গবেষণা বা লেখালেখি প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯

গত মাসের ত্রিশ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত বাসদের একটা আড্ডা আর দুপুরের খাওয়া দাওয়ার অনুষ্ঠান ছিল। খুব সুন্দর একটা অনুষ্ঠান ছিলো সেটা। বহু ধরনের মানুষ এসেছিলেন, বিভিন্ন কিছুর সঙ্গে যারা যুক্ত। হঠাৎ আমার পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডা চলছে, তখন একজন বললেন, ‘রাহমান ভাই ইদানীং প্রচুর লিখছেন, আমার ভালো লাগে ওনার এই একটানা লিখে যাওয়া।’ কিছুক্ষণ পর প্রসঙ্গক্রমে অন্য একজন বললেন, ‘রাহমান ভাইর গত মাসেই দু’দুটা পত্রিকায় দুটা গবেষণা প্রবন্ধ ছাপা হলো জিন্নাহকে নিয়ে, তিনি আবার মালয়েশিয়ার উপর এশিয়াটিক সোসাইটিতে একটা বক্তৃতা দিলেন আগস্ট মাসে। কাশ্মির নিয়ে ধারাবাহিক লিখছেন, ফেসবুকে। নাটক নিয়ে লিখেছেন দুটা বড় লেখা ফেসবুকে। দুমাসে প্রচুর লিখেছেন তিনি। ইদানীং রাহমান ভাইর লিখবার ক্ষমতা বেড়ে গেছে। খুব দ্রুত অনেক কিছু লিখে ফেলছেন।’ কথাগুলি সঠিক। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় ভিন্ন জায়গায়। যখন একজন লেখক দুমাসে একটা বা দশটা লেখা নিয়ে উপস্থিত হন, ব্যাপারটা কি এই যে, তিনি দুমাসেই লেখাটা লিখেছেন? না, সবসময় তা নয়। দুমাস ধরে মানুষটা যা লিখেছেন, দেখা যাবে তার আগে দু’বছর ধরে তা নিয়ে ভেবেছেন। ফলে যে লেখাটা উপস্থাপন করা হয় দুদিনে বা দুমাসে বা দুবছরে, দেখা যাবে তার পিছনে রয়েছে ত্রিশ চল্লিশ বছরের চিন্তা, পড়াশুনা আর গবেষণা।

যারা আমার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, সকলের কথার মধ্যে প্রশংসাই ছিল। কিন্তু বিষয়টা হলো এই, গত চল্লিশ বছরের অধিক সময় ধরে যা কিছু পড়েছি, চিন্তাভাবনা করেছি বর্তমানের লেখাগুলি তারই নির্যাস। ব্যাপারটা এই নয় যে, লেখাগুলির মধ্যে কিছুই নেই যা তাৎক্ষণিকভাবে লেখা। হয়তো অনেক লেখাই তাৎক্ষণিক, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিটা গত চল্লিশ বছর ধরে গড়ে উঠেছে। চল্লিশ বছর ধরে গড়ে ওঠা দৃষ্টিভঙ্গি, চল্লিশ বছর ধরে পড়াশুনা, নানারকম প্রাপ্ত তথ্য; সেগুলির বিচারেই চূড়ান্ত চিন্তাটা দাঁড়ায়। সবসময় যে সেই মতাদর্শ একইরকমভাবে স্পষ্ট করে তোলা যায়, তাও না। প্রতিটি মানুষের লেখার পিছনে এরকম একটা ইতিহাস বা সময়কাল থাকবে। বিশেষ করে যেগুলি গবেষণাধর্মী লেখা। বিরোধ এড়াবার জন্য পাঠকদের বলে নিতে চাই, সব ধরনের লেখা নিয়ে আমার এ মন্তব্য নয়। বিশেষ একজন ব্যক্তিকে চিনি, তিনি নিজের যোগ্যতার কারণেই বড় একটা পদে বসার পর চার বছরে তেরোটা বই লিখে ফেলেছেন। বিশেষ একজন প্রকাশকও আছে তার। তার বন্ধুরা অনেকে আবার তার বই কেনেন, কমবেশি পাঠকও আছে ওনার; ফলে প্রকাশক খুশি। প্রসঙ্গক্রমে একদিন তাকে বলেই ফেললাম, আমি তেরো বছরে চারটা বই লিখেছি আর আপনি চার বছরে তেরোটা। অনেক বছর আগের কথা সেটা। তিনি হেসে দিয়ে বললেন, শুনুন আমি গবেষণা গ্রন্থ লিখি না। তিনি সজ্জন মানুষ, বাসায় বসে অবসর সময়ে লিখে যাচ্ছেন। এইভাবে লিখতে পারাটাও একটা গুণ।

কথাটা এই যে, যখন লেখার ভিতরে তথ্য দিতে হয়, লেখার অনেক বক্তব্য প্রমাণ করতে হয়, চাইলেই টেবিলে বসে সঙ্গে সঙ্গে সেরকম লেখা দাঁড় করানো যায় না। গল্প লেখা সম্ভব, কবিতা লেখা সম্ভব, ভ্রমণ কাহিনি লেখা সম্ভব; সেখানে কিছু প্রমাণ করার নেই। রবীন্দ্রনাথকে পোস্টমাস্টার গল্পে প্রমাণ করতে হবে না যে, সেই গ্রামে সেই পোস্টমাস্টার ছিলেন কিনা আর রতন নামে তাকে কাজে সাহায্য করার জন্য সত্যি কেউ ছিলো কি না। কদিন আগে একজন লিখেছেন, শাড়ির দাম দেড়শো থেকে দেড়লাখ হলে, সব বইয়ের দাম পৃষ্ঠা গুণে একরকম হবে কেন? কথাটার যুক্তি আছে। যিনি একটি গবেষণা বই লিখতে তিন বছর সময় নিয়ে দুলাখ টাকা খরচ করে তথ্য জোগাড় করেছেন, দেখা গেল পৃষ্ঠার হিসেবে বই লিখে তিনি পেলেন ত্রিশ হাজার টাকা। আর একমাসে একজন একটি উপন্যাস লিখে পৃষ্ঠার হিসাবে পেলেন ত্রিশ হাজার টাকা। ব্যাপারটা কী দাঁড়ায় তাহলে? ত্রিশ হাজার টাকাটা হাতে সকলে পান কি না সেটাও প্রশ্ন। যদিও আমার মূল আলোচনা সেটা নয়। কথাটা হলো, যিনি গবেষণা করে একটা লেখা লিখেছেন, তিনি সে বিষয়ে দুশোটা বই পড়ে সবার মন্তব্য, সব তথ্য দেখে নিজের কথাটা লিখলেন। ভিন্ন একজন সে বিষয়ে মাত্র একটা বই পড়ে তার লেখার ভুল ধরতে শুরু করলেন। তিনি একটা বই পড়ে বিদ্যা জাহির করতে থাকলেন।

ধরা যাক, সিরাজদৌলা সম্পর্কে একজন একটা বই পড়লেন, ‘সিরাজ খুব নারী ললুপ, ভোগী আর অত্যাচারী ছিলেন। ফলে তার পতন দরকার ছিল। সিরাজদৌলার পতনের মধ্য দিয়ে ভারতে ইংরেজরা আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ে এসেছে।’ ভিন্ন একজন আবার সিরাজদৌলা সম্পর্কে বিভিন্ন বই পাঠ করে লিখলেন ঠিক বিপরীত কথা। যিনি একটা বই পড়েছেন, যা প্রবাদে রয়েছে অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর, দেখা গেল অন্যের গবেষণাধর্মী লেখাটা পড়ে যখন তার পড়া একটা বা দুইটা বইয়ের চিন্তার সঙ্গে মিললো না, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভয়ঙ্কর বিদ্যা ফলাতে শুরু করলেন। বুঝতে চাইলেন না, বিশেষজ্ঞ হিসেবে একজন যা লিখেছেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হলে নিজেকে কিছুটা বিশেষজ্ঞ হতে হয়। সব চিন্তার বিপরীত চিন্তাগুলি সম্পর্কেও জানতে হয়। ফলে ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান নিয়ে লেখার ব্যাপারটা ততটা সহজ নয়। বহু বছর ধরে পড়াশুনা করার পর সঠিকভাবে তার চরিত্রের অনেকটা বোঝা যায়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, মহৎ উপন্যাস আর নাটক লেখার কাজটা সবসময় খুব সহজ। মহৎ কোনো সৃষ্টিই সহজ ব্যাপার নয়। মূল কথাটা হলো, বইটা আপনি দু’ঘণ্টায় পড়ে শেষ করেছেন, সেটা দুঘণ্টায় লেখা হয়নি। চলচ্চিত্রটি দেখতে তিনঘণ্টা লাগতে পারে, বানাতে বছর লেগে গেছে। সবাইকে বলবো আক্ষরিকভাবে নয়, আমার কথার ভাবটা ধরতে।

মানুষ এক রাতে একটা লেখা দাঁড় করিয়ে ফেলছেন মানে সেটা এক রাতের লেখা নয়, এক রাতে লিখতে পারছেন কারণ হয়তো এর আগে এক হাজার রাত ভেবেছেন। জিন্নাহকে নিয়ে আমার যে লেখাগুলি বের হয়েছে, আসলে এগুলি লিখবার জন্য চিন্তা শুরু করেছি গত দু’দশকের বেশি সময় ধরে। বিভিন্ন সময়ে মানুষ যা পড়াশনা করেন, চিন্তা ভাবনা করেন, হয়তো বহু পরে দেখা গেল তিনি সেসব চর্চার বিষয় নিয়ে একটা কিছু লিখে ফেললেন দশ দিনে। কিন্তু দশ দিনের লেখা সেটা নয়, পিছনে রয়েছে বহু বছরের চিন্তা ভাবনা। বহু মানুষ রয়েছেন, যারা প্রচুর পড়াশুনা করেন কিন্তু লেখালেখি করেন না। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক প্রচুর পড়াশুনা করতেন কিন্তু লিখতেন না। লিখেছেন আমার জানা মতে দু-একটা প্রবন্ধ। প্রচুর পাঠক রয়েছেন, যারা লেখালেখি করেন না কিন্তু প্রচুর প্রচুর গ্রন্থ পাঠ করেন। প্রচুর লেখক রয়েছেন যারা আবার পড়শুনা করেন না, কেউ কেউ পড়াশুনার দরকার আছে বলে মনে করেন না। লালনের উদাহরণ দিয়ে বসেন। কিছু মানুষ অবশ্য পড়াশুনা তেমন করেননি, নিজেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় বড় মাপের লেখা লিখেছেন। কিন্তু লেখালেখির জন্য আসলে প্রচুর পড়াশুনা করা দরকার। বিশেষ করে গবেষণামূলক প্রবন্ধ, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা না করে, প্রচুর চিন্তা ভাবনা না করে লেখা সম্ভব নয়।

কিছু ছাত্রছাত্রী আমাকে বলেন যে, তারা লেখালেখি করতে চান। কেউ কেউ গবেষণা করতে চান। সবসময় তাদেরকে আমি বলি, আগে পড়ার অভ্যাস করুন। প্রচুর পড়ার অভ্যাস করুন আগে। লিখতে থাকেন নিজের ভাবনাগুলি নিয়ে, প্রকাশের জন্য নয়; নিজের ভাবনাগুলি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করে মতামত জানার জন্য। সবসময় বলি ভালো লেখার এবং ভালো পাঠক হবার জন্য মুক্তভাবে চিন্তার অভ্যাস করুন। সব ব্যাপারে মুক্ত মন তৈরি করুন, নিজেদের পুরানো বিশ্বাসগুলিকে বেশি আক্রে থাকবেন না। নতুন চিন্তাগুলি গ্রহণ করার দরকার নেই, কিন্তু সেগুলি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে দেখেন, সেখানে সঠিক কিছু থাকতে পারে। দেখা যায় তারা কয়েকটা বই হয়তো পড়েছেন, কিন্তু মনে করেন অনেক পড়া হয়ে গেছে। খুব দ্রুত কিছু একটা করে ফেলতে চান। ফলে সবসময় আমার কথার উপর আস্থা রাখতে পারেন যে তা নয়। সবকিছুর জন্য যে একটা প্রস্তুতি দরকার, বেশ অনেকটা সময় দেয়া দরকার, এটা যেন মানতে কষ্ট হয় তাদের অনেকের। আমি অনেক সময় তাদেরকে এটাও বলি, ‘প্রশিক্ষণ যত কঠিন হবে, যুদ্ধ তত সহজ হবে।’ কিন্তু আমাদের সমাজে বহু কিছু অনেকে সহজে পাওয়া যায় বলেই কি, তারা এমন অস্থির হয়ে থাকেন দ্রুত সবকিছু পাবার জন্য? মনে আছে, একবার একজন বলে বসলেন ‘আর কত পড়বো। অনেক পড়েছি।’ যাদের লেখা পড়েছেন, তাদের কয়েকজন নাম বললেন। চুপ করে থাকলাম, কারণ ছেলেটির প্রতিভা আছে। কিন্তু প্রতিভাকে প্রকাশ করার পথটা চিনতে পারছেন না। কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘স্যার, আপনার কত বই কত লেখা। কতরকম কিছু লিখছেন।’ বললাম, ‘এর জন্য আমার শুধু চল্লিশ বছরের বেশি সময় পড়াশুনাই করতে হয়েছে। আপনার বয়সই এখনো পঁচিশ হয়নি।’