ঘোড়াউত্রা নদীর মাঝিদের বিরিয়ানি

কাজল শাহনেওয়াজ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৫, ২০১৯

আচ্ছা, হাওরের মাঝখান দিয়ে যে নদীটা গারো পাহাড়ের পানি বহন করে মেঘনায় নিয়ে যায়, সেই নদীতে যে সব নৌকা চলে, তাদের মাঝিদের কি দুচারটা ভাল মন্দ খাইতে ইচ্ছা করে না? ধরা যাক চৈত্রের শেষের দিকে, পানি শুকিয়ে যখন অনেক নিচে নেমে গেছে, ধু ধু হাওর, রয়েছে প্রান্তরের যতদূর চোখ যায়, বোরো ধান। সেখানে সাপের চেয়ে বেশি ছন্দময় হয়ে একেবেঁকে গেছে ঘোড়াউত্রা নদী। পানিতে মাছ কমে এসেছে, তবে সুস্বাদু শাদা চিংড়ি এখনও পাওয়া যায়! মাঝিমাল্রারা নৌকা চালাচ্ছে।

ঘোড়াউত্রা’র মাঝিরা বিরিয়ানি খাবে বলে ঠিক করল। সরিষার তেলে রান্না, গোস্তের বদলে চিংড়ি, আলুবোখারার বদলে কাঁচা আম। কয়েকটা বেগুন আছে নৌকায়, তাও দেয়া যেতে পারে!

বারতলা এপার্টমেন্টের নৌকায় বসে টিভিতে ইউটিউবের একটা সাফারি সিনেমা দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হলো, আহারে, কতদিন ভাইবোনদের এই বাসায় দাওয়াত দেয়া হয় না! বৎসরে দুই ঈদে মায়ের কাছে কিশোরগন্জ যাওয়া হলে, দেখা হয়। তা না হলে ওরাই খেতে ডাকে। সকালে ফেবুতে দেখেছি ছোট বোনের জন্মদিন আজ। তখনোই ঠিক করা হলো, একটা ভোজ হয়ে যাক! ঢাকা শহরে বসে ঘোড়াউত্রা নদীর মাঝিদের পদ্ধতিতে বিরিয়ানি খাওয়া হবে আগামি কাল!

বৌ বলল, বুয়া আজ থেকে ৫ দিনের ছুটিতে দেশে গেছে! শুক্রবারের ছুটির দিনটা আমাকেই সব করতে হবে! বললাম, আমরাও হাত লাগাবনে। ও বলে তুমি আর তোমার মেয়েতো ঘন্টা করবা! বড় জোর মটরসুটি খুলে দিবা। আমি বললাম, ঠিকাছে, আমি না হয় রেসেপিটা প্রচার করে দিব।

রাত্রের মধ্যেই মহা উৎসাহে দাওয়াত দেয়া হলো। উত্তরা থেকে মামুন ফ্যামেলি। রিয়া বলল, আমরা কি হেল্প করতে পারি? বললাম, সমস্যা হৈছে শীতের দিনে কাঁচা আম কই পাই। মাঝিদের স্বাদ বোধয় আর হল না। আলুবোখারা দিয়ে কি হবে। ও বলে, আমাদের ডীপে তো কাঁচা আমের স্লাইস জমানো আছে। বলে কি মেয়ে! বরাবরই শে আমার খাদ্য উৎসাহকে সমর্থন করে। দারুন মেয়ে! বললাম ভাতিজি দুইটারে ক্ষুধা লাগাইয়া নিয়া আইসো। ওদের তো কোয়েল পাখির মত আহার।

ছোট বোনকে জানাতেই বিরিয়ানির নাম শুনে আহলাদিত হয়ে গেল। যেন আসলেই জন্মদিন হচ্ছে। বলল, আমার কাছে যশোরের খাঁটি খাজুরে গুড় আসছে, শাশুড়িকে দিয়া পিঠা বানাইয়া সারপ্রাইজ দিমু! পিঠা আইডিয়া দারুণ লাগলো। ওর শাশুড়ি বরিশাল আগৈলঝাড়ার ঘরানায় রান্না করেন। পিঠা নিশ্চয়ই সেই রকম হবে।

লালমাটিয়ার ভাইটা পা ভাইঙ্গা ক্র্যাচ দিয়া চলাফেরা করে। ও বলল, গতকালই খাগড়াছড়ি থেকে পাহাড়ি মোরগ নিয়া আসছে সেতু। পাহাড়ি ভুনা হবে।

শুক্রবার সকালে দশভূজা গৃহকর্ত্রী রান্নাঘরে ঢুকলেন।
দুপুরে মিনাবাজার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করা হল। সেই সুদুর কলাবাগান বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে ছানার আমিত্তি সংগ্রহ করা হল। আমি প্রবল উৎসাহে বিশাল সাইজের ব্যাগগুলি বহন করে গেলাম। শুধু নজর রাখলাম মুরগি-সবজির জন্য যেন বৈচিত্রপূর্ন তরকারি থাকে। আর ফলার তৈরিতে যেন বহুমাত্রিক ফল-ফলাদি থাকে।

হাওরের তাজা চিংড়ি পাওয়া গেল। চার/পাচ ইন্চি সাইজের, স্বাস্থবান। মাঝিরা যদিও আরো ছোট চিংড়ি ব্যবহার করে, খোসা সহই। কিন্তু শহুরে হাফ হজম-ক্ষমতার বাচ্চাগুলির কথা মনে করে, এই সাইজেরটা নেয়া হল। বললাম, এইগুলিই চোকলা ছিলে টুকরা টুকরা করে দিও।

আমি আরো কিছু নতুন ও ইনোভেটিভ কাষ্টোমাইজড আইটেম পরিকল্পনা করছিলাম। কিন্তু মেয়ে বলল, এটা ঠিক হবে না। দুই চার জনের জন্য নিরীক্ষা করা যায়, কিন্তু জনা বিশেক মানুষের জন্য তা হৃদয় বিদারক প্রবন্চনা হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু আমি সারাজীবন যেভাবে কবিতা লিখে আসছি, তা থেকে একপ্রকার আত্মবিশ্বাস পেয়েছি। কিছু কিছু মানুষের কাজকে প্রথম নিরীক্ষাধর্মী মনে হয়, কিন্তু তা ক্রমেই নতুন পথের দিশা দেয় ও অভূতপূর্ব বলে প্রতীয়মান হয়ে পড়ে। নতুন ভাবে খাবার তৈরি করাও সেরকম। যদিও খাবার নিয়ে প্রচলিত স্বাদছন্দ ও স্থানীয় ভূ-জলবৈচিত্রের প্রচুর সম্মান রক্ষা করা জরুরী।

লালমাটিয়া থেকে ছোটভাই, তার বৌ লিজা এবং ছেলে প্রীণন সবার আগে এসে হাজির হল রান্না করা পাহাড়ি মোরগ নিয়ে। প্রীণন এই রাত্রি বেলাতেও কালোচশমা পড়ে এসেছে। আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। একটু পরে দেখি ওর বাবাও এক চমৎকার গোল কালো চশমা পকেট থেকে বের করে পড়ছে। অথচ দুজনেই অনেক পাওয়ারের চশমা পড়ে।

সবাই এলে একসময় এই গোল-কালো-চশমাটা একটা আইটেম হয়ে উঠলো। অনেকেই তা চোখে লাগিয়ে পিক তুললো।

যাবার সময় প্রীণনের কালো চশমা রহস্যের সমাধান হয়েছিল। ওর চোখে অন্জলী উঠেছে, আর ও চাচ্ছিল কাজিনরা যেন এটা না দেখে, তাই এই ইনটেলিজেন্ট সমাধান। ওর বাবা শামীম ওর চশমাপড়াটাকে ক্যামোফ্লেজ করার জন্য নিজেও একটা ডাইভার্সন করেছে। এবং সফল ভাবেই। আমরা দুচারজন ছাড়া কেউ সেটা বুঝতে পারে নাই।

মাঝিদের বিরিয়ানীর জন্য কাঁচা আম লাগবে। আর তা আসতেছে উত্তরা থেকে। কিন্তু ওদের উবার আর আসে না। শুনলাম বিজয় সরণীতে বানিজ্যমেলার জ্যাম লাগছে।

ফেসবুকে গ্রুপচ্যাট করছিল সবাই। ক্ষণেক্ষণে আপডেট হচ্ছে। ছবি আপাচ্ছে।
এর মধ্যে মহাখালি থেকে ভাইগ্না বাহিনী চলে এল। ভাইগ্না ‘সম’ কে বলছিলাম আমার কবিতা থেকে একজন ছয়টা গান বানাইছে, তা শুনাব।

অবশেষে উত্তরা বাহিনী এল। বিরিআনি রান্না হতে থাকল। আমরা পেনড্রাইভে গানগুলি কপি করে টিভিতে লাগিয়ে শুনলাম। একুস্টিক ধাঁচের গান কার কেমন লাগল বুঝতে পারলাম না।

অবশেষে রান্না শেষ হল। সবাই এপার্টমেন্টের সীমিত স্পেসে বসে বেশ একটা নৌকা নৌকা ভাব নিয়া, একে অন্যের ঘাড়ের উপর দিয়া প্লেট নেয়া দেয়া করতে করতে খেতে লাগল। আমাদের ভগ্নি জামাতা, নাট্যজন অলক প্রশংসার ফুলঝুড়ি ছুটাইলেন। মুখর লিজার মুখে শুধু শুনা গেল: মাঝি মাঝি!

কিশোরগন্জ থেকে সবাই গম্ভীর মুখে চ্যাটবক্সে বসে ছিল। ওরাও একসময় নিরবতা ভেঙ্গে জিগাইলো: মাঝির বিরিয়ানি কি? মা আর ঝি মিল্লা রান্না করছে?

রিয়া মাইগ্রেনে কাতর ছিল, শে ও একপ্লেট খাইয়া হাসিমুখে বলল, ব্যথা কমতেছে।

পেয়ারা-আপেল-সাদা কালো আঙ্গুর-কামরাঙা-নাসপতি-ডালিম-বরই দিয়া বানানো ফলার খাইতে খাইতে কখন যে দশটা বেজে এগারোটার দিকে চলে গেল, টের পাওয়া গেল না। অতিরিক্ত খাবার খালি বক্সগুলিতে আপলোড হৈল। তারপর বারটা বাজার আগেই যে যার আশ্রয় নেয়া ধামের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবিত হৈল।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক