গুলতেকিন আহমেদ

গুলতেকিন আহমেদ

গুলতেকিন উদাহরণ তৈরি করেছেন, তাকে সালাম

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৪, ২০১৯

একবার এক অনুষ্ঠানে আমার বক্তব্য শুনে নারীবাদীরা বেশ রেগে গিয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য খণ্ডন করতে গিয়েই এই বিপত্তি। উনাদের কথা ছিল, উনারা কেউ আশি হাজার আবার কেউ লক্ষাধিক টাকা আয় করেন, নিজের কেনা গাড়ি নিজেই চালিয়ে কর্মস্থলে যান। তারপরেও তাদের মুক্তি হচ্ছে না।

আমি বলেছিলাম, নারীমুক্তি কোনও ট্রফি না যে কাঁটাবন থেকে কিনে এনে আপনাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া যাবে। নারীমুক্তি আপনাদের ব্যক্তিগত বিষয়ও না, এটা একটা সমাজের অবকাঠামোগত একটি ধারণার মধ্যে পরিবর্তন আনার সংগ্রাম। সেটা আপনার বা আমার নিজস্ব জীবনযাপনের স্বাধীনতার উপরে নির্ভর করে দাঁড়াবে না।

আপনারা সমাজের একদম প্রথম সারির দিকের মানুষ এবং সমাজের বহু বহু পুরুষের চেয়ে আপনাদের আয় ও সম্মান অনেক বেশি। আপনি একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে যে সুবিধা ভোগ করছেন, সেটা অনেক পুরুষও পাচ্ছে না। তাহলে মানে গিয়ে দাঁড়ালো, আপনাকে দাবিয়ে রাখছে সমাজের সেই সব পুরুষ বা পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা যারা আপনার মতো সমাজের আরো বহু পুরুষকেও দাবিয়ে রাখছে। কথা তো পরিষ্কার।

আপনি লক্ষাধিক টাকা আয় করবেন তারপরেও আপনার জন্য একজন পুরুষের উপরে নির্ভর করা অত্যন্ত জরুরি। তাহলে যেসব নারীরা সামান্য আয় করে তারা কেন তাদের বাড়ির পুরুষদের সব অত্যাচার মেনে নেবে না, সেটা বলতে পারেন? আপনি ভালো আয় করে, ভালো খেয়ে পরেও সন্তানের কথা ভেবে, তথাকথিত সমাজে নিজের সম্মানের কথা ভেবে নাকে কেঁদে কেঁদে বলছেন, আমার মুক্তি নাই। নারীরা তোমরা জাগো, আমাকে মুক্ত করো। কারা আপনাকে মুক্ত করবে হে ভগিনীগণ, আপনারা যাদের সমাজের নিচের দিকের নারী মনে করে অবমূল্যায়ন করেন?

নারীমুক্তি একটা সামাজিক আন্দোলন, যার মূল বিষয় হল সমাজে পুরুষের সাথে নারীর সহাবস্থান নিশ্চিত করা। এখানে নারীর প্রতিপক্ষ পুরুষ না, বরং নারীর প্রতি একটি নেতিবাচক ধারণা। আবার পুরুষের সাথে সহাবস্থান নিশ্চিত করা মানে, পুরুষরা যেসব অন্যায় করছে, সেগুলো নারীরাও করতে পারবে, সেটাও না।

কাউকে খুন করা অন্যায় বা রাস্তায় সিগারেট খাওয়া ভালো নয় বা পরিবারের প্রতি অযত্ন করা ঠিক না। সেখানে সবারই সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু মনের মতো সঙ্গী নির্বাচন করা অন্যায় হতে পারে না। এখানে পুরুষের যেমন অধিকার আছে, নারীরও আছে। সমাজের কথা চিন্তা করে, সন্তানের কথা চিন্তা করে দিনের পর দিন একটা অসুখী বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা বা রাতের পর রাত বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের কষ্ট আমরা কেউ বুঝি না। আমরা কেবল ঠিক করে দিই, তাদের কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়।

এই ধারণার জায়গা থেকে আমাদের অবশ্যই সরে আসতে হবে। তবে সেটা একদিনে হবে না, ধীরে ধীরে আমাদের সমাজের মানুষের ধ্যান-ধারণা পাল্টাতে হবে। আর সভা সেমিনারে বসে কান্নাকাটি করে না, সমাজের অগ্রসর নারীদের বাস্তব জীবনে সাহসী ভূমিকা পালন করে উদাহরণ তৈরি করতে হবে।

গতকাল থেকে নিউজফিডে গুলতেকিন খানের বিয়ের খবর আসছে। দেখে আমি আপ্লুত হয়েছি। অনেকেই বলছেন, এই বয়সে উনার বিয়ের প্রয়োজন ছিল না। কেন ছিল না বলতে পারবেন? কে আপনাদের সেটা নির্ধারণ করার অধিকার দিয়েছে? মানুষের যেকোনও বয়সেই সঙ্গী দরকার হতে পারে, তার সে অধিকারও আছে।

শান্তি পাচ্ছি, স্বস্তি পাচ্ছি, সাহসও পাচ্ছি। অন্তত গুলতেকিন আমাদের সেই বদ্ধমূল ধ্যান ধারণা ভেঙে একটি সত্যিকারের সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। উনি অনেক নারীকে বেঁচে থাকার একটি সুন্দর পথ দেখিয়ে যে উদাহরণ তৈরি করেছেন, তার জন্য তাকে হাজার সালাম।

লেখক: গল্পকার ও গণমাধ্যমকর্মী