গাজী কামরুল হাসানের গল্প ‘ক্যাকটাসের কাঁটা’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : অক্টোবর ১১, ২০২১

শাহানা নতুন অফিসে কাজ শুরু করেছে। অফিসটা বেশ বড়। সারাদিন ক্লায়েন্টদের ভিড় লেগে থাকে। তার কাজ ফরেন এক্সচেইঞ্জ সেকশনে। তাদের শাখার ম্যানেজার কাকলী চৌধুরী অনেক হাসিখুশি। গল্প করতে ভালোবাসেন। জয়েন করার দিন সাড়ে নয়টার দিকে ম্যাডামের রুমে গিয়েছিল শাহানা। ব্যাংক তখন বলতে গেলে খালি। দিনের কাজ শুরু হবে হবে করছে। ম্যানেজারের রুমে কয়েকজন সিনিয়র কলিগ চায়ের কাপ নিয়ে বসে ম্যাডামের গল্প শুনছিলেন আর হাসছিলেন।

শাহানাকে একটা চেয়ারে বসতে বলে ম্যাডাম টেবিলে রাখা বেলে চাপ দিলেন, চা না কফি?
চা ম্যাডাম।
এক কাপ চা আর কয়েকটা ড্রাই কেক নিয়ে আসে নজরুল।
শাহানা নাসরিন?
জ্বি ম্যাডাম?
ম্যাডাম বলতে হবে না, নিজেকে প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী লাগে। হা হা হা... আপা বললেই চলবে। তা, এম আই এসএস নাকি এম আর এস না এম আই জেড?
জি, এম আই এস এস আপা।
ও বুঝছি; আমার অবস্থা তোমার মতোই ছিল। পাশ করার পর ঠাস করে চাকরি পেয়ে গেলাম। কিন্তু ও ওইদিকে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো চাকরি বাকরি পাচ্ছে না। এদিকে তিন-চার বছর হয়ে গেছে। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, অফিসের কলিগ সবাই শ’খানেক করে প্রস্তাব নিয়ে আসে। আকার ইঙ্গিতে সম্পর্ক ভাঙতে বলে। আর আমি আঁঠার মতো লেগে আছি...হা হা হা।

সামনে তাকিয়ে দেখে রুমের সবার মুখে হাসি লেগে আছে। সব মানুষ মনে হয় একই বৃত্তের মধ্যে চিন্তা করে। শাহানা হালকা করে একটু হেসে ফেলল।
না মানে...
হয়েছে, আর বলতে হবে না। লেগে থাকার মতো হলে লেগে থাকো। আর আপনাদেরও বলে দিচ্ছি, যদি শুনতে পাই, প্রস্তাব এনে এনে একে জ্বালাতে শুরু করেছেন তাহলে এমন কাজ দেব, ছুটির তিন ঘন্টা পরও বাসার মুখ দেখতে পারবেন না। বুঝেছেন?

আপার হুমকি নাকি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ততা, কে জানে! কেউ আর কিছু জানতে চায়নি। যে যা ভাবে ভাবুক, তার তো সমস্যা হচ্ছে না। এরপর অফিসের সবার সাথে শাহানা বেশ তাড়াতাড়ি সহজ হয়ে যায়। অবশ্য বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে। সবার সাথেই। মনে মনে হেসে ফেলে শাহানা। মানুষের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করার কোনো প্রতিযোগিতা থাকলে তাকে মনে হয় না কেউ কোনোদিন হারাতে পারত।

অফিস শেষে শাহানা আড়ং থেকে একটা শাড়ি আর সুন্দর সুন্দর কয়েকটা কাঠের শোপিস কিনল। বইয়ের দোকান থেকে ইংরেজি আর বাংলার বেশ কিছু গল্পের বই নিয়ে সবকিছু কাগজের বাকসে ভরে সে সবিতা আপার ঠিকানায় পার্সেল করে দেয়। টুকিটাকি কেনাকাটা শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে তার সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। ফ্লাটের বাকিরা এখনও বাসায় ফেরে নাই। রান্নাঘরের ছোট একটা ফ্রিজে সবার জন্য কেনা আইস্ক্রিমের বাটিটা রেখে শাহানা নিজের রুমে ঢুকল। ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বার করে দেখে একটা মিসকল এসেছে, সবিতা আপার।

তোমার জন্য কয়েকটা বই পার্সেল করেছি। দুই একদিনের মধ্যে পৌঁছে যাবে।
কয়েকটা বইই শুধু। আর কি কি পাঠিয়েছিস? বল?
এই তো, বেশি কিছু না। একটা মাত্র শাড়ি আর কয়েকটা শোপিস...
আবার কেন? মাসখানেক আগেই কয়েকটা পাঠিয়েছিলি। তোর জ্বালায় আলমারিতে কোনো জায়গা নেই। একটা মানুষের কতগুলো শাড়ি লাগে?
ঠিক আছে, আগামীবার একটা আলমারি পাঠাবো। একটু বড় হয়ে যাবে পার্সেলটা, এই আর কি?
দেখ, ফাজলামো করবি না!
হিহিহি... এত চিন্তার কি আছে। বেশি হয়ে গেলে কয়েকদিন পড়ে ছাত্রীদের মধ্যে বিলিয়ে দিও।
হু।
কি?
ভাবছি আসছে ছুটিতে ঢাকায় আসব। তোর নতুন বাসায় বেড়াতে।
চলে আসো। তোমার আছে খালি মুখের কথা। সেই ভার্সিটিতে পড়তে কবে এক-দুইবার এসেছিলে; তারপর এই পাঁচ বছরে একবারের জন্যও আর আসনি। রিটায়েরমেন্টের পর তোমাকে আমার কাছে বেঁধে রেখে দেব।
অনেক হয়েছে, এখন রাখলাম রে। তোর রাতের খাবার দেয়ার সময় হয়েছে না? যা খেয়ে নে।

পৃথিবীর সবার মধ্যে সবিতা আপা শাহানার সবচেয়ে বেশি আপন। গতবার বছরে সম্পর্কটা কবে আপনি আর তুমি থেকে তুমি আর তুই হয়ে গেছে তা নিজেও জানে না। প্রায়ই ভাবে, নিঃসন্তান এই দুঃখী মানুষটার মমতাটুকু না পেলে কোথায় গিয়ে যে তাকে এখন দাঁড়াতে হতো, কে জানে! চলবে