চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ২০

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুন ২১, ২০১৯

মেয়ের তখন একবছরও বয়স হয়নি। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি, হাতের বুড়ো আঙুল ফুলে কলাগাছ। নরম সাদা চামড়ার নিচে জমা পুঁজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কি থেকে এমন হলো ভেবে আমরা দিশেহারা। রাত বাড়তে গায়ে জ্বর এলো। যন্ত্রণায় কেঁদে কেঁদে তখন ঘুমিয়ে পড়েছে ও। ভোর চারটের সময় আমরা দৌড়লাম কলকাতার দিকে।

ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড হেল্থ এ পৌঁছলাম যখন ভোর ছটা। নাম লিখিয়ে এমার্জেন্সিতে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলাম যখন নটা বেজে গেছে প্রায়। ডাক্তার বললেন ইনফেকশন। কারণ বোঝা যাচ্ছে না। অপারেট করে পুঁজ বের করতে হবে। কিন্তু সেদিন বেড অ্যাভেলেবল না থাকায় মলম দিয়ে ছেড়ে দিলেন।

আমরা তখন যথেষ্ট উৎকণ্ঠিত। রিস্ক নিতে চাই না বলে ছুটলাম শহরের এক নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে। ওদের এমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্ট রেফার করলো ওদেরই এক স্পেশালিস্টের কাছে। স্পেশালিস্ট দেখে টেখে বললেন, সেদিনই অপারেট করতে হবে। তাও নাকি ফুল অ্যানেস্হেসিয়া করে। ল্যাপটপে ঝটপট হিসেব করে বলে দিলেন কত লাখ লাগবে এবং অগ্রিম হিসেবে কত দিতে হবে তক্ষুণি। তখন বেলা এগারোটা হবে।

আমার মেয়েকে যে পেডিট্রিশিয়ন ছোট থেকে দেখেন ও ভ্যাকশিন করেন এবার তাকে ফোন করায় তিনি আঁতকে উঠে বললেন, ‘না-না এখনি ওটিতে যাবেন না।’ উনি শহরে না থাকায় অন্য একজন চাইল্ড স্পেশালিস্টের রেফারেন্স দিলেন। এমন সময়, দৈবাৎ অথবা কোনো দৈবশক্তি বলে, মেয়ের আঙুলের ফোসকা পড়া অংশটা নিজে থেকেই ফেটে পুঁজ ও রক্ত বেরিয়ে এলো। সেটাকে কোনোরকমে ব্যান্ডেজ করে নিয়ে এলাম চন্দননগরে এক বয়স্ক শিশু বিশেষজ্ঞের চেম্বারে। উনি দেখে টেখে ওষুধ দিলেন। বললেন, ‘এটার জন্য ওটি রেফার করেছিলেন? শুনুন, একটা কথা মিলিয়ে নেবেন, আমরা হলাম লাস্ট জেনারেশন অফ ডক্টরস যারা অনেস্টলি কথা বলে।’

অভসারভেশনটা ছিল একজন ডাক্তারের অন্য ডাক্তার সম্পর্কে। ঘটনাচক্রে, আমি কোনোদিনই ডাক্তারদের ভগবান মনে করি না। সমাজে বিভিন্ন কর্মে নিযুক্ত প্রতিটা মানুষই কোনো না কোনোভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সুগম করার কাজেই রত আছেন। যে যার স্কিলের বিনিময়ে গ্রাসাচ্ছাদন করছেন। সেখানে ডাক্তারি পেশাটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ এই কারণেই কারণ ওনারা সরাসরি মানুষের বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়ার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকেন। আর সেই কারণেই, `ভগবান` শব্দটি একটি অত্যুক্তি হলেও, `মানুষ` হওয়া ব্যতিরেকে ডাক্তার হওয়া এক অসম্ভবের সাধনা। সেক্ষেত্রে অনেক `মানুষ` ডাক্তারের দেখা যেমন পেয়েছি এযাবৎ যাঁরা সৎ ও সেবক, আবার `অমানুষ` ডাক্তারও বিরল নন। কিন্তু সমস্যা হলো গিয়ে এই জীবিকায় একজন অমানুষেরও স্হান হওয়া উচিত নয়, হেতু তাঁরা গোটা প্রফেশনটাকেই কলঙ্কিত করেন, তথা যেটা ধ্বংস করে দেন তা হলো মানুষে মানুষে বিশ্বাসের সেতু। ঠিক যেমন, একজন প্রেমিকের দ্বারা প্রতারিত হলেই আমরা ধরে নেই যে প্রেম বলে আসলে কিছুই নেই এ ধরায়। কিংবা ধর্ষিতা নারীর প্রতীতি জন্মায় যে পুরুষ মাত্রই ধর্ষক। ঠকে যাওয়ার এটাই তো ধর্ম।

এখন প্রশ্ন হলো, এই ঠকে যাওয়া মানুষেরা কোথায় যাবেন? যে কোনো কর্নার্ড সিচ্যুয়েশনে প্রতিশোধের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার যে আগ্রাসন এতো ইনসিকিউরিটি থেকেই জন্ম নেয়। অসংগঠিত ক্ষোভ আর অসহিষ্ণুতার ফল তখন চোকাতে হয় এমন মানুষদেরও যারা হয়তো সেভাবে অপরাধের সাথে যুক্তই নন। একে প্রতিরোধ করার যে উল্টো চাপ আসে সেও আরেক অসহায়তা থেকেই জন্ম নয়।

কিন্তু এতে কোনো উপশম হতে পারে কি? সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যে অপরাধী সে ডাক্তার হোক কিংবা সাধারণ ভোক্তা তার শাস্তি দ্রুত এবং চূড়ান্ত হলেই তো এমনটা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তা হয় কি? সব থেকে বেশি ভুক্তভোগী হন সাধারণ মানুষ। সব থেকে বেশি বঞ্চিত হন তাঁরাই। সবথেকে বেশি প্রতারিতও। ন্যায় বিচার প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ওপর থেকে যখন সবার বিশ্বাস উঠে যায় তখন নিজেদের মধ্যে কামড়া কামড়ি করে মরা ছাড়া আর উপায় কি? দিনশেষে, সকলেই মানুষ। কেউই তো ভগবান নয়।

যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজের বাবার জিনিস খাইয়ে পড়িয়ে সবাইকে বাঁচিয়ে রাখেন, ভোট না পেলে রাজ্যবাসীকে ত্যাজ্য পুত্র করার ভঙ্গিমায় বলে ওঠেন, ‘এবার দল করায় মন দেব’, সে রাজ্যে কেবল দলাদলি হবে এটাই স্বাভাবিক। এ রাজ্যে যে কেউই আক্রমণকারী হতে পারে, কারণ এখানে সকলেই আক্রান্ত। এখানে প্রতারিত কে নয়? চলবে

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক