গেম অফ থ্রোন

চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৭, ২০১৯

বৈশাখি খর দাবদাহ, ঢাকার ভয়াবহ হৃদয় বিমারি দুষন, ভোগ্যপন্যের আগুন-মুল্য ও পুলিশি দুর্নিতিতে সন্ত্রস্ত রাজধানিবাসিদের বিশ্ববিচ্ছিন্ন গনমাধ্যমের মাদ্রাসা কিলিং, বার্নিং ও রাজনিতিক মহাসাগরচুরির ভেতর গত রাতে আক্ষরিক ভাবে আমারে দু দন্ড শান্তি দিয়েছিলো `গেম অফ থ্রোনে`র সিজন ফিনালে।

মহাকাব্যের মাস্টার জর্জ আর, আর মার্টিন যেরকম পরিবেশক, প্রযোজক, নির্দেশক নির্বাচন করেছিলো শতাংশে ঠিকঠাক, বছরের পর বছর তারাও চিত্রনাট্যকে রেখেছে টানটান আর অভিনেতা, অভিনেত্রিরা তো সর্বশ্রেষ্ঠ ক্যানভাসে সর্বোত্তম ছলাকলাকুশলতার বহুমাত্রিক ওস্তাদ! নয়ন, শ্রবন তো তৃপ্তের তৃপ্ত, এমন কি দেশি ও উপমহাদেশিও ডট ডট সেন্সর-দুষনের ভেতরেও! উপমহাদেশের দম আটকানো জনসংখ্যা বলে দেয় এখানে ঘাটে, অঘাটে তুমুল যৌনতা চলছে, কিন্তু সে যৌনতাকে পর্দায় আনলেই সমাজ পুরোহিতদের ভ্রুকুটি। যৌন আচরন, যৌন শিক্ষার প্রতি ট্যাবু প্রতিফলনেই কি শিল্পের বিমুর্ততা, লিংগরহিত যাদু বাস্তবতা ও শিল্পকে পর্দার আড়ালে নিতে, নিতে পর্দানশিনদের ধর্শন ও হত্যার হোলি?

বুড়ো জর্জ মার্টিনকে মহাকাব্যের মাস্টার বলেছি। প্রথমে বাজারে আসে ঢাউশ, ঢাউশ বইগুলো। কিশোর মাতিস-জ্যোতি আর ওর মা প্যাট্রিসিয়া ফরাসি ও ইংরেজিতে পড়তে থাকে গোগ্রাসে। শুনতে শুনতে বুঝতে পারছিলাম যে এর পাতায়, পাতায় মহাভারত, রামায়ন, ইলিয়াড, গিলগামেশ, তাওরাত, ইঞ্জিল, কুরান, ঠাকুর মার ঝুলি! এখানে যে-সিংহাসন ঘিরে মারন খেলা প্রতিকিভাবে তা লোহার তৈরিঃ এর হেলানের দিকটা শত, শত বর্শার ফলায় ধারালো চোক্ষা; এতে বসা অস্বস্তিকর; আবার এতে বসার তাড়না, বাসনা সে-অস্বস্তিকে ছাড়িয়ে মাদকের ঘোর তৈরি করে। এ-সিংহাসনের নাম আয়রন থ্রোন। এ সিংহাসনে আসিন হবার এবং উত্তরাধিকার সু্ত্রে তা বজায় রাখবার নিমিত্তে যেসব যুদ্ধ তার পেছনে টাকা যোগায় আয়রন ব্যাঙ্ক। এই ব্যাঙ্ক একই সময় বিবদমান কয়েকজনের পেছনে পয়সা যোগায়। যে জিতবে তাকে সুদাসলে তা শোধ দিতে হবে।

ধরেন, ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে, কথিত পাক, পবিত্র, ন্যায়যুদ্ধে আপনি জয়ি হলেন; ভাবলেন জনগনের কর নেবো এবং সুখেশান্তিতে উন্নয়ন করবো। কিন্তু দূর থেকে চিনাদের আয়রন ব্যাঙ্ক পাকিস্তানিদের হাত দিয়ে রোহিঙ্গাদের উস্কে দিলো, আবার রোহিঙ্গারা বর্মি বৈষম্য নিতির শিকার হওয়াতে চিনা আয়রন ব্যাঙ্কের আরো পোয়া বারো, ভারতের সিমান্তে আরো কয়েক লাখ দাস সৈনিক পাওয়া গেলো। চিল্ড্রেন অফ দা ফরেস্ট, নিশাচর, প্রেত-পথচারিদের বাহিনি, আগুন ঝরা ড্রাগন, রাজকুমার-রাজকুমারিদের বুনট জালে সাধারনের উত্থান ও পতন কাহিনির দর্পনে আমরা আমাদের চারপাশের গল্পগুলোর ছায়া, অপছায়াদের দেখতে পাই।

ট্রয়ের যুদ্ধের ইঙ্গিতের ভেতর বাংলাদেশের স্বাধিনতা যুদ্ধের ইশারা আমাদের হাতছানি দেয় জর্জ মার্টিনের এই মহাকাব্যে। যে-ইশারাতে পরাজিত শত্রুপক্ষ, গনহত্যার কুশিলবেরা বিবিধ টাল বাহানায় বিজয়ির প্রাগ্রসর পথযাত্রায় অনবরত ছিটাতে থাকে মৌলবাদের বিষবাস্প, মার্টিনের কাহিনিতে এই মোল্লাদের আমিরের নাম হাই-সেপ্টা, এই হাই-সেপ্টা এমন ভাবে পরকালের ভিতিবোধ জারি করে, যা ইহকালের শাষকের পাশবিকতাকে ছাড়িয়ে যায়। এর ভেতর জনগনও অপেক্ষাকৃত উন্নত শাষনের জন্য এক রাজ তরবারি ছেড়ে আরেক রাজ তরবারির দিকে যায়। সিংহাসনচ্যুত রাজকুমারি ডেইনিরিস টারজারিয়েনের পাশে এসে দাড়ায় ভয়াবহ আদিবাসি ডোথ্রাকি সম্প্রদায় ও নপুংসক দাস সৈনিকেরা। অন্যদিকে কথিত যারজ জন স্নোকে রাজন বলে তার পাশে ঝান্ডা উচিয়ে দেয় উত্তরের হিমেল বির ও বিরাঙ্গনারা। সাব টেক্সটে একের পর এক হৃদয়বিদারি সাদাকালো, ভালমন্দের চড়াই উত্রাইর ভেতর এগিয়ে যায় জন ও ডেইনিরিসের যুগলবন্দি!

যাদুবাস্তবতায় আমাদের সময় লিখেছে মার্কেজ, ইসাবেল আলেন্দে, সালমান রুশদি। শিশু রুপকথায় `হ্যারি পটার` দিয়ে বিশ্ব মাতিয়েছে জে, কে রাওলিং। `হ্যারি পটারে`র সাহিত্য ও চিত্রনাট্যের সফলতার পেছনে কাজ করেছে সাহিত্য ও সিনেমার সাইনার্জি। সর্বোত্তম দক্ষতার চিত্রনাট্যকারেরা প্রতিটি ধাপে জর্জ মার্টিনের প্রতিটি অক্ষর মনে রেখেছে। স্ববিশেষে `গেম অফ থ্রোন` সাহিত্য ও সিনেমা দুটো ভিন্ন মাধ্যম। তবে যারা পড়েছে, তারা সিনেমা চরিত্রের রুপায়নে পাঠ অনুভুতির প্রতিফলন পেয়েছে। এরকম দুজন দর্শকের পাশাপাশি আমি সিনেমাটি দেখেছি। মাতিস-জ্যোতির কথা আগে বলেছি, অপর জন সোমা। দুজন দুই প্রজন্মের, দুই সংস্কৃতির ভিন্নতা থেকে `গেম অফ থ্রোন` পড়েছে, দেখেছে। দুজনেই মহাকাব্যিক খুটিনাটি বা ডিটেইলগুলো সাহিত্যের পরিসরে এবং সেলুলয়েডের দোলাচলে আদ্যপান্ত মনে রেখেছে, পর্বান্তরের তুলনামুলকতায় সন্তুষ্ট থেকেছে।

মহাকাব্য বা এপিক বিভিন্ন কাঠামোতে সাহিত্য, সিনেমা, চিত্রকলায় এসেছে। ব্রেখট এপিক ফর্মে কাজ করেছে নাটকে; সত্যজিত রায় করেছে চলচ্চিত্রে; হেমিংওয়ে, গর্কি, পাস্তেরনাক, পামুক করেছে উপন্যাসে, মিয়াজাকি করেছে এনিমেশানে, জয়নুল করেছে পেইন্টিংএ। এপিক যে শুধু বিপুল কলেবরে হয় তা নয়। পাস্তেরনাকের `জিভাগো` খুবই ছোট কলেবরের উপন্যাস, কিন্তু এপিক। খুটনাটি সময়খন্ডগত বাক এপিকের মুল শর্ত। আবার ইতিহাসকে ধারন করে এপিক সাহিত্যের নান্দনিকতাও আদায় করে। `প্রদোষে প্রাকৃতজনের` পাশাপাশি বংগবন্ধুর `অসমাপ্ত আত্মজীবনি`ও এপিক গোত্রের লেখা।

আমাদের সমকালিন বাংলা সাহিত্যের সর্বোত্তম এপিক ধর্মি কাজ এসেছে শামসুর রাহমানের কবিতার রথে চড়ে, যার সমগ্রতা আমাদের স্থানিয় বাস্তবতাকে বিশ্বজনিন মিথের বাহনে আকাশচারি করে। আমার নিজের `জুলেখা ট্রিলজি` এপিক অনুশিলনে জর্জ মার্টিনের পাশাপাশি আমাকে সংগ দিয়েছে সেই পাচশো বছর আগের বাঙালি লেখক শাহ সগির, তারো বহু শত বছর আগের চন্দ্রাবতি। মার্টিনের রসে পুরোপুরি রাহুগ্রস্থ হতে ইন্ধন যুগিয়েছে পেছনের এপিক রচয়িতারা। অধস্তনের বিনিত সালাম।

লেখকের নিজস্ব বানানরীতি অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে