ঘোর অন্ধকারে কে আসবে আলোর মশাল নিয়ে

তারেকুজ্জামান তারেক

প্রকাশিত : জুন ২০, ২০২০

এক দশক ধরে একটু গভীরভাবে যারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, তারা উপলব্ধি করছে, নতুন প্রজন্ম ক্রমশই প্রবীনদের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলছে। দিন দিন বড় হচ্ছে নবীনদের এ মিছিল। খেয়াল করলে দেখা যাবে, ধীরে ধীরে তরুণদের নতুন এক বলয় গড়ে উঠছে। সাহসী ও উদ্যেমীরা এক হয়ে নতুন কিছু করতে চাচ্ছে। অথচ এক্ষেত্রে বড়দের সাথে তারা কোনো যোগাযোগ রাখতে চাইছে না। নিতে চাচ্ছে না তাদের কোনো পরামর্শ। এটা কেন করছে, বড়রা এখনও বুঝে উঠছে না বা বুঝার চেষ্টাটুকুও করছে না। কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত হলেও অনেকে বিষয়টিকে এখনও অবহেলার দৃষ্টিতে দেখছে। আসলে এটাই আমাদের মূল সমস্যা। সমস্যা যখন ছোট থাকে, তখন বিষয়টিতে কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় না। কিন্তু যখন তা বিশালাকার ধারণ করে, প্রবল বন্যার ন্যায় সব কিছু ভাসিয়ে নিতে থাকে, তখন তাদের হুঁশ ফেরে। ততদিনে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরপর অপরিকল্পিতভাবে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যা সেই স্রোতকে থামাতে তো পারেই না; উল্টো আরও বেগবান করে দেয়।

আসলে আস্থা হারানোর মতো কাজ করলে আস্থা হারানোটাই স্বাভাবিক। আস্থা না হারালেই বরং আমি শঙ্কিত হতাম। ভুলকে যদি ভুল বলে চিহ্নিত না করা হয়, সেটা তো পরবর্তীদের জন্য দলিল হয়ে দাঁড়াবে। এখানে ছোট ও বড়র পার্থক্য গৌন। স্পষ্ট ভুলকে ভুল বলাটা বেয়াদবি নয়; বরং সৎ সাহসের পরিচায়ক। নীরব থাকাটাই বরং শয়তানি ও এক প্রকারের বেয়াদবি। এজন্যই হাদিসে এসেছে, আমার উম্মতের সকলে একসাথে ভুলের ওপর কখনো একমত হবে না। তাই তথাকথিত বড়-ছোটর এই যে একটি বিভাজন রেখা তৈরি হচ্ছে, বাড়ছে উভয়ের মাঝে দূরত্ব, তা ততদিন পর্যন্ত আমি ইতিবাচক বলে মনে করব, যতদিন না বড়রা তাদের গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে দরদের সাথে উম্মাহর হাল ধরবে। যতদিন না তারা সত্য-মিথ্যার প্রভেদ স্পষ্ট করার ক্ষেত্রে আপোষহীন হবে, যতদিন না তারা সকল স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে উম্মাহর স্বার্থকে বড় করে দেখবে; ততদিন তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাই আমি ভালো মনে করি। ইতিহাসে এমন নজিরের অভাব নেই, যেখানে বড়দের স্পষ্ট ভুল ছোটরা প্রত্যাখ্যান করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। প্রতিষ্ঠা করেছে দুনিয়ার বুকে সত্য ও হকের কালিমা।

আপনি যখন ছোটদের সাথে একই ভুল বারবার করতে থাকবেন, তখন আপনি তাদের ওপর মুরুব্বিয়ানা আচরণ করতে পারেন না, তাদের ওপর কোনো অধিকার দাবি করতে পারেন না। আপনাদের ডাকেই তো এক সময় দেশের আপামর জনতা এক পতাকা তলে জমায়েত হয়েছিল। আপনারা কি পেরেছেন তাদের সে আস্থা ধরে রাখতে? পারেননি, ধরে রাখতে পারেননি কোটি মানুষের আস্থা ও ভরসার জায়গা; বরং খণ্ড-বিখণ্ড করে দিয়েছেন তাদের দ্বীনি আবেগের শেষ সম্বলটুকু। শুষ্ক করে দিয়েছেন তাদের ঈমানি আর্দ্রতার শেষ ফোঁটাটুকুও। আর কী চান? আর ক’বার মানুষ আপনাদের ওপর আস্থা রাখবে, আর ভাঙতে থাকবে? তাদেরও তো রক্তের দাম আছে! তারাও তো মানুষ! তাদেরও তো পরিবার আছে! তারা আপনাদের ডাকে জীবন পর্যন্ত কুরবান করে দেবে, পঙ্গুত্ব বরণ করবে, আর আপনি এসি রুমে বসে শত্রুদের সাথে বুকে বুক মিলাবেন, দুশমনদের কথায় উঠবস করবেন, এটা পরিষ্কার গাদ্দারি। হিকমতের দোহাই দিয়ে এক সময় পার পাওয়া গেলেও সচেতনতার এ যুগে পরিস্থিতি আর তেমন নেই। হিকমত কী জিনিস, সবাই তা ভালোমতোই টের পেয়েছে।

৫ মের বিপর্যয়ের পর অসংখ্য আলিম ও তালিবুল ইলম কষ্ট ও দুর্যোগের মধ্য দিয়ে সময় পার করেছে। জেল-জুলুমের ভয় ও একগাদা মামলা কাঁধে নিয়ে অসহায়ের মতো এদিক-সেদিক পালিয়ে বেড়িয়েছে। অনেকে তো শহিদ হয়েছে এবং অসংখ্য ভাই পঙ্গুত্ববরণ করেছে। এমনও অনেক ভাই আছে, যাদের বাসার উনুনে দীর্ঘদিন পর্যন্ত আগুন জ্বলেনি। চিকিৎসার জন্য সামান্য অর্থও পায়নি। সেসময় কিন্তু আপনারা ঠিকই এসিরুমে বসে মুরগির রান আর খাসির কাবার চিবিয়েছেন। শহিদ পরিবার বা আহতদের দেখার এতটুকুও গরজ অনুভব করেননি। কেউ শহিদ পরিবারকে সাহায্য করতে চাইলে শাওয়ার নষ্ট হওয়ার ভয় দেখিয়েছেন। শেষ শোকরানা মাহফিলে শাহাদাতের কথা অস্বীকার করা হলে সামান্য প্রতিবাদ পর্যন্ত করা হয়নি। আরও অনেক তিক্ত সত্যই আছে, যা জাতির সামনে বলতে লজ্জা লাগে। আল্লাহ আপনাদের হিদায়াত দিয়ে ক্ষমা করুন; আর নাহয় ধ্বংস করুন। এগুলোর দলিল আমরা নিজেরাই। এর জন্য পত্রিকার লিংক বা কোনো চ্যানেলের রিপোর্ট দেখানোর দরকার নেই। পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা দিয়ে সাক্ষ্য তলব করুন, হাজার হাজার সাক্ষী পেয়ে যাবেন।

বাংলাদশের নানা দল ও ফিরকার বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠের আওয়াজ বহুত শুনেছি। অনেক দেখেছি, দিন-রাত একাকার করে মুসতাহাব বিষয় নিয়ে তর্ক করার প্রস্তুতি নিতে। বিভিন্ন কিসিমের হুমকি-ধমকি দিতে অভ্যস্ত এক শ্রেণির বক্তারা দরদের মঞ্চে বসেও উদ্দীপ্ত কণ্ঠে ইখতিলাফি বিষয়ে বাতিল প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছেন। দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও বাতিলের সাথে কোনো ধরনের আপোষের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। অথচ তাদের কখনো রাষ্ট্রীয় কুফর ও শিরক নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি। সুস্পষ্ট দলিলের আলোকে কেউ এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলেও তাকে উগ্র ও কওমির কলঙ্ক আখ্যা দিয়ে অবাঞ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, আর কাউকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। তাওহিদের শিক্ষা না দিয়ে তাদেরকে দেয়া হয়েছে সুফিবাদ ও অন্ধ অনুসরণের শিক্ষা। আল-ওয়ালা ওয়াল বারার উজ্জীবিত চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে পার্থিব পদ ও স্বার্থকেই রাখা হয়েছে সর্বাগ্রে। এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম? এটাই কি ছিল আমাদের হিকমতের কারিশমা?? আর কত দেরি করলে আমরা বুঝব হিকমতের রহস্য? আদৌ কি এ হিকমতের গিঁট খুলবে? এ বদ্ধ দুয়ার কি সত্যিই কোনো দিন উন্মোচিত হবে?

সর্বশেষ যে সত্য আজ না বললেই নয়, মানুষ আজ হকের জন্য পাগলপারা। ইন্টারনেট যেমন অনেক যুবককে চরিত্রহীন করেছে, তার বিপরীতে অনেক পথিককে সত্যের দিশাও কিন্তু দিয়েছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় অনেকের মধ্যে দ্বীনের প্রতি প্রবল আগ্রহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দরদি দায়ি ও বিজ্ঞ আলিমদের বলছি, এ সুযোগটিকে কাজে লাগান। দ্বীনের কল্যাণে তাদের জন্য সত্যের ভাণ্ডার খুলে দিন। তাগুতের ভয়ে সত্য লুকিয়ে আর কত দিন বেঁচে থাকতে চান? এই তো সেদিন মারা গেলেন এক যুবক আলিম। তিনি জেনে হোক বা না-জেনে আল্লাহর অমোঘ এক বিধানের বিরোধিতা করতেন। এ মহান পথের পথিকদের গালিগালাজ করতেন। সরকারের রক্তচক্ষুর ভয় করতেন। কই! তিনি কি বাঁচতে পেরেছেন? তিনি কি তার নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বিদায় নিয়েছেন? না, যথাযথ সময়ে, তার নির্ধারিত দিনেই তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যর সময় চলে আসলে বা তাকদিরে বিপদ লেখা থাকলে কেউ তা প্রতিরোধ করতে পারবে না। তাই হে বিজ্ঞ আলিমসমাজ, তাগুতের ভয়ে আর কত দিন নীরব থাকবেন? আর কত দিন পর হিকমতের দুয়ার বন্ধ করবেন? প্লিজ, আল্লাহকে ভয় করুন, ভয় করুন আখিরাতে জবাবদিহিতার।

আজও কি সময় হয়নি তাওহিদের প্রকৃত অর্থ মানুষের সামনে তুলে ধরার? আজও কি সময় আসেনি শিরক-বিদআতের বাস্তব রূপ তাদের সামনে প্রস্ফুটিত করার? আল-ওয়ালা ওয়াল বারার মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিষয়ে আজ ক’জন জানে? নাওয়াকিজুল ইমান বা ইমান ভঙ্গের কারণসমূহ সম্বন্ধে ক’জন ধারণা রাখে? ফিতানের বিশুদ্ধ বর্ণনা মানুষের মাঝে কতটুকু প্রচারিত হয়েছে? জ্ঞান বিতরণ ও ওয়াজের প্রচলিত ধারা কি এ যুগে এখনও সচল ও কার্যকর? আংশিক ইসলামকেই যে আজ মানুষ দ্বীন ভেবে বসছে! শুধু সাধারণদের কথা বলছি কেন, আমাদের আলিম সমাজেরই আজ কয়জন জানে তাওহিদ, আকিদা, শিরক, বিদআত, আল-ওয়ালা ওয়াল বারাসহ ইসলামের অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলির ব্যাপারে? সত্যিই আমরা কালো অন্ধকার এক যুগের দিকে ফিরে যাচ্ছি। যখন জাহিলরা আলিমদের আসনে বসবে। অযোগ্যরা ফতোয়া দেয়া শুরু করবে। জালিমরা নেতৃত্বের আসনে বসবে। আর আলিমরা রাজ দরবারের সান্নিধ্য পেতে প্রচেষ্টা চালাবে। সে সময় কি সমাগত নয়? রাতের নিকষ কালো অন্ধকার কি এখন দৃশ্যমান নয়?

এ ঘোর অন্ধকারে কে আসবে আলোর মশাল নিয়ে? কে আছে, যে অমানিশার রাত চিরে আলোকিত ভোরের আজান দেবে? আছে কি কোনো হিম্মতওয়ালা, সব বাতিলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যে সত্যের বদ্ধ দুয়ার উন্মোচন করবে? দিগ-দিগন্তে ছড়িয়ে দেবে মুক্তির পয়গাম আর জড়ো করবে মুক্তিপাগল মুমিনদের বিজয়ের মিছিলে?