কুকুর নিয়ন্ত্রণে এলে ভ্যাকসিন বাণিজ্য কি আকাশ থেকে হবে

শিমুল বাশার

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২০

সন্ধ্যায় রাজধানীর এক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফোন করলেন। কুকুরের আতঙ্কে তার এলাকার জনসাধারণ আগামীকাল সকাল সাড়ে ১১টায় মানববন্ধন করতে রাস্তায় নামবে। তিনি আমাকে রিকোয়েস্ট করলেন গণমাধ্যমে তাদের ওই মানববন্ধনটার একটা কাভারেজ দিতে।

এই কাভারেজটার কেন প্রয়োজন, কতটা প্রয়োজন তা আসলে আমরা সাধারণ পাঠক ও দর্শকরা বেশিরভাগ সময়ই বুঝতে পারি না। ধরতে পারি না ঘটনার ভেতরের রাজনীতি এবং অর্থনীতিটা। কোনো ঘটনাকে বিগার পিকচারে দেখা এবং সেটার ডিটেইল নিয়ে আমাদের প্রশ্ন করার অক্ষমতাই এর জন্য বেশি দায়ী।

একজন মানুষ হিসেবে আমার এই বেঁচে থাকা কুকুর বিড়ালের চেয়ে খুব বেশি সম্মানজনক... এই দাবি আমি কখনো করি না। একারণেই হয়তো আমি নিজে কুকুর-বিড়ালকে সহমর্মিতার চোখে দেখতে শিখিনি। মানুষের বাচ্চার চেয়ে কুকুর-বিড়ালের প্রতি অধিক ভালোবাসা আমার কখনোই আসে না। যদিও আমি শৈশব থেকেই কুকুর-বিড়ালের সাথেই বেড়ে ওঠেছি। চিন্তা করতে শেখার পর বুঝেছি, আমার অস্তিত্ব নির্ধারণে আমার প্রতিবেশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

জার্নালিস্ট হিসেবে আমার এক গুরু ছিলেন আল জাজিরার মিডল ইস্ট প্রতিনিধি ‘আনিতা ম্যাকনট।’ প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরার আগে তিনি ভিজ্যুয়ালের জন্য আমাকে একটা গোপন টিপস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যে কোনো ভিজ্যুয়ালে প্রতিবেশটাকে ইমপর্টেন্স দিতে। তিনি নিউজের ক্ষেত্রে প্রতিবেশকে এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে, তার করা প্রতিটি স্টোরিতে প্রাণিদের উপস্থিতি আমি খেয়াল করেছিলাম। এমনকি ওয়ার স্টোরিতেও।

তিনি পারসোনালি প্রাণি খুব ভালোবাসতেন। একবার তার সাথে ক্যামেরা নিয়ে স্টোরি করতে গিয়ে অদ্ভুত এক দৃশ্য আমি দেখেও ফেলেছিলাম। একটা মুরগী হাঁটতে হাঁটতে টুপ করে লাফ দিয়ে তার কোলে উঠে গিয়েছিল! এবার আসি একটা গল্পে। ধরুন, যশোর এলাকায় জঙ্গি আস্তানা পাওয়া গেছে এমন একটি প্রতিবেদন গণমাধ্যমে দেখানো হলো। সেই প্রতিবেদনে আমরা দেখলাম, জঙ্গিরা সাংবাদিকের কাছে তাদের জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা নিয়ে সাক্ষাৎকারও দিচ্ছে। আমরা সেসব দেখলাম। এখন একজন দর্শক হিসেবে এই প্রতিবেদন দেখার পর কি কি প্রশ্ন তৈরি হতে পারে?

আজ এমনই এক কাল্পনিক ঘটনার কথা বলবো। ঢাকা থেকে গোপন খবর পেয়ে আমি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে গিয়েছি সীমান্ত এলাকায়। সেখানে আমি জঙ্গিদের সাক্ষাৎকার নেব। মাটির আলপথ ধরে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে উপস্থিত হলাম। সেখানে খুব বেশি আবাস নেই। একটা বনের ভেতরে ঢোকার পর আমাকে জানানো হলো, এখানে জঙ্গিরা গতকাল রাতেও ছিল। আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না এই জঙ্গলের সাথে জঙ্গিদের সম্পর্কটা কোথায়? জঙ্গিদের গায়েতো আর জঙ্গি লেখা থাকে না, তাহলে তারা জঙ্গলে লুকায়ে থাকবে কোন বিচারে? পরে আমাকে বোঝাতে না পেরে রেডিমেইড জঙ্গিদের সাক্ষাৎকার যোগাড় করে দেয়া হলো। সেই সাক্ষাতকারে জঙ্গিরা মুখ ঢেকে তাদের কার্যক্রমের স্বীকারোক্তি এবং পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছে।

প্রশ্ন করলাম, এই রেডিমেইড সাক্ষাৎকারটি কে নিয়েছে? কেন জঙ্গিরা তার কাছে  এই সাক্ষাৎকার দিয়েছে? এসব প্রশ্ন করতে করতে একসময় জানতে পারলাম, খুব অথেনটিক সোর্স থেকেই এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা হয়েছে। এই অথেনটিক সোর্স কারা? নাম বললে আর চাকরি থাকবে না। পরে আমার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছিল, ওই এলাকাটিতে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রায় আড়াই হাজার তরতাজা যুবককে আইন শৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে কে বা কারা ধরে নিয়ে গেছে। যারা সেসময় নিখোঁজ হয়েছিল তাদের কারো কারো লাশও পাওয়া গেছে মাঠেঘাটে। এখন যদি গণমাধ্যমে এমন একটা রিপোর্ট হয় যে, ওই এলাকায় জঙ্গি রয়েছে তাহলেই এই আড়াই হাজার যুবকের হারিয়ে যাওয়া এবং লাশ হয়ে যাওয়ার একটা যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য গ্রাউন্ড তৈরি হয়ে গেল।

এবার বাস্তবের কথা বলি। কিছুদিন ধরেই সিটি করপোরেশনের কুকুর অপসারণের পক্ষে-বিপক্ষে মানুষ রাস্তায় দাঁড়াচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও চলছে বেশ শোরগোল। এসব দেখে আমার প্রায়ই মনে হয়, সোশ্যাল মিডিয়া আসলে এমন একটা জায়গা যেখানে কোনো থিথিসই দাঁড়াতে পারে না। মুহূর্তেই এন্টি থিসিস দাঁড়িয়ে যায়। অভিনেত্রী জয়া আহসান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গসহ প্রাণিপ্রেমী সংগঠনগুলো যেমন কুকুরের প্রতি করপোরেশনের এই অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে হাইকোর্টে যান তেমনি পরিসংখ্যানও আছে  চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত গেল আট মাসে ৩৬ হাজার লোক কুকুরে আক্রমণের শিকার হয়ে সেবা নিয়েছে মহাখালী বক্ষ ব্যাধি হাসপাতালে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, এতদিন কোথাও কোনো মানববন্ধনের ঘটনা আমাদের কারোর চোখে পড়েনি। কুকুরের আক্রমণের এমন ঘটনা কিন্তু নিত্যকার। প্রশ্ন হলো, রাজধানীর কুকুরগুলো কেন আমাদের নিরাপদ প্রতিবেশী হলো না? এসব বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণ ও দেখভাল করা বা ভ্যাক্সিনেইশানের আওতায় আনার জন্য কি কোনো দায়িত্বশীল সংগঠনই এদেশে নেই? নাকি সবই আপনার আমার ব্যক্তি পর্যায়ের কবিত্ব-ভালোবাসা?

২০১৪ সালে নৃশংসভাবে কুকুর নিধনে হাইকোর্টের শক্ত অবস্থানের পর আসে করপোরেশনের কুকুর বন্ধ্যাকরণ প্রকল্প। কিন্তু দক্ষিণ সিটিতে গেল ২৯ মাস এবং উত্তর সিটিতে গেল ৯ মাস কুকুর বন্ধ্যাকরণের এই কর্মসূচি বন্ধ রাখা আছে। আবার কুকুর নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরও কোনো কার্যক্রমও নাই। একদিকে কুকুর নিধনে নিষেধাজ্ঞা, অন্যদিকে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলো যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় রাজধানীতে দিন দিন বেওয়ারিশ কুকুর বাড়ছে। এতে কুকুরের আক্রমণের শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যাও বাড়বে, এত সহজ স্বাভাবিক সমীকরণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কর্মসূচি বলছে, দেশে প্রতিবছর সাড়ে তিন লাখ লোক কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়।

২০২০ সালের মধ্যে দেশ থেকে স্থায়ীভাবে জলাতঙ্ক রোগ নির্মূল করতে হবে বলে ২০১১ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচি থেকে চারটি কর্মকৌশল ঠিক করা হয়। এগুলো হচ্ছে জলাতঙ্ক রোগ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম জোরদার করা, কুকুরের কামড়ের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, ব্যাপক হারে কুকুরের শরীরে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকাদান এবং লাইগেশন ও খোজাকরণের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ।

আহা আহা, কী সাধু! অবশেষে বলি, সরকারি প্রকল্পের কাজ কেমন হয় তাতো আপনার আমার সবারই জানা, তাই না? ৯ বছরেও বেওয়ারিশ কুকুরের এই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কাজটা শুরু হয়নি। কারণটা জানেন? বন্ধ্যাকরণের এই কাজটা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব নিয়ে করা হয় তবে স্বাভাবিকভাবেই কুকুর নিয়ন্ত্রণে আসবে। আরে ভাই, কুকুর নিয়ন্ত্রণে আসলে ভ্যাকসিনের বাণিজ্যটা কি আকাশ থেকে হবে? এখন রাস্তায় তাহলে কারা, কেন নামছে? যারা নামছে তাদের কেউ কিন্তু কুকুর নিয়ন্ত্রণে আনতে করপোরেশনের নেয়া বন্ধ্যাকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদাসীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে না। তারা বলছে, রাজধানীতে কুকুরের উৎপাতে তাদের ছেলেমেয়েরা খেলতে যেতে ভয় পায়, স্কুলে যেতে ভয় পায়, রাস্তায় নামতে পারে না। এহেন পরিস্থিতিতে করপোরেশন কুকুরকে সরাবে না তো কি হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা করে মারতে থাকবে? মারলেতো আবার আমার আপনার মতো যারা কুকুরকে বন্ধু ভাবি তারা রাস্তা ছাড়বো না! সোশ্যাল মিডিয়াতে খুব করে কাঁদবো! আমাদের তখন খুবই খারাপ লাগতে থাকবে, তাই না? আমরা করপোরেশনের গুষ্ঠিও উদ্ধার করতে ছাড়বো না... আর এ কারণেই কুকুরদের বস্তায় ভরে ট্রাকে করে দূরে কোথাও রেখে আসা হচ্ছে এবং হবে। যেন এতদিন যেসব কুকুরেরা রাজধানীর মানুষদের কামড়াইছে এখন থেকে তারা যেন যেখানে রেখে আসা হচ্ছে সেখানকার মানুষদেরও কামড়াইতে পারে আর আগামীতে বছর বছর আটটা করে বাচ্চা দিয়ে অনিরাপদ প্রতিবেশী হিসেবে সংখ্যায় ক্রমাগত বেড়ে আরও বেশি বেশি কামড়ায়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী