
চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী
পর্ব ১৯
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : জুন ০৩, ২০১৯
এক.
যে নারীকে তার প্রেমিক কোনোদিন সাজতে বলেনি, বলেনি ‘অমন করে কাজল পরলে তোমাকে বেশ মানায়’ কিংবা ‘চুলটা এভাবে বাঁধো’, সে নারী কি সাজবে না? নিজের প্রতি অযত্ন সেও তো এক অভিমান। সাজবে সে। কেবল নিজের মনের মণিকোঠায় নিজের ছবিটি সযত্নে লালন করবে বলে।
যে নারী তার প্রিয়তমের চোখে মুগ্ধতা দেখেনি বহুদিন, প্রত্যাশায় দিন কেটেছে এক অমনোযোগী পুরুষকে নিয়ে যে কিনা কেবল আকাশ দেখতে ভালোবাসে, সেও কি নিজের প্রতি মুগ্ধ হতে ভুলে যাবে? যাবে না। আমৃত্যু দু’একটা শব্দের প্রত্যাশিত শ্রবণের তাড়নায় জন্ম নেবে গোপন এক আত্মশ্লাঘা। নিজের চোখে চোখ রেখে তখন বলতেই হবে, ‘আহা চিরসুন্দরী! আর কেউই তোমার মতো নয়।’
ভালোবাসা না পেলে মানুষ বদলে দেয়। সে আরও অলঙ্ঘ্য, কঠিনতর হয়ে ওঠে প্রিয়তমের অবজ্ঞায়। নিজেকে নিজের জন্যই ভূষণে আবরিত করতে হয় তখন। কাজল, অধররঞ্জন, কাঁকনের সাজ, ফুলের সুবাসে আদেহসুন্দর প্রতিমাটি নিজেই নিজেকে পুজো করে আত্মরতির আছিলায়। দূরে বেজে ওঠে শঙ্খধ্বনি, পুষ্পবৃষ্টি হয়।
কেউ কি আছে তবে তার অপেক্ষায়? যে চরণ থেকে আমুণ্ড তার স্তুতি করবে! নিপুণ করে বাঁধা বিনুনির এক একটি পাক খুলে দেবে নিজ হাতে। চরণ পদ্ম দুটি করকুন্তলে ধারণ করে বিস্মিত নেত্রে তার দিকে চেয়ে থাকবে যে। তারপর বলবে, তুমি সুন্দর, আহা বড় সুন্দর তুমি।’ কোনো বাধা না মেনে নিমেষে মুছে দেবে মাঝখানের দেয়াল টুকু, সিঁথি ভরা সিঁদুর।
কেউ না ভালোবাসলেও নিজেকে তো ভালোবেসে যেতে হয় এভাবেই। তার জন্য, যার সাথে দেখা হবে না আজীবন।
দুই.
আমাদের বাড়িতে ঘরোয়া কাজে হেল্প করে যে মেয়েটি তার বোনের বাচ্চা হয়েছে। কাল জিজ্ঞেস করায় বললো, ‘ছেলে হয়েছে। সবাই খুশ আছে। মেয়ে হলে ভালো ছিলো না।’ আমি বললাম, ‘সে কি রে! যারা বলছে তারা মেয়ে নয়?’ সে জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ, তবুও।’
সে আপনি যতই ছেলে মেয়ে সমান বলে চিৎকার করুন এই হলো ভারতবর্ষের আম জনতা, আজ এই দুহাজার উনিশ সালেও, মেয়ে বাচ্চা হলে যারা না-খুশ হয়ে যায়। যে মেয়েটির কথা বলছি ওদের মা আর ওরা দুবোন লোকের বাড়ি কাজ করে। আরও এক বোন আছে। সেও লেগে পড়বে কিছু দিনের মধ্যেই। এক দু ক্লাস অবধি পড়িয়ে ওদের মাই স্কুল ছাড়িয়ে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। তিনজন মিলে মোষের মতো খাটে। ওদের উপার্জনেই সংসার চলে। ওদের বাড়ির বাপ দাদারা মদ খায়, বউ মেয়েকে পেটায়। তার পরেও ওরা ছেলে হলেই খুশ, মেয়ে হলে নয়।
ভাববেন না অশিক্ষিত বলে। অনেক শিক্ষিত লোকও ভেতরে ভেতরে এতটাই অন্ধ। আর্থিক স্বনির্ভরতাই যে সব তাও নয়। অনেক স্বনির্ভর শিক্ষিত মহিলাকেও দেখেছি এভাবে ভাবতে। তাদের অনেককেই একটা রিগ্রেসিভ ম্যারেজের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে দেখেছি কোনক্রমে লোকে কি বলবে সেই ভয়ে। এই ভয়ও এক ধরনের বিশ্বাসপ্রসূত। ঐ বিশ্বাসের বদল দরকার।
বিশ্বাসে কে কতটা এগিয়ে আছেন কে কতটা পিছিয়ে সেটা মুখের বুলিতে প্রমাণ হয়না, প্রমাণ হয় যাপনে। নিজের পার্টনারকে কতখানি সম্মান দেন, নিজের ছেলে মেয়ের মধ্যে বিভেদ করেন কিনা, মেয়ের বিয়েতে প্রচুর টাকা উড়িয়ে পাত্র পক্ষের কাছে বড় হওয়ার কথা ভাবেন না মেয়েকে শিক্ষিত করার কথা, আপনার পাশের বাড়ির মেয়ে অফিস থেকে রাত করে বাড়ি ফিরলে আপনার ভ্রূ কুঞ্চিত হয় কিনা, কে কি পোশাক পরবে সেটা ঠিক করার মালিক আপনি নিজেকে ভাবেন কিনা, স্ত্রীকে মানুষ বলে গণ্য করেন কিনা ইত্যাদি অনেক কিছুতেই তার প্রকাশ ঘটে।
সর্বোপরি বোঝা যায় একজন মহিলার আরেকজন মহিলার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। সারাজীবন নারীবাদের বুলি কপচে যেসব মহিলারা শাশুড়ি হওয়ার সাথে সাথেই বৌমাকে কোণঠাসা করতে নেমে পড়েন আর ঘন ঘন সাপের স্বপ্ন দেখেন কবে নাতি হবে এই আশায় আর সেই সব মায়েরা যারা নিজেদের সংসারে নিগৃহীত হয়েও এখনো বিশ্বাস করেন ও বিশ্বাস করাতে ভালোবাসেন যে একটি আদর্শ সুখী সংসারই কন্যা জন্মের প্রকৃত প্রাপ্তি, তাঁদের জন্যই এ সমাজ এগোচ্ছি এগোচ্ছি করেও এগোলোনা আজোবধি।
আদর্শ সুখি সংসার! এ যেন সোনার পাথরবাটি। সামান্য খোঁচা দিলেই ঝুরঝুর করে বেরিয়ে আসবে গলা পচা কঙ্কাল আর না বলা আত্মঘাতের কাহিনী। সব মৃত্যু শরীরের নয়। মৃত্যু হয় অন্তরাত্মার। মৃত্যু হয় বিশ্বাসের। এমন অনেক গল্পই তো আমরা জানি। তবে তারপর?
লেখক: কবি