কিছু মানুষ গল্প লেখে, অধিকাংশ মানুষ গল্প করে

পর্ব ৭

প্রকাশিত : এপ্রিল ২১, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:

সরফরাজ: ২০১৭ সালে ঐতিহ্য প্রকাশ করেছে আপনার অণুগল্পের বই `জ্বাজ্জলিমান জুদা`। গল্পের কাঠামোতে পরিবর্তনের উদ্দেশ্য আছে কোনো?

মেহেদী: শুরুতে অণুগল্প বললেও পরে এবং বইয়ের প্রিভিউ-রিভিউতে এগুলোকে গল্প হিসাবেই আখ্যা দিয়েছি। এগুলো কম শব্দের, স্বল্পায়তনের হলেও এগুলোর কাঠামোতে মূলত গল্পই আছে, মানে শরীরে গল্পই। একটা দুই হাজার শব্দের গল্পে যে গল্প এগুলোতে সেই গল্পই। শুধু কমের মধ্যে বলেছি। এটাও একটা ফর্ম। এটাই আদি ফর্ম, গল্পের। জাতক, ঈশপের গল্প, পশুকথা, কিচ্ছা, লোককথা, চুটকি ইত্যাদি মৌখিকভাবে ছোট পরিসরেরই। এই গল্পগুলো সেই আঙ্গিকের ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে লিখিত। শব্দ অল্প, কিন্তু কাহিনির ব্যঞ্জনা ছোটগল্পের মতোই। এক্ষেত্রে উদাহরণ, বনফুল। আমি ২০১৬ সালের মাঝামাঝি থেকে প্রায় শেষ মাস পর্যন্ত প্রতিদিন একটি করে এমন গল্প শোনাতাম ফেসবুকবাসীদের। প্রতিদিন একটি করে লিখতেই হবে এমন না, বরং অভ্যাসে মিশে গেছিল প্রক্রিয়াটা। না লিখলে খারাপ লাগত। যেখানেই থাকতাম, লিখে ফেলতাম। দেখা যেত, আড্ডা দিচ্ছি, মাথায় গল্প এসে গেলে আড্ডার বন্ধুরা বিরক্ত হলেও কিছু করার থাকত না, ফোনে লিখে ফেলতাম, লিখে পোস্ট দিয়ে দিতাম। এটা একপ্রকারের নিরীক্ষা। সাহিত্যকে জীবনের সাথে অভ্যাসে জড়িয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া। যেমনটি হাজার ব্যস্ততা থাকলেও চা খাই, আড্ডা দিই, ঘুরে বেড়াই, গল্প করি, সেরকম চিন্তা করলাম, গল্প করার মতো করে কিছু গল্প লিখব। মূলত গল্প শুনিয়েছিলামও। এমনই বেশি হয়েছে আমি বলতাম আর আমার সহকর্মী পলি ঘোষ তার ফোনে টাইপ করতেন। উনি কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষক হলেও সাহিত্য ভাবাপন্ন। সাহিত্যের কদর করেন। লিখলে ভালো করবেন জেনেও লিখলেন না। কিন্তু সাহিত্য পড়তে পছন্দ করেন। সেইসূত্রে তার সঙ্গে ভালো খাতির। জ্বাজ্জলিমান জুদার অধিকাংশ গল্প তাকেই শুনিয়েছিলাম। তিনি শব্দ ধরে ধরে শুনতেন আর লিখে ফেলতেন। লেখা শেষে ম্যাসেঞ্জারে কপি করে দিতেন। ওখান থেকে নিয়ে আমার ওয়ালে পোস্ট দিতাম। অর্থাৎ, গল্প লেখার চেয়ে গল্প বলার নতুন এক আঙ্গিকে মনযোগী হয়ে উঠেছিলাম সে সময়। আড্ডা দিতে দিতে, ঘুরতে-ফিরতে সেগুলো বলেছিলাম। কিছু নির্দিষ্ট মানুষ গল্প লেখে, কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ গল্প করে, এই বোধ থেকেই গল্প বলা বা করা, যেন সেই অধিকাংশ মানুষের একজন হয়েই গল্প করা তাদের উদ্দেশে। বিভিন্ন মূল্যায়ন পেয়েছি এই ধাঁচের গল্প নিয়ে। এখন পর্যন্ত সেরা পর্যবেক্ষণ  কবি ও গল্পকার তানিম কবিরের। তিনি এই গল্পগুলোকে তুলনা করেছেন মসলিন শাড়িকে ম্যাচবাক্সে ঢোকানোর সাথে। সেরকমই ব্যাপারটা। আমি একমত তার সাথে।

সরফরাজ: এটা অবাক লাগছে, ছোট জায়গা থেকে বড় জায়গায় উল্লম্ফন!  মানে, কম শব্দের গল্প থেকে হঠাৎ উপন্যাসে যাত্রা। গেল মেলাতেই (২০১৮) ঐতিহ্য প্রকাশ করেছে আপনার প্রথম উপন্যাস `গোসলের পুকুরসমূহ `।

মেহেদী: এই বিবর্তনে আমি নিজেও অবাক হয়েছি। পরিকল্পনার বাইরের জিনিস দিয়েই জীবন বেশি প্রভাবিত। স্বল্পায়তনের গল্পগুলো শোনানোর সময় আমি উপন্যাস নিয়ে মোটেও ভাবিনি, যে পরের বছর উপন্যাস প্রকাশ করতে যাচ্ছি! বরং আমি এরকম ভেবেছিলাম, লেখালেখি কয়েক বছরের জন্য বন্ধ রাখব। একটা জটিল সমস্যায় আক্রান্ত হলাম। গল্প বলতে বলতে বলার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছিল, লিখতে ইচ্ছা করত না, লেখার জন্য বসতেও না। ভেবেছিলাম, আর লিখতে পারব না। ক্যারিয়ার শেষ। আমি বলব, শুনে কেউ লিখবে এমন লোক নিয়োগের কথাও ভেবেছিলাম। আমার দুই ছাত্রকে এই ব্যাপারে প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। তারা লিখতে আগ্রহী, কিন্তু কোনো পারিশ্রমিক নিতে আগ্রহী না হওয়ায় তাদের চিন্তাও বাদ দিলাম। আমি চাচ্ছিলাম, গল্প বলার ব্যাপারটাকেই স্টাবলিশ করব, যেহেতু সেই অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে এক বছরে। কিন্তু ফ্রি ফ্রি না, পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে কাজটি কাউকে দিতে চেয়েছিলাম। একরাতে খুব গল্প বলতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু কে লিখবে?  সেসময় আমি ঢাকায় অবস্থান করছিলাম। বাসায় বউকে বললাম, আমি একটি গল্প বলব, গল্পের নাম, `আমার অসুখ। আই মিন আমি অসুখী। শুনে সে বলল, হ্যাঁ, তারপর? মানে সে ফোন নিয়ে টাইপ করার জন্য প্রস্তুত। বলতে শুরু করলাম। সেটি পনেরশ শব্দে গিয়ে থামল। নায়মা তার ফোনেই রেখে দিল। পরে সেখান থেকে কপি করে পিসিতে এনে ফাইনাল এডিট করলাম। তার এক দুইমাস পর হঠাৎ মাথায় একটা গল্প এলো। কিন্তু গল্পের উৎস ক্লাস নিতে যেয়ে। এক শিক্ষার্থী প্রসঙ্গক্রমে জানাল, সে ছোটবেলা থেকে বিবাহ স্বপ্ন দেখলে তার পরিচিত বা নিকটাত্মীয় কেউ না কেউ মারা যায়। শুনে অবাক হলাম। অবচেতনে এই সূত্রটাই গল্পের দিকে যাচ্ছিল। এক রাতে গল্প এলো, ভাবলাম লিখি। শিরোনাম `বিবাহস্বপ্নের কনে` লিখে ঘণ্টাখানেক শুয়ে থাকলাম। তারপর একটা সাবান চোখে ভাসল, গোসলের সাবান। শুরু করে দিলাম সেখান থেকেই, সাদা সাবানে কালো একটা পিঁপড়া ঘুর ঘুর করছে। কখন যে লেখা শেষ টের পেলাম না। ভোর হয়ে গেল। গল্পটা পরে বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এভাবেই দেড়বছর বাদে লিখতে সক্ষম হলাম নিজ আঙুল খাটিয়ে, বেশি শব্দের গল্প। নিজের আত্মবিশ্বাসের সত্যাসত্যি যাচাইয়ের জন্য পরদিনই লিখতে বসলাম, `উড়ির চরের আয়নাবুড়ি ও মঞ্জুরির ড্রেসিংটেবিল। ` ছাপা হলো ভোরের পাতার চারুপাতায়। তারপর লিখলাম, `গোসলের পুকুরসমূহ`, গল্প। ওটা প্রথম আলোতে দুই সপ্তাহ পরেই প্রকাশিত হলো।  আরেকটা গল্প লিখলাম, সর্পবংশের শেষদিন, যুগান্তরে প্রকাশিত হলো। তারপর লিখলাম আক্ষরিক, জনকণ্ঠে ছাপা হলো।

সরফরাজ: এ যে দেখছি গল্পের স্রোত আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল...

মেহেদী: হা হা হা... সবমলিয়ে আমি নিজেই তব্দা খেলাম। এ আমি কি করছি! নিজের অজান্তেই আমি একটি উপন্যাসের দিকে যাচ্ছিলাম। সবচেয়ে বেশি অবাক করা, উপন্যাসের সর্বশেষ অধ্যায় আমি আগেই সৃষ্টি করেছি। আমার অসুখ। আই মিন আমি অসুখে। আরো অবাক করা , এই বাক্যটি উদভ্রান্তের মতো আমি আওড়াতাম বন্ধু মহলে। তারা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করত, এটা কি! আমি শুধু বলতাম, `আমার অসুখ। আই মিন আমি অসুখী।` এই অধ্যায়ই উপন্যাসের শেষ অধ্যায়। খেয়াল করলাম, সব গল্পের মধ্যে একটা ঐক্য আছে। ঘটনার ঐক্য। আমি গল্পগুলো পরপর সাজিয়ে গেলাম, সেগুলো উপন্যাসের এক একটি অধ্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো। মাঝামাঝি যেয়ে মনে হলো, আরো লেখা দরকার। এবার পরিকল্পিতভাবে এগুলাম। যেখানে যেটা দরকার সংযোজন-বিয়োজন চলল। আশি হাজার শব্দ থেকে কমিয়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজারে সীমায়িত করলাম। গোসলের পুকুরসমূহ গল্পের শুরুতে যে বারোজন প্রেমিকার নাম এসেছে, তারাই উপন্যাসকে টেনে নিয়ে যেতে থাকল। আমি সারারাত লিখতাম। লিখতাম আর এডিট করতাম। টানা ছয়মাস, শেষে ফাইনালি একমাস কাটাকুটি ও বিন্যাসের কাজ চলল। ষোলটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত হলো `গোসলের পুকুরসমূহ`।

সরফরাজ: উপন্যাসের রেসপন্স কেমন?

মেহেদী: রিভিউ পাচ্ছি বিভিন্ন পর্যায় থেকে। মেলা চলাকালীন তিনটি রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে। মূলত তারা পাঠক। কদিন আগে কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের ফেসবুকে পাঠপ্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছেন, গোসলের পুকুরসমূহ পড়ে তিনি আনন্দিত। মনে হয়েছে, ভালো লেখা। এর কাহিনি-সজ্জায় তিনি চমৎকৃত হয়েছেন। আপত্তি জানিয়েছেন ভাষা নিয়ে। কিছু জায়গায় আরেকটু সহজ করার পরামর্শ দিয়েছেন।

সরফরাজ: ভাষা বিষয়ে আপনি কি তার সঙ্গে একমত?

মেহেদী: তার বক্তব্যের প্রতি আমার সম্মান রয়েছে। দ্বিমত পোষণের একটা কারণ আমি খুঁজে পেয়েছি। সেটা হলো, এপর্যন্ত আমি তিনবার ভাষা বদলেছি। `তিরোধানের মুসাবিদা`য় একটা ভাষা। রিসতা, ফারিয়ায় একটা ভাষা। আর এই উপন্যাসে। ভাষার স্টেজগুলো আমি বানাইনি, বরং কন্টেন্ট নিজেই ভাষা গড়েছে। আমি সাবলীলভাবেই বলেছি মাত্র। যেভাবে প্রকাশ করলে স্বস্তি ও প্রকাশের চূড়ান্তকরণ হয়। এই উপন্যাসে কয়েকটি অধ্যায়ে এমন কয়েকটি বিষয় এসেছে যার প্রকাশে ভাষাকে কিছু কাব্যিক করতেই হয়েছে। প্রতিবেশ নির্মাণেই এই ভাষা-সংশ্লিষ্টতা। মনে হয়েছে, আমার আর পাঠকের মধ্যে এই কঠিন যদিবা কোনো অসুবিধা করে তবে উভয়েই যেন ঋণী থাকি এক মহা ইলিউশনের কাছে, যা এই উপন্যাসের আরেক আধার।

 

চলবে