানলে আমরা একটি ন্যায়সঙ্গত সিস্টেমের দিকে যাইতে পারি, যা এক ধরনের যৌক্তিক বিশ্বাসের ওপর দাঁড়াইয়া থাকবে।

এইভাবে যদি প্রশ্ন করা হয়, আমি কি আশা করতে পারি? কান্ট উত্তরে বলবেন, আমরা আশা করতে পারি যে, আমাদের আত্মা অমর এবং সত্যিই একজন গড আছেন যিনি ন্যায়বিচারের নীতি অনুসারে বিশ্বকে ডিজাইন করছেন এবং পরিচালনা করেন।

কান্টের নন্দনতত্ত্ব

কান্টের নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে দার্শনিক আলোচনা বার হয় ১৭৯০ সালে। বইয়ের নাম Critique of the Power of Judgment। কান্ট মনে করেন, তিনটি ভিন্ন ধরনের নান্দনিক বিচার আছে: সম্মতির বিচার, সুন্দরের বিচার এবং মহৎ ধারণার বিচার। প্রথমটি বিশেষভাবে জরুরি নয়, কারণ এইটা আমাদের যার যার ব্যক্তিগত উদ্দিপকের ওপর নির্ভরশীল। এই ধরনের বিচারের ফলফল সম্পর্কে সর্বজনীন কিছু নাই। যেমন যদি একজন ব্যক্তি উদ্ভিদ থেকে তৈরি করা মদপানকে আনন্দদায়ক মনে করেন এবং অন্য কেউ এইটাতে সেই আনন্দ পান না, তাহলে এইটা নিয়া কোনো ভুলবোঝাবুঝির অবকাশ নাই। কারণ, এক একজনের উদ্দিপনা এক এক রকমের।

সৌন্দর্যের বিচার বিষয়ে কান্ট চারটি উপাদানের কথা বলেন। প্রথমত. সৌন্দর্যের বিচার বিষয়গত কিন্তু তা স্বার্থহীন উপভোগের সাথে জড়িত। সুন্দর বস্তুকে না পাওয়ার ইচ্ছা করেই আমরা তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে পারি। দ্বিতীয়ত. সৌন্দর্যের বিচার সর্বজনীনতার সাথে জড়িত। আমরা যখন কোনো বস্তুকে সুন্দর বলে বিচার করি, তখন বিচারের মধ্যে অন্তর্নিহিত বিশ্বাস হলো, প্রত্যেকেরই একইভাবে বস্তুর বিচার করা উচিত। তৃতীয়ত. সৌন্দর্যের বিচারের উদ্দেশ্য, একটা উদ্দেশ্যহীন উদ্দেশ্যমূলকতা। মানে প্রথমে সুন্দর কোনো কিছুর জন্য হাজির থাকে বইলা মনে হয়, যদিও সুন্দরের সুন্দর হওয়ার নির্ধারিত কিছু উদ্দেশ্য নাই। মানে, সুন্দর এমনিতেই সুন্দর, এমনিতেই হাজির। চতুর্থ, সৌন্দর্যের বিচার নেসেসিটি বা প্রয়োজনীয়তার সাথে জড়িত। যখন একটি সুন্দর বস্তু উপস্থাপন করা হয় তখন আমি এইভেবে এইটাকে গ্রহণ করি যে, এইটাকে আমাকে সুন্দর হিসাবেই বিচার করা উচিত।

বিশদভাবে বলতে গেলে বলা যায়,  যখন আমি কোনো বস্তুকে সুন্দর বলে বিচার করি, আমি সেই বস্তুকে না পাওয়ার ইচ্ছা করেই করি। আমি বিশ্বাস করি যে, প্রত্যেকেই আমার মতো সুন্দরকে সুন্দর বলেই বিচার করবে। আমি এইটাতে একধরনের উদ্দেশ্য চাপাইয়া দেই, কিন্তু এমন কোনো ধারণা প্রয়োগ করি না যাতে এইটা কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য তিরি হয়। কান্টের সৌন্দর্যের বিচার এরকম বেশ অদ্ভুত। কারণ একদিকে যখন আমরা বলি কোনো বস্তু সুন্দর, তখন এটা একই ধরনের আপ্তচিন্তা নয়, যখন আমরা সবুজ রঙ বা একটি ঘোড়া সম্পর্কে বলি। কারণ এর সাথে বিষয়গত বা ব্যক্তিগত কারণ নয় বরং এর নেসেসিটি বা প্রয়োজনীয়তা এবং অন্তর্বিষয়ক সার্বজনীনতা জড়িত।

কান্টের শিল্পতত্ত্ব

কান্টের মতে, প্রাকৃতিক বস্তু ও মানুষের বানানো আর্ট বা শিল্প উভয়কেই সুন্দর বলে বিচার করা যেতে পারে। কান্ট প্রস্তাব করেছেন যে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলি সবচেয়ে বিশুদ্ধ, তবে মানুষের বানানো শিল্পকর্ম বিশেষভাবে আকর্ষণীয় কারণ এগুলি মানুষের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা থেকে তৈরি হয়। প্রাকৃতিক নয়, শিল্পকে অবশ্যই মনুষ্যসৃষ্ট হইতে হবে। প্লেটোর মতো কান্টও মনে করেন, শিল্প যতই সুন্দর হোক এইটা প্রকৃতির সৌন্দর্যকে অনুকরণ করেই বানানো হয়। আর একটা শর্ত তিনি জুড়ে দেন এই বইলা যে, একটি সুন্দর শিল্পকর্মকে অবশ্যই ‘উদ্দেশ্যপূর্ণ উদ্দেশ্যহীন’ হইতে হবে। অবাক এই অক্সিমোরোন। তো এর মানে কী? এই কথার অর্থ হইল, শিল্প নিজেকে এমনভাবে প্রকাশ করবে যে এর একটা উদ্দেশ্য আছে, আবার নাই।  তবে তার মতে, মহান শিল্পকে যা সত্যিকার অর্থে মহান করে তোলে, তা হইল শিল্পীর শ্রেষ্ঠ প্রতিভা।

কান্টের মতে, মেধাবী ব্যতিক্রমী, প্রতিভাধর ব্যক্তির অন্তর্গত সহজাত প্রতিভাই সে ব্যক্তিকে একটি অমোঘ নান্দনিক অভিজ্ঞতাকে শিল্প বানাইতে সহায়তা করে। কান্ট মনে করেন শিল্পির নান্দনিক অভিজ্ঞতা তার ভেতরের যুক্তির ধারণার আর এক প্রকাশ। যুক্তির ধারণাগুলি এমন ধারণা যার জন্য কোনও অন্তর্দৃষ্টি পর্যাপ্ত নয়, তেমনি নান্দনিক ধারণাগুলি কল্পনার উপস্থাপনা যার জন্য কোনও ধারণাও পর্যাপ্ত নয়। যখন প্রতিভা একটি শিল্পে নান্দনিক ধারণা প্রদর্শনে সফল হয়, তখন কাজটি মুক্ত খেলা হিসাবে ধরা দেয়। মানে, একে নিয়ে আমরা আমাদের কল্পনা ও বোঝাবুঝির খেলা খেলতে পারি।

কান্ট শিল্পকে তিনটি দলে ভাগ করেছেন: এক. বক্তৃতা শিল্প ও কবিতা। দুই. চিত্রকলা (ভাস্কর্য, স্থাপত্য ও চিত্রকলা) এবং তিন. সংবেদনশীলতার শিল্প (সঙ্গীত ও পেইন্টিং)। এগুলি অবশ্যই একসাথে একত্রিত হইতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অপেরা শিল্প, সঙ্গীত ও কবিতাকে গানের সাথে একত্রিত করতে পারে। আবার এইটাকে থিয়েটারের সাথে মিলাইয়া একটা চিত্রকর্মও বানানো যায়। প্লেটোর বিপরীতে গিয়া কান্ট কবিতাকে শিল্পের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। এর কারণ হইল, কবিতা আমাদের কল্পনাশক্তি ও বোঝাপড়াকে উদ্দীপিত করে এবং পঠন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমাদের মনকে প্রসারিত করে।  কান্টের কাছে সবচেয়ে মুক্ত এবং উত্তম শিল্প হইল কবিতা। সঙ্গীত ও পেইন্টিং নির্ভর করে ইন্দ্রিয়জ কামনা বাসনার ওপর কিন্তু কবিতা এস্থেটিক ধারণাগুলি সরাসরি প্রকাশ করে আমাদের মনের কাছে, আমদের চিন্তার কাছে।

যেহেতু কান্ট রিজনের ক্রিটিক করেছেন, আর রিজনের ধারক বাহক হইল ভাষা, তাই কবিতা ভাষার উত্তম প্রকাশ বইলা একটা শ্রেষ্ঠ শিল্প মাধ্যম। কিন্তু মনে রাখতে হবে কবিতা যেন নতুন কিছু সষ্টি করে, পচাগলা কিছু না। সঙ্গীত বিষয়ে তিনি মনে করেন, সঙ্গীত সবচেয়ে সফল হয় যদি এইটা তার মুগ্ধতা দিয়া আমাদের মনকে নাড়া দেয়। কারণ কোনো কোনো সংগীত শব্দের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে মানুষের ভাষাকে য়ার একটা নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় যে, কোন শিল্প সংস্কৃতিকে সর্বাধিক আগাইয়া নিয়া যায়, কান্ট মনে করেন যে চিত্রকলা।

লেখক: কবি