কুক্কুরুক্কু কবুতর... আমাকে চুমুতে ভরাও

চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২০

লেখকের বানানরীতি অক্ষুণ্ণ রাখা হলো

ব্রাজিলিও ওস্তাদোনা কা ওস্তাদোনো গায়েন কাইতানো ভেলোজোর বড়ত্বের মাপ হলো, চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমোদোভার কাইতানোর গায়কিকে করে তোলে মুল ছবির অংশ আর অভিনেতাদের নিয়ে যায় আবহে। আর কাইতানো মাথা নোয়াতো অপর ব্রাজিলিও গায়ক প্রয়াত হোয়াও গিল্বার্তোর কাছে। লাখো কোকিলের তরকারিতে লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শান্তিদেব ঘোষ, কনিকা, হেমন্ত, সুচিত্রা মিত্র, সোহরাব হোসেন, ফিরোজা বেগম, লাকি আখন্দ, আব্দুল আলিম, গৌতম চ্যাটার্জির গাওয়া মহীনের ঘোড়াগুলি মেশাবার পর আরেকটু  কান পাতলে তবে যদি পাওয়া যায় কাইতানো আর হোয়াওয়ের দরদ। কিন্তু ওদের গানগুলো আমাদের উঠানে পৌছালো না কেন? স্প্যানিশ, পর্তুগিজ না জানার ফলে? উহু। একেবারেই তা নয়।

কবি কিশোর নেরুদা গীতাঞ্জলিতে হাবুডুবু খেয়েছিল, ইংলিশ, বাংলা না জেনে, কবি জিমেনেথের স্প্যানিশ অনুবাদে। আর জিমেনেথ অনুবাদ করেছিল ইংরেজি থেকে। বাংলার সাথে ইয়রোপিয়, লাতিন এমেরিকার ভাষাগুলোর ফিরতি যোগাযোগের সাকো তৈরি হয়েছিল কবিদের মননে ভর করে। সেই যোগাযোগটা নষ্ট হয়ে যাওয়াতে আমাদের কবিতা, উপন্যাস, গল্প, গান, নাটক এত দরিদ্র হয়েছে, উবে গেছে গিতিনৃত্যনাট্য বা অপেরাটিক সাহিত্য ধারা। অর্থনিতিভিত্তিক, তথ্যভিত্তিক যোগাযোগ প্রানস্পন্দনের পারস্পরিকতাকে জোরদার করতে পারে নাই।

নেরুদা তো বাংলাতে হরেদরে অনেক অনুদিত হয়েছে, মার্কেজও। শোনার কান নষ্ট করে শ্রুতির মাত্রাবৈচিত্র হারাতে হারাতে আমাদের গিতিকার, গায়ক, সুরকাররা অব্ধি স্বরলিপি পড়তে জানে না, গিতিনাট্যের লিব্রেটো হাজার মাইল অস্ত। অথচ শর্মিষ্ঠার মহাকবি, চন্ডালিকা, মায়ার খেলার কবিগুরু, অগ্নিবীণার কবি তানসেন, সৌ্রীন্দ্র মোহনদের স্বরলিপি শিখে খেলতে নেমেছিলো। আমাদের গ্যাপ এখন প্রায় দেড়শো বছরের গ্যাপ। এর ভেতর আধুনিক, উত্তরাধুনিক, সাবল্টার্ন বিবিধ হামবড়াই ঢুকে গেছে। হামবড়াই ধরে আজকের লাটিন অনুবাদক মেক্সিকোকে মেহিকো, মোহিকো ইত্যাদি লিখছে, কিন্তু তার পেছনের রসটুকু তার লেখায় পাওয়া যাচ্ছে না।

এ বেলায় নাম নিচ্ছি রফিকুজ্জামান মুনির, শাগুফতা শারমিন তানিয়া, রাজু আলাউদ্দিনের। মুনির একাডেমিক চর্চা করে স্প্যানিশ ভাষার শিক্ষক, আলাউদ্দিন অনানুষ্ঠানিকভাবে স্প্যানিশ রপ্ত করেছেন এবং বেশ কিছু অনুবাদ করেছেন, তানিয়া সরাসরি স্প্যানিশ না কি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন, জানতে পারি নাই। একজন অনুবাদক মুল ভাষাটি জানে কি না তা আমার বিবেচ্য নয়। নেরুদা, জিমেনেথ জানতো না। মুনির, আলাউদ্দিন, তানিয়াদের অনুবাদকে সাকো করে আমরা কেনো কাইতানো, হোয়াওদের সুরসাগরে মন্থন করতে পারছি না, তার মন্ত্রগুপ্তি হচ্ছে এদের অনুবাদে একটি ভাষার তথ্যটা মুল প্রতিপাদ্য, সে ভাষার সুর বা লিরিক বা গিতলতা নয়।

বলছি না অন্তমিল দিয়ে, মাথা দুলিয়ে, পা ঠুকে, গান গেয়ে গেয়ে লিখতে বসতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, নেরুদা, জিমেনেথ কেউ গায়ক নয়। তাদের সাকোটি হচ্ছে কবিত্বের। একই সাকো ধরে ইটালিয়ান অনুবাদক রুশ কবি পাস্তেরনাকের উপন্যাস জিভাগো রুশে প্রকাশিত হবার আগে ইটালিয়ানে প্রকাশ করেছিল। যখন বাংলাতে অনুবাদ বেড়েছে, বিভিন্ন ভাষার একাডেমিক, অনাডেমিকদের ভিড় বেড়েছে, তখন কেনো আমরা ভিন ভাষার সুর বৈচিত্র্য পাচ্ছি না? এমন কি যে সুরগুলো, যে গায়কিগুলো আমাদের কাছাকাছি সেগুলোরও কেনো খোজ পাচ্ছি না?

কারন খুজতে আবার আমাদের সাহিত্য ভাষার বাহন কি বা সেটা কোথায় উপনিত হয়েছে তার সুল্লুক সন্ধান করতে হবে। গদ্যকে বলা হয় দাবার চাল, কেউ বেশি জানে, কেউ বা কম জানে। আর সাংবাদিকতা দাড়িয়ে থাকে এই দাবার চালের ছোবড়া থেকে। একজন চর্চাকারি যত বেশি দাবার চালের বা তথ্যগত কম্বিনেশান জেনে থাকুক না কেনো, এর নিট ফলাফল ছোবড়া। আর ছোবড়াকে যতই মোডিফাইড বা হাইব্রিড করা হোক, তা থেকে অন্যভাষার সুরে যেরকম যাওয়া সম্ভব না, সেরকম সেসব অনুবাদ দিয়ে নিজের ভাষার প্রানরস বাড়ানোও সম্ভব না। শোনার কানটা আগে। তারপর এক কান বন্ধ করে পুরো শরিরকে কান করে তোলা। আক্ষকরিকভাবে সুর যাতে এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে না বেরিয়ে যায়! কিন্তু আমরা দাবার চাল, সাংবাদিকতা, আর গবেষনার টিপ্পনিতে মশগুল।

নাম নিয়েছি তিন জনের। কিন্তু প্রবনতাটা সবার। যে ছড়াকারদের ফিকিরে গদ্য চালের অবকাশ একেবারে নাই, দেখা যাবে পুনপৌনিকতায় তারা গদ্যকারদের চেয়ে বেশি দুষিত। তাদের কাজেও পাওয়া যাচ্ছে না ছন্দ আর সুরের বৈচিত্র্য। ভাই, পড়তেও হবে, শুনতেও হবে। অন্ধ এবং বধির হয়ে শুনতে পেলে, দেখতে পেলে তা সর্বোত্তম।

স্ববিশেষে, যারা প্রকাশ্যে ও গোপনে এ লেখাটি পড়ে নেবেন, তাদের প্রতি, কুক্কুরুক্কু কবুতর এখানে কাইতানোর গাওয়া, লিখেছে টমাস মেন্দেজ, ১৯৫৪। আমাকে চুমুতে ভরাও, গানটি কাইতানো ও হোয়াও দুজনেই গেয়েছে। বাংলার বিভিন্ন গিতিকার, সুরকারের পাশাপাশি আরো ভাষার গায়েনদের সাথে এই দুই গায়কের প্রতি সিজদা জানিয়ে আমার অপেরা লেখা শুরু করেছিলাম। সিজদা লিখেছি দায়িত্ব নিয়ে। কাইতানো ও হোয়াওকে আমার সবসময় স্বর্গের দুত মনে হয়েছে।