ক্ষমতারে প্রশ্ন করা লাগে, তাই কারবালা ঘুরে ঘুরে আসে

তুহিন খান

প্রকাশিত : আগস্ট ২০, ২০২১

হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি বন্ধুদের সাথে খেলাধুলায় মগ্ন, হঠাৎ রাসুল আসলেন। আমি তাড়াতাড়ি দরজার পেছনে লুকাইলাম। রাসুল আমার পিঠে হালকা চাপড় দিয়া বললেন, যাও, মুয়াবিয়ারে আমার কাছে আসতে বলো। ইবনে আব্বাস বলেন, আমি ফিরে এসে রাসুলকে বললাম, উনি তো খাওয়া-দাওয়া করতেছেন। ইবনে আব্বাস বলেন, রাসুল আবার বললেন, যাও, মুয়াবিয়ারে ডাকো। আমি ফিরে এসে আবার বললাম, উনি তো খায়। রাসুল বললেন, আল্লাহ কখনোই তার পেট না ভরাক। (সহিহ মুসলিম; হাদিস নম্বর ২৬০৪)

হযরত হুসাইন আর ইয়াযিদের ঘটনা ঘুরেফিরে ইতিহাসে আসে। আমরা সবাই তো আল্লাহর অনুগ্রহে হুসাইনি কাফেলার সাথে যাইতে চাই, আবার ইয়াযিদি কাফেলায়ও তো এখন `সহি আকিদা`র লোক কম দেখি না! কিন্তু `ইয়াযিদ` বা `হুসাইন` কে? ইয়াযিদি বা হুসাইনি চেতনার মূলমর্ম কীরকম? `হুসাইন` আমাদের কাছে প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, ন্যায়ের মূর্তি, জনতার কণ্ঠস্বর, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অত্যাচারিতের প্রতিরোধ। কিন্তু ইতিহাসের গোড়ায় তাকাইলে, সবগুলা ঘটনার ফাঁক-ফোকরে নজর দিলে, আরো অনেকগুলা জরুরি জিনিশ বোঝা সহজ হয় আমাদের জন্য।

নবিজির ওফাতের পরে, হযরত আলির খেলাফত যদি আমরা মাইনা নিই, ইমামতের সিলসিলা যদি মাইনা নিই, আহলে বাইতরে যদি রাষ্ট্রপরিচালনার হকদার মাইনা নিই, নবুওত ও খেলাফতরে যদি `ইনসেপারেবল` মাইনা নিই—তাইলে সেই রাজতন্ত্ররেই তো মাইনা নেওয়া হয়। হযরত হুসাইনের ইমামতের প্রতি অনেকের আবেগ বা সমর্থন ছিল এই কারণেই যে, উনি রাসুলের ওয়ারিশ হিশাবে খেলাফতের হকদার, হযরত আলি যেমন ছিলেন বলে মনে করতেন অনেকেই। হযরত আবু বকর যখন সাকিফা বনু সায়েদার মজলিশে খলিফা নির্বাচিত হন, সেসময় অনেকেই এই চিন্তায়ই আচ্ছন্ন ছিলেন যে— রাসুলের ওয়ারিশই তো তার উত্তরাধিকারী হবে! হযরত আবু বকর বললেন, না। নবি-রাসুলের কোনো উত্তরাধিকারী হয় না, তার ওয়ারিশ রাইখা যান না। রাসুলের একটা হাদিসও আছে এই মর্মে। এমনকি রাসুলের কোনো পুত্র সন্তান জীবিত না থাকার হেকমতও এই বলে মনে করেন অনেকেই। রাসুলের বংশই খেলাফতের হকদার— গোড়াতেই যদি এইটা প্রতিষ্ঠিত হইত, তাইলে রাষ্ট্র ও ক্ষমতার সাথে, রাষ্ট্রতন্ত্রের সাথে, নবুয়ত যুক্ত হইত চিরদিনের জন্য; রাজতন্ত্র হইত রাসূল-প্রবর্তিত ইসলামি রাষ্ট্রের মডেল। যে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা কথা কই, তা প্রতিষ্ঠিত হইত রাসুলেরই বংশধরদের হাতে! সেটা নিশ্চয়ই ভালো কিছু হইত না।

হযরত ওসমানের শাহাদাত এই বিত্তান্তের আরেকটা গুরুতর ঘটনা, যা আমরা হয়তো মনে রাখি না। হযরত ওসমানের আমলে, আরবে `রাষ্ট্র` নামক প্রতিষ্ঠানটা তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়া হাজির হয়, সে একটা স্বয়ম্ভু সিস্টেমে পরিণত হয়। আর এর অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হইল করাপশন। কিন্তু হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ, তা কি গণমানুষের বিদ্রোহ ছিল? তারে হত্যা করা কি আইনত বৈধ ছিল? হযরত ওসমানের হত্যাকাণ্ডকে অনেকটা সেনাবিদ্রোহের সাথে তুলনা করা যায়। বেসিক্যালি কুফা ও বসরার সেনাব্যারাকের কমাণ্ডাররাই এই বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। এই হত্যাকাণ্ড ছিল এক ধরনের ক্যু, যা শুধু গৃহযুদ্ধের সূচনা করছে তাই না, পরবর্তীতে হযরত আলির খেলাফতের লেজিটিমেসিরেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে; এবং আনডাউটেডলি হযরত মুয়াবিয়ার সমর্থন বহুগুণে বাড়াইছে। এমনকি যে হযরত আয়েশা ছিলেন হযরত ওসমান প্রশাসনের কঠোর সমালোচক, তিনিও হযরত আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলেন এই ঘটনার পর।

হযরত আবু বকর বা হযরত ওমর— কেউই হাশেমি বা উমাইয়া গোত্রের লোক ছিলেন না। উনারা বরং গোত্রতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন। হযরত ওসমানের সময়ে সর্বত্র বনু উমাইয়ার লোকদের ক্ষমতায় বসানোর দাবিটাও কি সত্য ছিল? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই দাবিটা ছিল মোটাদাগে একটা `গুজব`। হযরত ওসমানের শাসনামলে, চারজন মাত্র গভর্নর ছিল বনু উমাইয়ার, যাদের একজন (হযরত মুয়াবিয়া) আবার হযরত ওমরের সময় থেকেই সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন। হ্যাঁ, হযরত ওসমানের শাসনগত কিছু দুর্বলতার সুযোগে মারওয়ানের মতো অনেক লোক যে ক্ষমতার অপব্যবহার করছিল তখন, এইটাও ভুইলা গেলে চলবে না। তারাও এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সমান দায়ী বিশেষত, ইরাকের প্রতিনিধিদলরে খুন করার আদেশ-সম্বলিত যে চিঠি মারওয়ান হযরত ওসমানের নামে সিল মেরে পাঠাইছিল, সেইটাই চূড়ান্ত সাব্যস্ত হইছিল এক্ষেত্রে।

তাইলে, মোটাদাগে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? হযরত আবু বকর আর ওমর গোত্রপ্রীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াইছিলেন; রাষ্ট্রনেতা কে হবে বা রাষ্ট্রব্যবস্থা কী হবে— তা নির্ধারণের জন্য একটা আলাপ-আলোচনাভিত্তিক মডেল তারা তৈরি করছেন। রাষ্ট্র বানানোর জন্য `ঐশী রক্ত` বা `হোলি ব্লাড`র প্রয়োজনীয়তারে তারা অস্বীকার করছিলেন, `মানুষ`র রাষ্ট্র তৈয়ারের প্রয়োজনেই। আপনি যদি খেলাফত ইস্যুতে শিয়া ও সুন্নিদের আকিদার ময়নাতদন্ত করেন, দেখবেন যে— শিয়াদের আকিদায় রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে একটা ঐশী রক্তের জরুরত, নবুয়তের মতই একটা `ইমামত` (অনেকটা ছায়া-নবুওতটাইপ), খুব জরুরি। কিন্তু সুন্নিদের মতে এইটা জরুরি না, রাষ্ট্র-পরিচালনার জন্য `নবী` বা `ছায়া-নবী`ই লাগবে, এমন না। এইটা রাষ্ট্রের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে খুব মৌলিক একটা বিষয়। তাইলে, শিয়ারা কীভাবে একটা আধুনিক রাষ্ট্র বানাইল, সুন্নিরা কেন পারল না— এই প্রশ্নের জবাব ভিন্ন। এইটা খোঁজার জন্য আবার শিয়াদের হাজার বছরের হিস্ট্রি ঘাঁটা লাগবে।

যাহোক, হযরত ওসমানের ক্ষমতা লাভ হযরত আবু বকরের গৃহীত সেই প্রকল্পেরই ধারাবাহিকতা। তার খুনের মধ্য দিয়াই গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়; এমনকি হযরত আলির লেজেটিমেসিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। হযরত আলির হাতে যারা বায়াত হন, যারা তারে খলিফা নির্বাচিত করেন, তাদের মধ্যে হযরত ওসমানের খুনীরা কি ছিল না? ছিল। ঠিক যেমন হযরত ওসমানের প্রশাসনেও দুষ্টলোক ছিল। হযরত আলি বিচারের জন্য সময় চাইছিলেন। কিন্তু অন্যরা সময় দিতে রাজি হন নাই। এরপরেই তো গৃহযুদ্ধ এবং তারই ধারাবাহিকতায় ইতিহাসের দুইটা ধারা দুইদিকে বয়ে গেল: কারবালা আর দামেশক; হুসাইন আর ইয়াযিদ; মানুশের বিদ্রোহ আর ক্ষমতার দম্ভ। মজার ব্যাপার, হযরত ওসমানের রক্তপণরে কেন্দ্র করে যে গৃহযুদ্ধের সূচনা, হযরত আলির খেলাফত বা শাসনের বিরুদ্ধে দিকে দিকে যে `বিদ্রোহ`, তারেই আবার ইসলামের নামে `নাজায়েজ` বানানোর ন্যারেটিভ তৈয়ার করা হইছে হযরত হুসাইনের ক্ষেত্রে; আর তৈরি করছেন এই উমাইয়ারাই। `শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ` ফেনোমেনাটিরে, ফলে, খুব গভীরভাবে পাঠ করার অবকাশ থেকে যায়। সর্বোপরি মনে রাখা জরুরি যে:

১. ইসলামি খেলাফতের ধারা শুরু হইছিল এই রাজতন্ত্র এবং হোলি ব্লাডের কর্তৃত্বের স্বভাবজাত ধারণারে নাকচ কইরাই। ফলে, রাজতন্ত্র কোনমতেই খেলাফতি শাসনের মডেল হইতে পারে না।

২. হোলি ব্লাডের ধারণারে নাকচ কইরা যাত্রা শুরু করা `মানুশের শাসন`র ধারাবাহিকতায়ই শাসনক্ষমতা পাইছিলেন হযরত ওসমান। নিজে আগ্রহী হইয়া, কোন কর্তৃত্ব বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, বনু উমাইয়ার কর্তৃত্বপ্রতিষ্ঠার নীল নকশা নিয়া উনি ক্ষমতায় আসেন নাই— এইটুকু পষ্ট। ওনার খুনের বিরুদ্ধে ছিলেন হযরত আলি নিজেও। কিন্তু, অপ্রয়োজনীয় সেনাবিদ্রোহের মাধ্যমে একজন বৈধ শাসককে খুন করাই ছিল এই মর্মান্তিক সাগার প্রথম গুরুতর ভুল। মূলত, ওসমান-প্রশাসনের দুষ্ট লোকজন এবং বিদ্রোহী গ্রুপ— সকলেই এই বৃদ্ধ নেতার নানারকম দুর্বলতার সুযোগটা নিতে চাইছেন। কারবালার মৃত্যুর সমান্তরালে যদি আমরা হযরত ওসমানের মরণরে পাঠ করতে না পারি, তাইলে অনেকগুলা মুশকিল আমরা বুঝব না।

৩. হযরত ওসমানের খুনের পরে, হযরত আলি চাইতে বা না চাইতে তার খুনীদের আশ্রয়স্থল হইছিলেন। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা ভুইলা গেলে চলবে না। হযরত মুয়াবিয়ার কথা যদি বাদও দিই, মক্কায় হযরত আয়েশা, হযরত তালহা ও হযরত যুবায়েরের নেতৃত্বে লোকজনের একটা বড় অংশই এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুততম বিচারের পক্ষে ছিলেন। ফলে, দোষ যদি দিতেই চান কেউ, শুধুমাত্র হযরত মুয়াবিয়াকে এইক্ষেত্রে দোষ দেওয়া চলে না।

৪. হযরত মুয়াবিয়ার জীবনের গুরুতর ভুল ইচ্ছা/সিদ্ধান্ত ছিল ইয়াযিদের মনোনয়ন। যতভাবেই এই ব্যাপারটাকে জাস্টিফাই করা হউক না কেন, এটিই ছিল ইসলামের ইতিহাসে রাজতন্ত্র কায়েমের প্রথম ভিত্তি, অস্বীকারের উপায় নাই। কিন্তু, রাজতন্ত্রের বাইরে রাষ্ট্রব্যবস্থার যে সম্ভাবনা প্রথম চার খলিফা দেখাইছিলেন, মুয়াবিয়া যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় না-ও আসতেন, সেই সম্ভাবনা কি তার অপনেন্টরা ধইরা রাখতে পারতেন?

৫. নজর একটু চোখা করেন, কী দেখতে পান? সেসময় হযরত মুয়াবিয়া আর হযরত আলি— এই দুই নেতার বংশরে কেন্দ্র কইরাই ক্ষমতা ঘুরতেছে। হয় আলি নয় মুয়াবিয়া, হয় ইয়াজিদ নতুবা হুসাইন। যদি হযরত হুসাইন ক্ষমতা লাভ করতেন, আর তার সুবাদে বনু হাশিমের রাজতন্ত্র জারি হইত (এবং সেটা খুবই সম্ভব ছিল; অন্তত পরবর্তীতে বনু আব্বাসের শাসনে তার পসিবলিটির নজির তো দেখি আমরা), তাইলে আজকে কারবালার ইতিহাস আমরা ভিন্নভাবে পড়তাম, হয়ত। যদিও, একথা অস্বীকারের উপায় নাই যে, হযরত আলি ও হযরত হুসাইন ক্ষমতার প্রশ্নে, মীমাংসার প্রশ্নে যতটুকু ছাড় দিতে চাইছেন, হযরত মুয়বিয়া বা ইয়াযিদ ততটা দেন নাই। এই সত্য মানা লাগবে।

ক্ষমতারে বারবার প্রশ্ন করা লাগে, মোকাবেলা করা লাগে— তাই কারবালা ঘুরে ঘুরে আসে। হযরত হুসাইন আমাদের সামনে থাকেন। আমরা সবাই হুসাইনি কাফেলার মানুশই হইতে চাই। কিন্তু কারবালার অর্থ আর মর্ম ভুইলা গেলে চলে না। কারবালা ক্ষমতার ক্রিটিক করতে চায়, কারবালা `মানুশের ন্যায়সঙ্গত বিদ্রোহ`র কথা বলে; কারবালা যেকোন `হোলি ব্লাড`র হাতে মানুশের যিম্মি হয়ে পড়ার সম্ভাবনার বিরুদ্ধে কথা বলে। এটুকু মনে রাখা জরুরি।